ঢাকা মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪

প্রতারক কাকে বলে!

প্রতারণার টাকা জমাতে ৬৬ অ্যাকাউন্ট, দামি গাড়ি জব্দ, বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন সিআইডিতে

প্রতারক কাকে বলে!

সাহাদাত হোসেন পরশ

প্রকাশ: ১০ ডিসেম্বর ২০১৭ | ২০:০২

কখনও তারা পরিচয় দেয় আমদানি-রফতানিকারক ব্যবসায়ী। আবার কখনও ডেভেলপার ব্যবসায়ী। রাজধানীর বারিধারা, নিকুঞ্জ, উত্তরাসহ বেশকিছু জায়গায় আলিশান কার্যালয় ভাড়া নিয়ে ব্যবসার নামে বিভিন্ন ধরনের প্রতারণার ফাঁদ পেতে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে তারা। গত আগস্ট মাসে বন্ধকি জমি কেনার কথা বলে গুলশানে একটি ব্যাংকের ম্যানেজারকে প্রতারণার ফাঁদে ফেলে হাতিয়ে নেওয়া হয় ৫৫ লাখ টাকা। ওই ঘটনায় দায়ের করা মামলার তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ মাসুদ খান, আসাদুজ্জামান ও রেজাউল করিম নামে তিন প্রতারককে গ্রেফতার করে। এর পর তাদের বিষয়ে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটে প্রতিবেদন চায় সিআইডি। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পাঠানো এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতারক আসাদুজ্জামান ও তার স্ত্রী জেসমিন বেগম, রেজাউল করিম ও তার স্ত্রী সাদিয়া রহমানের নামে দেশের বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংকে ৬৬টি অ্যাকাউন্ট  পাওয়া গেছে। তবে এখনও মাসুদের ব্যাংক হিসাবের প্রতিবেদন পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া প্রতারক চক্রের আরেক সদস্য ফারুকের ব্যাংক হিসাবের তথ্য চাওয়া হবে। সিআইডির একাধিক উচ্চপদস্থ দায়িত্বশীল কর্মকর্তা গতকাল রোববার সমকালকে এসব তথ্য জানান।

সিআইডি বলছে, পেশাদার প্রতারকদের নামে যেসব হিসাব নম্বর রয়েছে সেখানে কোটি কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে। অথচ তাদের বৈধ কোনো আয় নেই। এমনকি উত্তরাধিকারসূত্রে তারা কোনো সম্পদের মালিক- এমন প্রমাণও পাওয়া যায়নি। প্রতারণায় জড়িত চারজনই গাড়ি-বাড়ির মালিক। তাদের বিরুদ্ধে শুধু সিআইডিতে মানি লন্ডারিং ও প্রতারণার ঘটনায় সাতটি মামলা তদন্তাধীন। দুটি মামলায় এই চক্রের সদস্যদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে। কখনও সমস্যায় পড়লে যাতে তাদের অর্থ বেহাত না হয়, তাই তারা নিজেদের ও স্বজনের প্রকৃত নাম-পরিচয় ব্যবহার করে এত হিসাব নম্বর খুলেছে বলে ধারণা করছে সিআইডি। বর্তমানে কারাগারে থাকা তিন প্রতারককে আবারও হেফাজতে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে বলে জানান তদন্ত-সংশ্নিষ্টরা।

জানতে চাইলে সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার মোল্লা নজরুল ইসলাম গতকাল সমকালকে জানান, প্রতারক চক্রের সদস্যদের নামে এত ব্যাংক হিসাব নম্বর দেখে তারা বিস্মিত। এ চক্রের দুই সদস্যকে প্রথমে আটক করার পর তাদের স্ত্রী ব্যাংকের লকার থেকে স্বর্ণালঙ্কার তুলে নিয়েছে। কিছু হিসাব নম্বর থেকে টাকাও তুলে নিয়েছে। তবে রেজাউলের স্ত্রী সাদিয়া একটি হিসাব নম্বর থেকে ৬০ লাখ টাকা তোলার সময় ব্যাংক তা আটকে দেয়। প্রতারণার মাধ্যমে হাতিয়ে নেওয়া টাকা দ্রুত তুলে সঞ্চয়পত্র কেনার পরিকল্পনা করেছিল সাদিয়া।

বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সিআইডিতে পাঠানো প্রতিবেদন বিশ্নেষণ করে দেখা যায়, প্রতারক রেজাউল করিমের নামে ইউসিবি, প্রাইম, উত্তরা, ট্রাস্ট, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড, ব্র্যাক এবং সিটি ব্যাংকে ২১টি সঞ্চয়ী একাউন্ট রয়েছে। তার এফডিআর রয়েছে ১৫টি। বিভিন্ন ব্যাংকে তার হিসাব নম্বরের মধ্যে রয়েছে- ২১০১১২৭৯৬১০০১, ৪৭২২১২৭৯৬১০০৭, ৪৭২২১২৭৯১০০৮, ৪৭২২১২৭৯৬১০০৯, ৮৭৫২১২৭৯৬১০০১, ৮৬২২১২৭৯৬১০০১, ৮৬২২১২৭৯৬১০০২, ৮৬২২১২৭৯৬১০০৩, ১৫০৯১০০৪২৯২১৭০০১, ১৫০৯৩০০৪২৯২১৭০৩৮, ১৫০৯৩০০৪২৯২১৭০১০, ১৫০৯৩০০৪২৯২১৭০১১, ১৫০৯৩০০৪২৯২১৭০১২, ১৫০৯৩০০৪২৯২১৭০১৩।

আরেক প্রতারক আসাদুজ্জামানের নামে ইউসিবি, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড, সিটি ব্যাংকে বেশ ক'টি হিসাব নম্বর পাওয়া গেছে। রেজাউলের স্ত্রী সাদিয়ার নামেও ডিবিবিএল, প্রাইম, ট্রাস্ট, সিটি ব্যাংকে একাধিক এফডিআর ও চলতি হিসাব নম্বর রয়েছে। আসাদুজ্জামানের স্ত্রী জেসমিনের নামেও বিভিন্ন ব্যাংকে হিসাব নম্বর পাওয়া গেছে। তবে এ দুই প্রতারক, তাদের দুই স্ত্রী এবং তাদের মালিকানাধীন ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে বিভিন্ন ব্যাংকের সব হিসাব নম্বর জব্দ করা হয়েছে।

যেভাবে প্রতারণা : মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা সিআইডির সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার মাহমুদুল ইসলাম তালুকদার সমকালকে জানান, এ ধরনের প্রতারক চক্রকে বলা হয় রয়েল চিটিং গ্রুপ (আরসিজি)। তারা মূলত ভিআইপি এলাকায় অস্থায়ীভাবে আলিশান কার্যালয় ভাড়া নেয়। এর পর টার্গেট করা ব্যক্তিকে বিভিন্নভাবে ফাঁদে ফেলে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়ে কার্যালয় গুটিয়ে পালিয়ে যায়। সম্প্রতি গুলশানে একটি ব্যাংকের ম্যানেজার বন্ধককৃত জমি বিক্রি করতে পত্রিকায় নিলাম বিজ্ঞপ্তি দেন। সেই সূত্র ধরে এক দল পেশাদার প্রতারক ফাঁদ পাতে। প্রথমে ফারুক পরিচয়ে প্রতারকদের একজন ব্যাংক ম্যানেজারের সঙ্গে ফোনে ওই জমির ব্যাপারে কথা বলে। সে নিজেকে তার মালিকের এজেন্ট হিসেবে পরিচয় দেয়। এর পর মালিকের সঙ্গে কথা বলার জন্য নিকুঞ্জ অফিসের ঠিকানা দেওয়া হয়। ম্যানেজার জমির কাগজপত্র নিয়ে ওই ঠিকানায় গেলে এজেন্ট ফারুক, তার মালিক আমজাদ হোসেন, রাচি ইন্টারন্যাশনালের কান্ট্রি ম্যানেজার শামসুল হকের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। রাচি ইন্টারন্যাশনালের কথিত ভারতীয় মালিকের একটি দুর্বলতা হলো, সে ৩ কার্ড দিয়ে এক ধরনের জুয়া খেলতে পছন্দ করে। জুয়া খেলার ফাঁদে ফেলে ব্যাংক ম্যানেজারের কাছ থেকে ৫৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয় প্রতারক চক্রের সদস্যরা। তদন্তে বেরিয়ে আসে, ব্যাংক ম্যানেজারকে ফাঁদে ফেলেছে প্রতারক মাসুদ ও তার তিন সহযোগী। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মাসুদের শিক্ষাগত যোগ্যতা বিএ। তার অন্য দুই সহযোগী রেজাউল ও আসাদুজ্জামান এইচএসসি পাস। এরা দু'জন পোশাক কারখানায় কাজ করতে এসে এ পেশায় জড়িয়ে পড়ে। রেজাউলের বাড়ি গাইবান্ধা সদরের লক্ষ্মীপুরে। আর আসাদুজ্জামানের গ্রামের বাড়ি ঝিনাইদহের ভাদালিডাঙ্গায়। এ ছাড়া বিদেশ থেকে কেমিক্যাল আমদানি করে ৩ কোটি টাকা লাভের প্রলোভন দেখিয়ে গত আগস্ট মাসে রুহুল আমিন নামে এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ৫৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয় প্রতারক এই চক্রটি। একই চক্র শহিদুল ইসলাম নামে এক কাঠ ব্যবসায়ীর কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছে ১২ লাখ টাকা।

যেভাবে শুরু : সিআইডির জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতার তিন প্রতারক জানায়, ২০০৭ সাল থেকে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় তারা প্রতারণা করে আসছিল। টার্গেট করা ব্যক্তির কাছে তারা নতুন নতুন ছদ্মনামে হাজির হয়েছে। প্রতারক চক্রের দলনেতা মাসুদের বাবা পুলিশের সাবেক কনস্টেবল। ইতালিতে নেওয়ার কথা বলে ২০০৭ সালে এক ব্যক্তি মাসুদের কাছ থেকে ৮ লাখ টাকা নেয়। তবে সে বিদেশে যেতে পারেনি। এর পর নিজেই সে প্রতারক দল তৈরি করে। মাসুদের গ্রামের বাড়ি বরিশালের বাবুগঞ্জে। প্রতারণা করে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি সে চারটি বিয়ে করে। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জে একাধিক ফ্ল্যাটসহ দামি গাড়ি এবং ব্যাংক একাউন্টে তার নামে লাখ লাখ টাকা রয়েছে। তার মালিকানায় একটি ইটভাটাও রয়েছে। অন্যদিকে আসাদুজ্জামান ও রেজাউলের স্ত্রীর নামে কেনা দুটি দামি প্রাইভেটকার আদালতের নির্দেশে জব্দ করেছে পুলিশ। আসাদুজ্জামান ও রেজাউলের স্ত্রীর বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং আইনে মামলাও হয়েছে।

আরও পড়ুন

×