ঢাকা মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪

ডাকসু নির্বাচন নেই ২৭ বছর

আর কত আশ্বাস

আর কত আশ্বাস

সাব্বির নেওয়াজ, অমরেশ রায় ও মোশাররফ বাবলু

প্রকাশ: ১০ ডিসেম্বর ২০১৭ | ২১:১৭ | আপডেট: ১১ ডিসেম্বর ২০১৭ | ০৭:১৯

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন হয় না দুই যুগেরও বেশি সময়। গত ২৭ বছরে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৭টি ব্যাচের ছাত্রছাত্রীরা ডাকসু গঠনের জন্য ভোট দেওয়ার সুযোগ পায়নি।

অতীতে অনেক ঐতিহাসিক ছাত্র-গণআন্দোলনের বর্শাফলক যে প্রতিষ্ঠানকে দেশের দ্বিতীয় পার্লামেন্ট ও জাতীয় নেতৃত্ব তৈরির শিক্ষালয় বলে ভাবা হতো, সেই ডাকসু না থেকে দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকেই উপহাস করছে বলে মনে করেন বিশিষ্টজন। আড়াই দশকে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে সাতজন উপাচার্যের মধ্যে বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামানসহ চারজন ডাকসু নির্বাচনের আশ্বাস দিয়েছেন। কেন সব আশ্বাস আটকে যায়, কেন হয় না ডাকসু নির্বাচন, কবে হবে- এ প্রশ্ন দেশকে তোলপাড় করছে। 


'এবারের আশ্বাসের বাস্তবায়ন ঘটবে কি-না' জানতে চাইলে উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান রোববার বিকেলে সমকালকে বলেন, 'আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। আশ্বাসের বাস্তবায়ন দেখতে হলে তো অপেক্ষা করতে হবে।' তিনি আবার আশ্বাস দিয়ে বলেন, 'সবকিছু সমন্বয় করে ডাকসু নির্বাচনের পদক্ষেপ অবশ্যই নেওয়া হবে। তবে সবাইকে বুঝতে হবে, ২৭ বছর নির্বাচন হয়নি। বিষয়টি এত সোজা নয়। ডাকসু নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করে তবে নির্বাচন দিতে হবে। এ জন্য সময় প্রয়োজন।' ডাকসু নির্বাচনের দাবিতে উপাচার্যের বাসভবনেরকাছে ২৫ নভেম্বর থেকে অনশন করছিলেন ওয়ালিদ আশরাফ নামের এক শিক্ষার্থী। শনিবার দুপুরে ডাকসু নির্বাচনের আশ্বাস দিয়ে তাকে অনশন ভাঙান উপাচার্য। তিনি এ নির্বাচনের গুরুত্ব স্ব্বীকার করে বলেন, 'ডাকসুর মাত্র পাঁচজন প্রতিনিধি সিনেটে অংশগ্রহণ করেন। তবে এই সংখ্যাও অগ্রাহ্য করার মতো নয়। তারা যাতে সিনেটে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যাগরিষ্ঠ গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করতে পারেন, সে জন্য ডাকসু নির্বাচন জরুরি।' ছাত্ররাই সংখ্যাগরিষ্ঠ গোষ্ঠী। ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশ অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার  সর্বোচ্চ সংস্থা সিনেটের ১০৫ সদস্যের মধ্যে পাঁচজন শিক্ষার্থী থাকবে, যাদের পাঠাবে ডাকসু। ২৭ বছর ধরে ডাকসু নির্বাচন না হওয়ায় খণ্ডিত সিনেট নিয়েই সভা বসছে। অতি সম্প্রতি উচ্চ আদালত সিনেটকে পূর্ণাঙ্গ করতে বলেছেন।  


কেবলই আশ্বাস : ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যাত্রা শুরুর পর ১৯২৪ সালে ডাকসু প্রতিষ্ঠিত হয়। সর্বশেষ নির্বাচন হয়েছে ১৯৯০ সালের ৬ জুন। বিগত দিনে সামরিক সরকারগুলোর আমলেও নিয়মিত ডাকসু নির্বাচন হয়েছে। গণতান্ত্রিক আমলে এসে ১৯৯১ সালের পর আর ডাকসু নির্বাচন হয়নি। এরই মধ্যে পূর্ণ মেয়াদে (চার বছর) অথবা তার বেশি সময় উপাচার্য ছিলেন অধ্যাপক এ কে আজাদ চৌধুরী, এস এম এ ফায়েজ এবং আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। এ তিনজনই নির্বাচনের আশ্বাস দিয়েছিলেন। জানা গেছে, ১৯৯১ সালের পর প্রথম সাত বছরে তিনবার তফসিল ঘোষণা করেও নির্বাচন দেওয়া যায়নি।  


অধ্যাপক আরেফিন সিদ্দিক ২০০৯ সালে নিয়োগ পাওয়ার পর গণমাধ্যমে ডাকসু নির্বাচনের কথা বললেও তার কার্যকালের সাড়ে আট বছরে একবারও নির্বাচনের উদ্যোগ নেননি।  


১৯৯১ সালের ১৮ জুন নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল। ওই সময় সহিংস ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে উপাচার্য অধ্যাপক মনিরুজ্জামান মিঞা নির্বাচন বন্ধ করে দেন। এরপর উদ্যোগ নিয়েও সম্ভব হয়নি। সর্বশেষ গত শনিবার একই আশ্বাস দিলেন বর্তমান উপাচার্য। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন উঠেছে, আর কত আশ্বাস? 


ডাকসুর জন্য আন্দোলন : ডাকসু সচল করার জন্য গত দুই যুগে ছাত্রদের আন্দোলন গড়ে উঠলেও সেগুলো পরে স্তিমিত হয়ে যায়। সর্বশেষ ২০১২-১৩ সালে 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী অধিকার মঞ্চ' ব্যানারে সাধারণ শিক্ষার্থীরা মানববন্ধন, সাইন ক্যাম্পেইন, সমাবেশ, অবরোধসহ নানা কর্মসূচি পালন করেন। এ সময় তারা একটি জরিপও চালিয়েছিলেন, যাতে প্রায় ৯৫ শতাংশ সাধারণ শিক্ষার্থী ডাকসু সচলের পক্ষে মত দিয়েছিলেন। এরপর গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন শুরু হলে ভাটা পড়ে ডাকসু নির্বাচনের আন্দোলনে। 


এমনকি আচার্য তথা রাষ্ট্রপতির তাগিদ, ছাত্রদের আন্দোলন, উচ্চ আদালতে মামলা- কোনো চাপই নির্বাচনের পথকে প্রশস্ত করতে পারেনি। চলতি বছরের ৪ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫০তম সমাবর্তনে রাষ্ট্রপতি ও আচার্য মো. আবদুল হামিদ ডাকসু নির্বাচন আয়োজন করতে বিশ্ববিদ্যালয়কে জোরালোভাবে নির্দেশ দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, 'ডাকসু ইলেকশন ইজ আ মাস্ট। ডাকসু নির্বাচন না হলে ভবিষ্যৎ নেতৃত্বে শূন্যতার সৃষ্টি হবে।'  


ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠানের নির্দেশনা চেয়ে গত পাঁচ বছরে উচ্চ আদালতে পৃথক দুটি রিট আবেদনও করা হয়েছে। কিন্তু জবাব দেয়নি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ২০১২ সালের ২১ মার্চ হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৫ শিক্ষার্থী। রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ওই বছরের ৮ এপ্রিল হাইকোর্ট রুল দেন। ডাকসুর সাবেক ভিপি সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ ও সাধারণ সম্পাদক মো. মুশতাক হোসেন এবং একজন শিক্ষার্থী গত ১৬ মার্চ হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন, যার ওপর ১৯ মার্চ হাইকোর্টে শুনানি হয়। প্রাথমিক শুনানি নিয়ে সেদিনই আদালত রুল দেন। এগুলোর শুনানি এগোচ্ছে না। 


'কেন ডাকসু নির্বাচন হয় না'- জানতে চাইলে বরেণ্য শিক্ষাবিদ ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী সমকালকে বলেন, 'আমাদের অভিজ্ঞতা হলো, আসলে সরকার চায় না বলেই ডাকসু নির্বাচন হয় না। সরকার ভাবে, নির্বাচন হলে ছাত্রদের মতামত তাদের পক্ষে না-ও যেতে পারে।' 


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক এ এস এম মাকসুদ কামাল সমকালকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশ ভূলুণ্ঠিত হবে না- এমন নিশ্চয়তা মিললে তো নির্বাচন হতে কোনো অসুবিধা নেই। তবে এ জন্য ক্যাম্পাসে ক্রিয়াশীল সব ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মীদের নিয়মিত ছাত্র হতে হবে।  


ছাত্রনেতাদের ভাবনা : ছাত্রলীগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি আবিদ আল হাসান সমকালকে বলেন, ক্যাম্পাসে ক্রিয়াশীল অন্যান্য ছাত্রসংগঠনের মতো তারাও চান ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক। এ নির্বাচন আয়োজনের দায়িত্ব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের। ভিসির আশ্বাসে ছাত্রলীগ আশাবাদী। 


ছাত্রদলের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি আল মেহেদী তালুকদার বলেন, উপাচার্যের কথামতো তফসিল ঘোষণা করা হোক। তিনি বলেন, বুঝতে পারছেন না উপাচার্যের আশ্বাস কি শুধু অনশন ভাঙানোর জন্যই দেওয়া হয়েছে, নাকি সত্যিই নির্বাচন দেওয়া হবে। প্রশাসন প্রায়ই বলে, ডাকসু নির্বাচনের জন্য বিরোধী দলের সংগঠনগুলোর সহযোগিতা দরকার। ছাত্রদলও চায় সহযোগিতা করতে। তবে তার আগে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের অবস্থান নিশ্চিত করা হোক। তার জন্য নতুন কোনো আইন প্রয়োজন নেই। আগে যেমন ছিল, তা ফিরিয়ে আনা হোক। 


ছাত্র ইউনিয়নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি তুহিন কান্তি দাস আগামী জানুয়ারিতে রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট নির্বাচনের আগে ডাকসুর তফসিল ঘোষণা না করা হলে তারা কঠোর আন্দোলনে যাবেন বলে জানান। আগামী বুধবার সন্ত্রাসবিরোধী রাজু ভাস্কর্যে উন্মুক্ত সংলাপের আয়োজন করা হচ্ছে বলেও জানান তুহিন। 


সাবেক ডাকসু নেতাদের বক্তব্য : ডাকসুর সাবেক পাঁচ ভিপি ও দু'জন জিএসের সঙ্গে কথা হয়েছে সমকালের। এ নির্বাচন না হওয়ায় তাদের কথায় ঝরেছে ক্ষোভ। সাবেক ভিপি বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, ডাকসুর অনুপস্থিতিতে সিনেটে ছাত্র প্রতিনিধি না থাকায় বিশ্ববিদ্যালয় কীভাবে চলবে, না চলবে- সে বিষয়ে ছাত্রদের মতামতের পথ বন্ধ। ফলে আইন থাকা সত্ত্বেও বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অপূর্ণতা থেকে যাচ্ছে এবং বিকৃতি ঘটছে। অথচ ডাকসু নির্বাচন হওয়া যে একান্ত আবশ্যক- সামনাসামনি সে কথা নাকচ করার সাহস কেউ রাখেন না। 


ডাকসুসহ দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র সংসদ নির্বাচনগুলো নিয়মিত ও প্রতিবছর হওয়া উচিত বলে মনে করছেন ডাকসুর সাবেক আরেক ভিপি সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ। তিনি বলেন, ডাকসু নির্বাচন না হওয়াটা দেশের রাজনৈতিক প্রক্রিয়া ধ্বংসেরই একটি অংশ।  


সাবেক ভিপি মাহফুজা খানমের মতে, ২৭ বছর ধরে ডাকসু নির্বাচন না হওয়াটা সবার জন্যই অত্যন্ত দুঃখের এবং লজ্জার। তবে এ ক্ষেত্রে সরকার, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও ছাত্রসমাজ- সবারই ব্যর্থতা রয়েছে। তাই সবাইকেই ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে সমানভাবে এগিয়ে আসতে হবে।  


ডাকসুর সাবেক জিএস ও জাসদের একাংশের স্থায়ী কমিটির সদস্য ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ডাকসুকে নিজেদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ কিংবা বিরুদ্ধ পক্ষ মনে করার কারণেই ক্ষমতাসীন সরকারগুলো দীর্ঘদিন ধরে এ নির্বাচন বন্ধ রেখেছে। অথচ তারাও ডাকসু নির্বাচনেরই ফসল। তাই যত দিন পর্যন্ত ক্ষমতাসীনদের শুভবুদ্ধির উদয় না হবে কিংবা তাদের রক্ষণশীল মনোভাবের পরিবর্তন না হবে, তত দিন এই নির্বাচন আদায় করা যাবে না। 


সাবেক ভিপি ও নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, এ নির্বাচনের দাবিতে ২০/২৫ বছর আগেও অনশন হয়েছিল। কিন্তু নির্বাচন আর হয়নি। এবার ডাকসু নির্বাচনের দাবিতে যে ছাত্র অনশন করেছে, তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, নির্বাচন না হলেও অনশন করে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তিনি বলেন, ডাকসু নির্বাচন তখনই হবে, যখন সরকার রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেবে। সরকার কিংবা সরকারি দলের উদ্যোগ ছাড়া উপাচার্যের পক্ষে নির্বাচন দেওয়া সম্ভব নয়। 


ডাকসুর সাবেক ভিপি ও বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সদস্য আমানউল্লাহ আমান সমকালকে বলেন, এ নির্বাচন অবশ্যই হওয়া উচিত। নির্বাচনের আগে হলে হলে ও ক্যাম্পাসে ছাত্রছাত্রীদের সহাবস্থান ও সাংগঠনিক কার্যক্রম স্বাধীনভাবে পরিচালনা নিশ্চিত করার দায়িত্ব ঢাবির উপাচার্যের। ছাত্রছাত্রীদের সহাবস্থান নিশ্চিত হলেই নির্বাচন সম্ভব। 


ডাকসুর সাবেক জিএস ও বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকন সমকালকে বলেন, বিরোধী ছাত্রসংগঠনের পক্ষ থেকে দীর্ঘদিন ধরে ডাকসু নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু নির্বাচন হলে সরকারি দলের ছাত্রসংগঠনের নিশ্চিত পরাজয় হবে। এ জন্যই সরকার নির্বাচন করছে না।

আরও পড়ুন

×