ঢাকা মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪

বিতর্কিত সেই কার্লাইল খালেদার আইনজীবী

ক্ষুব্ধ দলীয় আইনজীবীরাও

বিতর্কিত সেই কার্লাইল খালেদার আইনজীবী

আবু সালেহ রনি

প্রকাশ: ২২ মার্চ ২০১৮ | ১৯:৪৮

ব্রিটিশ আইনজীবী লর্ড আলেকজান্ডার চার্লস কার্লাইলকে খালেদা জিয়ার মামলায় পরামর্শক নিয়োগ দিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে ফের সমালোচনার মুখে পড়েছে বিএনপি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে নীরব থেকে বিভিন্ন সময়ে সমালোচিত হয়েছে দলটি। জামায়াতের লবিস্ট ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কঠোর সমালোচক লর্ড কার্লাইলকে খালেদা জিয়ার আইনজীবী নিয়োগ দেওয়ার পর আবারও দলটির ভূমিকা নিয়ে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠেছে। বিশ্নেষকরা বলছেন, যুদ্ধাপরাধীদের ব্যাপারে জামায়াত ও বিএনপির অবস্থান এক ও অভিন্ন।

সংশ্নিষ্টরা বলছেন, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মামলায় আইনজীবীদের প্রায় সবাই দলটির শীর্ষস্থানীয় নেতা এবং মামলা পরিচালনায়ও তারা ব্যাপক পরিচিত। তা সত্ত্বেও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ইস্যুতে আগে থেকেই বিতর্কিত লর্ড কার্লাইলকে পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার বিষয়টি ভালোভাবে নেননি দলটির অনেক আইনজীবীও। তাদের মতে, বিদেশি আইনজীবী নিয়োগ দেওয়ার প্রয়োজন ছিল না।

অবশ্য বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সমকালকে জানিয়েছেন, লর্ড কার্লাইল ব্রিটিশ লর্ড সভার সদস্য। লন্ডনে দলের শুভাকাঙ্ক্ষীদের পরামর্শ অনুসারে লর্ড কার্লাইলকে আইনি পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এর উদ্দেশ্য কার্লাইলের আইনি পরামর্শ গ্রহণের পাশাপাশি খালেদা জিয়ার মামলাটি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আলোচনায় আনা।

বার কাউন্সিল আইন অনুসারে, বাংলাদেশে কোনো আইনজীবীর মামলা পরিচালনা করতে হলে অবশ্য তাকে এ দেশের নাগরিক হতে হবে। আর আইনজীবী হতে হলে নির্ধারিত ডিগ্রি অর্জনের পর তাকে বার কাউন্সিলে নিবন্ধিত হতে হয়। ফলে এ দেশে এসে তার আইনি লড়াইয়ের সুযোগ নেই।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে ২০১০ সালের ২৫ মার্চ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হলে জামায়াতের লবিস্ট হিসেবে বিচার কার্যক্রম নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে প্রথম প্রশ্ন তোলেন কার্লাইল। একাধিক বিবৃতি দেওয়ার পাশাপাশি যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি ঠেকাতে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে চিঠিও লেখেন তিনি। এর পরও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিচার কার্যক্রম এগিয়ে নেন এবং পরে উচ্চ আদালতের চূড়ান্ত রায় অনুসারে শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসিও কার্যকর করা হয়। এরই এক পর্যায়ে বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে গত বছরের জুলাই মাসে লন্ডনে দেশের শীর্ষ দু'দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সংলাপের আয়োজনও করে একটি সংগঠন। তবে লন্ডনে যাওয়ার পর আয়োজক সংগঠনের নেপথ্যে কার্লাইলের পরিচয় প্রকাশ পেলে আওয়ামী লীগের নেতারা তাতে যোগদান থেকে বিরত থাকেন। তবে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা ওই সংলাপে যোগ দেন। চলমান এই বিতর্কের মধ্যেই খালেদা জিয়ার মামলায় লর্ড কার্লাইলকে নিয়োগ দিয়েছে বিএনপি।

বিশ্নেষকরা বলছেন, লর্ড কার্লাইলের মতো বিতর্কিত ব্যক্তিকে আইনজীবী হিসেবে নিয়োগ দিয়ে বিএনপি ইচ্ছাকৃতভাবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির বিপরীতে অবস্থান নিয়েছে। তাকে আইনজীবী হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হলে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি প্রশ্ন তুলবে এটি বিএনপির অজানা থাকার কথা নয়।

এর আগে খালেদা জিয়ার মামলার বিষয়ে আইনি পরামর্শ নিতে দেশের বিশিষ্ট আইনজীবী ড. কামাল হোসেনেরও দ্বারস্থ হয়েছিলেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। গতকাল এ বিষয়ে জানতে চাইলে ড. কামাল হোসেন সমকালকে বলেন, 'এটি তাদের দলীয় সিদ্ধান্ত। এ ব্যাপারে কথা বলা সমীচীন হবে না।'

বিতর্কিত বিদেশি আইনজীবী নিয়োগ দিয়ে দেশের আইনজীবীদের অপমান করা হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী। তিনি সমকালকে বলেন, 'আমাদের আইনজীবীরা কোনো অংশেই তার থেকে কম যোগ্যতাসম্পন্ন নন। দেশের বিচার ব্যবস্থা নিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে অহেতুক প্রশ্ন তুলতেই এই নাটক মঞ্চস্থ করা হয়েছে। বিএনপি যদি সত্যিকার অর্থে খালেদা জিয়ার ভালো চাইত, তাহলে বিতর্কিত ব্যক্তিকে নিয়োগ দিয়ে জনমনে প্রশ্ন তোলার সুযোগ দিত না।'

বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক সমকালকে বলেন, 'রাজনৈতিকভাবে সিদ্ধান্তটি সুবিবেচনাপ্রসূত হয়নি। সম্ভবত এ সিদ্ধান্ত অনেক দূর থেকে (লন্ডন) নেওয়া হয়েছে। এখানকার বাস্তব অবস্থার সঙ্গে বিষয়টি সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে গভীরভাবে এখানকার পরিবেশ-পরিস্থিতি বিচার-বিশ্নেষণ করা উচিত ছিল।'

লর্ড কার্লাইল আদালতে খালেদা জিয়ার মামলা পরিচালনা করতে পারবেন কি-না- এমন প্রশ্নে শাহদীন মালিক বলেন, 'মামলা পরিচালনার প্রথম শর্তই হলো আইনজীবীকে বাংলাদেশের নাগরিক হতে হবে। লর্ড কার্লাইল বিদেশি হওয়ায় তার সেই সুযোগ নেই। তবে তিনি চাইলে মামলার বিষয়ে মতামত দিতে পারবেন।'

সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ সমকালকে বলেন, লর্ড কার্লাইল জামায়াতের লবিস্ট হিসেবে এ দেশে যুদ্ধাপরাধের বিচার বানচালে নানা তৎপরতা চালিয়েছিল। সেই ব্যক্তিকেই বিএনপি যখন খালেদা জিয়ার মামলায় আইনজীবী নিয়োগ দিয়েছে তখন এটা বুঝতে হবে এখানে অবশ্যই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে রয়েছে। এর মাধ্যমে বিএনপির দলীয় আইনজীবীদের হেয় করা হয়েছে বলেও মনে করেন তিনি।

১৪ দলের মুখপাত্র স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, জামায়াতকে আঁকড়ে ধরার জন্যই লর্ড কার্লাইলকে নিয়োগ করা হয়েছে। তিনি বলেন, 'একাত্তরের ঘাতকদের লবিস্ট ছিল যে, সেই আইনজীবীকে ঢাকায় আনছে খালেদা জিয়ার দল। তার মানে হলো, এখনও খালেদা জিয়া জামায়াতকে ছাড়ে নাই, একাত্তরের ঘাতকদের ছাড়ে নাই।'

একই প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির। তিনি সমকালকে বলেন, 'জামায়াত ও বিএনপির অবস্থান এক ও অভিন্ন। লর্ড কার্লাইলকে দিয়ে জামায়াত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে বহির্বিশ্বে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা চালিয়েছিল, এখন একইভাবে বিএনপিও খালেদা জিয়ার মামলা নিয়ে এ দেশের বিচার ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চায়।'

অবশ্য খালেদা জিয়ার মামলা নিয়ে বহির্বিশ্বে বিএনপি অপপ্রচার চালিয়ে সুবিধা করতে পারবে না বলে মন্তব্য করেছেন সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ওয়ালিউর রহমান। তিনি সমকালকে বলেন, জামায়াত লবিস্ট নিয়োগ করেও এ দেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ করতে পারেনি। যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লা, নিজামী, মুজাহিদ গংয়ের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে, আন্তর্জাতিক মহল থেকেও বিচার প্রক্রিয়া প্রশংসিত হয়েছে। এখন খালেদা জিয়ার মামলায় জামায়াতের লবিস্ট কার্লাইলকে নিয়োগ দিয়ে বিএনপি যেটা চাচ্ছে, সেটাও কোনো দিনও হবে না। কারণ এ দেশের আইন ও আদালতে খালেদা জিয়ার বিচার হয়েছে। সেখানে আন্তর্জাতিক মহলের কিছু করার নেই। বরং খালেদা জিয়ার মামলায় লর্ড কার্লাইলকে নিয়োগ দিয়ে বিএনপি দল হিসেবে দেশবাসীকে হতাশ করছে।

আওয়ামী লীগের আইনবিষয়ক সম্পাদক শ. ম. রেজাউল করিম সমকালকে বলেন, 'খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা তাদের দলীয় নেতাও বটে। লর্ড কার্লাইলকে নিয়োগ দেওয়ার ফলে খালেদা জিয়া ও বিএনপি তাদের নেতাদের ওপর যে আস্থা হারিয়ে ফেলেছে, এটাই প্রতীয়মান হচ্ছে।'

এ ব্যাপারে খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা ও তার আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন সমকালকে বলেন, 'বিদেশি আইনজীবীর কোনো প্রয়োজন নেই। মামলাটি এমন নয় যে বিদেশি পরামর্শক প্রয়োজন হতে পারে।' বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক ও খালেদা জিয়ার আইনজীবী সানাউল্লাহ মিয়া বলেন, 'লর্ড কার্লাইলের নিয়োগের বিষয়ে দলের আইনজীবীদের সঙ্গে কোনো আলোচনা হয়নি। এটি শীর্ষ পর্যায়ের সিদ্ধান্ত। যতটুকু জানি, লর্ড কার্লাইল মামলা পরিচালনা করবেন না। শুধু আইনি পরামর্শ দেবেন।'

আরও পড়ুন

×