শরণার্থী ১৯৭১
পৃথিবীর সাড়া জাগাতে 'টেস্টিমনি অব সিক্সটি'
রাজীব নূর
প্রকাশ: ২৩ মার্চ ২০১৮ | ১৯:৩৭
মাদার তেরেসা লিখেছিলেন, 'আসুন, আমরা স্মরণ রাখি :পাকিস্তানের মানুষ,
ভারতের মানুষ, ভিয়েতনামের মানুষ, যেখানকারই মানুষ হোক, সব মানুষই স্রষ্টার
সন্তান, সবাই তৈরি হয়েছে একই হাতে। এ সমস্যা কেবল ভারতের নয়, গোটা পৃথিবীর।
এ বোঝা পৃথিবীরই বহন করা উচিত।'
একাত্তরের অক্টোবরে অক্সফাম প্রকাশিত 'দ্য টেস্টিমনি অব সিক্সটি'তে দ্য
মিশনারিজ অব চ্যারিটির প্রতিষ্ঠাতা মাদার তেরেসা আরও লিখেছিলেন, 'আমি
পাঁচ-ছয় মাস ধরে শরণার্থীদের মধ্যে কাজ করেছি। আমি এসব শিশু ও
প্রাপ্তবয়স্ককে মরতে দেখেছি। সে কারণেই আমি পৃথিবীকে নিশ্চিতভাবে বলতে
পারি, এই পরিস্থিতিটি কত ভয়াবহ এবং কত জরুরি ভিত্তিতে সাহায্য দরকার। আমার এ
আবেদন সারা পৃথিবীর কাছে এবং পৃথিবীকে অবশ্যই সাড়া দিতে হবে।'
"পৃথিবী সত্যিই সাড়া দিয়েছিল, এমনকি পাকিস্তানঘেঁষা মার্কিন প্রশাসন
পর্যন্ত সাড়া দিতে বাধ্য হয়েছিল' বলে জানালেন মুক্তিযুদ্ধের বিদেশি বন্ধু
জুলিয়ান ফ্রান্সিস। ১৯৭১ সালে ফ্রান্সিসের বয়স ছিল ২৬ বছর। অক্সফামের ত্রাণ
তৎপরতা সমন্বয়ের দায়িত্ব ছিল তার। ভারতের ত্রিপুরা, মেঘালয়, আসাম,
কোচবিহার, জলপাইগুড়ি, শিলিগুড়ি, পশ্চিম দিনাজপুর, বারাসাত ও বনগাঁয় অবস্থিত
৫০টির বেশি শিবিরে প্রায় পাঁচ লাখ শরণার্থীকে সহায়তা দিয়েছিল অক্সফাম।
সমকালের সঙ্গে আলাপে জুলিয়ান বলেন, 'আমরা পরের কয়েক মাসের হিসাব, এরপর
আমাদের কতটা অর্থের প্রয়োজন হবে, তা আগেই ঠিক করে রাখতাম। ১৯৭১ সালের
সেপ্টেম্বর মাসে আমরা হিসাব কষছিলাম, আগামী মাসগুলোতে শরণার্থীদের সহায়তায়
আমাদের কতটা অর্থ ব্যয় হতে পারে। তখন শীত আসি-আসি করছে। আমরা জানতাম, কিছু
কিছু এলাকায় শীত খুব তীব্র হতে পারে। এই সময়ে প্রতি মাসেই আমাদের বড় অঙ্কের
টাকার প্রয়োজন ছিল। কোনো মানবিক সংকটের খবর যখন পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায়
চলে আসে, তখন মানুষের কাছ থেকে টাকা তুলে অক্সফাম তহবিল গঠন করতে পারে,
কিন্তু সংকটটি কত দিন চলবে, সেই সম্পর্কে যদি কোনো ধারণাই না থাকে, তাহলে
মানুষকে সে বিষয়ে আগ্রহী করে তোলা খুবই কঠিন। অক্সফামের তহবিল সংগ্রহের
চেষ্টাও মাঝেমধ্যে কঠিন হয়ে পড়ত। একাত্তরে বিশ্বের বড় দৈনিকগুলোর প্রথম
পৃষ্ঠায় শরণার্থীদের সংকট নিয়ে অনেক প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। ২৫ মার্চের
গণহত্যার খবর, মে-জুন মাসে শরণার্থী শিবিরে কলেরা ছড়িয়ে পড়ার খবর প্রথম
পৃষ্ঠায় বড় বড় শিরোনামে ছাপানো হয়। এরপর বর্ষাকালে শরণার্থী শিবিরগুলো ডুবে
গেলে আবারও প্রথম পৃষ্ঠায় শিরোনাম হয়। সেপ্টেম্বরে ব্রিটিশ সংবাদপত্রগুলো
'মৃত্যুর মিছিল', 'শরণার্থীরা কখনও বাড়ি যেতে পারবে কি', 'বায়াফ্রা থেকে
পাকিস্তানি দুর্ভিক্ষ শোচনীয়'- এ রকম নানা শিরোনাম করেছিল এবং আমাদের ত্রাণ
সংগ্রহও ভালো হয়েছিল।"
জুলিয়ান জানান, পত্র-পত্রিকার খবরের জন্য তারা শুধু বসে থাকেননি।
সমান্তরালে নিজেরাও প্রচার করছিলেন। শীত যখন আসি-আসি করছে, তখন কম্বল ও গরম
কাপড় সংগ্রহের জন্য অক্সফাম প্রচারের স্লোগান করে 'আপনার বিছানা থেকে একটি
কম্বল আমাদের দিন', 'এই ক্রিসমাসে নতুন একটি সোয়েটার কিনুন, আর পুরনোটি
অক্সফামকে দিন'। ব্রিটিশ ডাক বিভাগ তাদের সংগ্রহ করা কম্বল ও গরম কাপড়গুলো
ভারতে পাঠানোর জন্য কোনো ফি নেয়নি। অক্সফামের পক্ষ থেকে অনুরোধ করা হলে
রয়েল এয়ারফোর্সও বিনা মাশুলে ত্রাণসামগ্রীগুলো কলকাতায় পৌঁছে দিয়েছে।
জুলিয়ান জানান, তবু তারা ভাবতে থাকেন, কী করে বাংলাদেশের উদ্বাস্তু
সমস্যাটি সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়। তখনই একটি ভাবনা আসে
তাদের মাথায়। ওই ভাবনা থেকেই যারা সরাসরি এই শরণার্থী শিবিরের মর্মন্তুদ
দৃশ্য দেখেছেন, তাদের যুক্ত করে পরিকল্পনা করা হয় 'দ্য টেস্টিমনি অব
সিক্সটি অন দ্য ক্রাইসিস ইন বেঙ্গল' বা বাঙালির সংকটে ৬০ জনের সাক্ষ্য।
অক্সফোর্ডে অক্সফামের প্রধান কার্যালয়ের এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার পেছনে ছিল,
পূর্ব পাকিস্তানে মানবিক বিপর্যয় ও সংকট সম্পর্কে বিশ্বনেতাদের জানানো।
যাদের সাক্ষ্য নিয়ে এই প্রকাশনা করার পরিকল্পনা গৃহীত হয়, তাদের মধ্যে যারা
ভারতে ছিলেন, তাদের সাক্ষ্য সংগ্রহের দায়িত্ব পড়ে জুলিয়ানের ওপর। জুলিয়ান
বলেন, 'আমার মনে আছে, একদিন কয়েকজনের লেখা নিয়ে একটি টেলেক্স আমি অক্সফামের
প্রধান কার্যালয়ে পাঠিয়েছিলাম, যাতে সময় লেগেছিল ৭৫ মিনিট।'
অক্সফাম-ইউকের সেই সময়কার পরিচালক এইজ লেসলি কার্কলি, সিবিই স্বাক্ষরিত
'দ্য টেস্টিমনি অব সিক্সটি' প্রকাশিত হয় অক্টোবরে, স্বাক্ষরের নিচে তারিখ
ছিল ২১ অক্টোবর ১৯৭১। এই প্রামাণ্য দলিলে মার্কিন সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি
শরণার্থী শিবিরগুলোতে তার সফরের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন 'মোজাইক অব
মিজারি' শিরোনামে। তিনি লিখেছিলেন, 'পূর্ব পাকিস্তানের বিয়োগান্তক
পরিস্থিতি কেবল পাকিস্তানের বিপর্যয় নয়। এটা কেবল ভারতের জন্য বিপর্যয় নয়।
এই মর্মন্তুদ পরিস্থিতি সারাবিশ্বের জন্য বিপর্যয়ের। বিশ্ব সম্প্রদায়ের
দায়িত্ব হবে একসঙ্গে এই সংকট মোকাবেলা করা।' যদিও যুদ্ধে পাকিস্তানকে
জোরালো সমর্থন দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র, সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি 'টেস্টিমনি অব
সিক্সটি' মার্কিন সিনেটের নজরে আনেন এবং ২৮ অক্টোবর 'কংগ্রেশনাল রেকর্ডে'
এটি প্রকাশিত হয়। এর আগেই 'টেস্টিমনি অব সিক্সটি' ওই বছর জাতিসংঘের সাধারণ
পরিষদে সব রাষ্ট্রদূতের মধ্যে বিলি করা হয়েছিল। এ ছাড়া বিভিন্ন
রাষ্ট্রপ্রধানের কাছেও ডাকে পাঠানো হয়েছিল এটি।
মার্কিন নীতি পাকিস্তানঘেঁষা হলেও শুরু থেকেই বাংলাদেশের পক্ষে ছিল তাদের
জনমত। সিনেটে শরণার্থী বিষয়ে গঠিত সাব-কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন সিনেটর
এডওয়ার্ড কেনেডি। তিনি ৩ মে সিনেটে দেওয়া এক দীর্ঘ ভাষণে বাংলাদেশের
শরণার্থীদের মানবিক সাহায্য দেওয়ার আবেদন জানিয়েছিলেন। এরপর কেনেডি আগস্ট
মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে ভারত সফর করেন এবং পাঁচ দিন পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরাসহ
অন্যান্য রাজ্যে শরণার্থী শিবির পরিদর্শন শেষে শরণার্থীদের অবস্থাকে
'সর্ববৃহৎ মানবিক ট্র্যাজেডি' হিসেবে আখ্যায়িত করেন, যা 'দ্য টেস্টিমনি অব
সিক্সটি'তে প্রকাশিত তার লেখায়ও পুনর্ব্যক্ত করেন। কেনেডি শরণার্থীদের
ত্রাণ কার্যক্রমের জন্য ৪০০ মিলিয়ন ডলারের বরাদ্দ চেয়ে বিল উত্থাপন করেন
এবং জনমতের চাপে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সন শেষ পর্যন্ত ২৫০ মিলিয়ন ডলার
বরাদ্দ করতে বাধ্য হন।
'দ্য টেস্টিমনি অব সিক্সটি'তে সাক্ষ্যদানকারী ষাটজনের আরও অনেকে তখনই
খ্যাতিমান ছিলেন এবং অনেকে পরবর্তীকালে নিজ নিজ পেশায় তাদের অবদানের জন্য
সুপরিচিত হন। জুলিয়ান ফ্রান্সিস বিশেষভাবে স্মরণ করেন সাংবাদিক জন পিলজার,
নিকোলাস টোমালিন ও ক্লেয়ার হোলিংওয়ার্থের কথা। এই হোলিংওয়ার্থ দ্বিতীয়
বিশ্বযুদ্ধের সময়েই রিপোর্টার হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। ষাট
সাক্ষ্যদানকারীর মধ্যে আরও ছিলেন মাইকেল ব্রানসন, ক্লদ মুস, ফ্রেডরিক নসাল,
জন পিলজার, পিটার ডান প্রমুখ।
সানডে টাইমসের আলোকচিত্রী পিটার ডান লিখেছিলেন, 'আমি মুহ্যমান। এই আমি, বহু
বছর ধরে পৃথিবীর সব দুর্যোগকবলিত এলাকা সরেজমিন দেখে আসছি, এখানে আমি
একেবারে মুহ্যমান। নিজের তোলা ছবি যত ভয়ঙ্করই হোক, একজন আলোকচিত্রী সাধারণত
নিজেকে বলে থাকে, ভালো কিছু পেয়েছি। কিন্তু বাংলায় এই প্রবোধের মহৌষধ
আমাকে প্রত্যাখ্যান করেছে। আমি সম্পূর্ণভাবে, চূড়ান্তরূপে অসম্পূর্ণ বোধ
করতে শুরু করেছি। আসলে যখনই আমার সময় হতো, ক্যামেরা ফেলে আমি ওয়ার অন
ওয়ান্ট দলের সঙ্গে বেরিয়ে মানুষকে কলেরার প্রতিষেধক ইনজেকশন দিতে সাহায্য
করতাম।'
আগামীকাল :'যুদ্ধ মৃত্যু তবু স্বপ্ন'
- বিষয় :
- শরণার্থী ১৯৭১