ঢাকা মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪

শরণার্থী ১৯৭১

'যুদ্ধ মৃত্যু তবুও স্বপ্ন'

'যুদ্ধ মৃত্যু তবুও স্বপ্ন'

অনিশ্চিত শরণার্থী জীবনের পথে- সংগৃহীত

রাজীব নূর

প্রকাশ: ২৪ মার্চ ২০১৮ | ২১:২২

ঢেঁকিতে চলছে ধান ভানা। হাসি হাসি মুখে ধান ভানছে এক কিশোরী। ১৯৭১ সালে এমনটাই ছিল বাংলার গ্রামীণ জনপদের স্বাভাবিক চিত্র। অকস্মাৎ ঢেঁকির শব্দকে ছাপিয়ে শোনা গেল গুলির শব্দ, বুটের আওয়াজ ও মানুষের চিৎকার। এভাবেই শুরু হয় জহির রায়হানের তথ্যচিত্র 'স্টপ জেনোসাইড'; এটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রথম চলচ্চিত্র। 


একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে জহির রায়হান দুনিয়ার মানুষকে বাংলাদেশে চলতে থাকা গণহত্যার খবর জানান দেওয়ার জন্যই নির্মাণ করেছিলেন 'স্টপ জেনোসাইড'। বাংলাদেশের ওপর চাপিয়ে দেওয়া গণহত্যা এবং পাকিস্তানিদের চালানো হত্যাযজ্ঞ থেকে প্রাণে বাঁচার জন্য ভারতে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীদের কথা বলা হয়েছে ওই তথ্যচিত্রে। দেখানো হয়েছে সীমান্তের দিকে মানুষের ঢল। আতঙ্কিত মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে, দিনের পর দিন হেঁটে, শুধু বেঁচে থাকার আশায় ছুটে চলেছে। আশ্রয় শিবিরে মানুষের তীব্র কষ্ট ও দুর্ভোগের চিত্র এবং শরণার্থীদের সাক্ষাৎকার, তাদের মন্তব্য দেখতে পাই আমরা। ভুলে যাওয়া অসম্ভব তথ্যচিত্রে দেখা সেই কিশোরীকে, যার বাবা, ভাই ও কাকাকে হত্যা করেছে পাকিস্তানি সেনারা। গণধর্ষণের শিকার কিশোরীটি যেন হয়ে গেছে মূক ও বধির। 


'স্টপ জেনোসাইড' একটি প্রচারধর্মী তথ্যচিত্র। বাংলাদেশে তখন যে গণহত্যা ঘটে চলেছে, তার বিরুদ্ধে বিশ্বজনমত গড়ে তোলা এবং বিশ্বের মনোযোগ আদায় করার চেষ্টাই এর উদ্দেশ্য। গণহত্যা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ভারতে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীদের কারণেই বিশ্বের মনোযোগ আদায় করা সম্ভব হয়েছিল। শরণার্থীরাই দেশের অভ্যন্তরে কী ঘটে চলেছে, তা জানিয়েছে বিশ্ববাসীকে। যদিও আমেরিকার নীতি ছিল পাকিস্তানঘেঁষা, শরণার্থীদের কথা জানার পর সেখানকার জনমতও তৈরি হয়েছিল বাংলাদেশের পক্ষে। জর্জ হ্যারিসন ও রবিশঙ্করের আহ্বানে বাংলাদেশের শরণার্থীদের সাহায্যার্থে ম্যাডিসন স্কয়ারে অনুষ্ঠিত হয়েছিল 'কনসার্ট ফর বাংলাদেশ'। আমেরিকান কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ সরেজমিন ঘুরতে এসেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তে; যশোর রোডের শরণার্থী শিবির ঘুরে গিয়ে লিখলেন 'সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড'। গিন্সবার্গের কান্নাকাতর আহ্বান- 'যুদ্ধ মৃত্যু তবুও স্বপ্ন/ ফসলের মাঠ ফেলে আসা সুখ/ কার কাছে বলি ভাত রুটি কথা/ কাকে বলি কর কর কর ত্রাণ/ কাকে বলি ওগো মৃত্যু থামাও/ মরে যাওয়া বুকে এনে দাও প্রাণ।'


একাত্তরের ওই সেপ্টেম্বরে যুদ্ধ কবে থামবে, তা অনুমান করা অসম্ভব ছিল বলে জানালেন মুক্তিযুদ্ধের বিদেশি  বন্ধু জুলিয়ান ফ্রান্সিস। সমকালের সঙ্গে আলাপে তিনি বলেন, '১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আমরা হিসাব কষছিলাম, আগামী মাসগুলোতে শরণার্থীদের সহায়তায় আমাদের কতটা অর্থ ব্যয় হতে পারে। তবে আর কয় মাস পর এই যুদ্ধ শেষ হবে- তখন তা অনুমান করা কঠিন ছিল।' 


দিনাজপুরের নিয়ামত আলী খোকনদের পরিবারের কয়েকজন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরপরই চলে গিয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার শান্তিপুরে। খোকনের মাসহ বাকিরা কক্সবাজারে বেড়াতে গিয়ে আটকা পড়েন। কক্সবাজারে ওয়াপদার একজন প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত ছিলেন তার দুলাভাই। বড় বোনের মেয়ের জন্ম হয় যুদ্ধের কয়েক মাস আগে। ভাগ্নিকে দেখতে গিয়েছিলেন তাদের মা। বর্তমানে একটি আন্তর্জাতিক সংস্থায় কর্মরত নিয়ামত আলী খোকন বলেন, 'মায়ের উৎকণ্ঠার কারণে যশোর থেকে এক আত্মীয়  গিয়েছিলেন আমাদের খুঁজতে। তার কাছেই আমরা খবর পেলাম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় মায়ের অবস্থা খুবই খারাপ। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর মা রোজা রাখতে শুরু করেছিলেন এবং বিজয়ের আগ-পর্যন্ত রোজা রাখা বন্ধ করেননি।' 


ভারতে আশ্রয় নেওয়া খোকনদের পরিবারের সদস্যরা দেশে ফিরতে চাননি। পরে আবারও সেপ্টেম্বরে ওই আত্মীয় শান্তিপুরের আশ্রয়ে গেলে তারা দেশে ফিরে আসেন। চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা হয়ে যশোরে আসার পথে সৈন্যরা তাদের ধরে নিয়ে লাইনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। আরেকবার ভুল করে এক রাজাকারের বাড়িতেই আশ্রয় নিয়ে ফেলেছিলেন তারা। রাজাকারটি যখন পাকিস্তানি ক্যাম্পে খবর দিতে যায়, তখন পাশের বাড়ির এক মহিলা তাদের তা জানিয়ে দেয় এবং দ্রুত পালিয়ে গিয়ে রক্ষা পান তারা। পরে যশোর থেকে বিমানে ঢাকায়, ঢাকা থেকে বিমানেই যান চট্টগ্রাম এবং সেখান থেকে তার দুলাভাই গাড়িতে করে তাদের নিয়ে যান কক্সবাজারে। যুদ্ধের একেবারে শেষদিকে যখন মিত্রবাহিনীর বোমাবর্ষণ শুরু হয়েছে বিভিন্ন এলাকায় তখন কক্সবাজার থেকেও পালাতে হয়েছিল। মহেশখালীর বদরখালী হয়ে ইলিশিয়া নামে একটি গ্রামে আশ্রয় নিয়েছিলেন তারা। যুদ্ধের বাকি সময়টা অভ্যন্তরীণ শরণার্থী হিসেবে কেটেছে তাদের দিন। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে নিজেদের বাড়ি দিনাজপুরে ফিরতে ১৯৭২ সালের মার্চ পর্যন্ত সময় লেগেছিল। যুদ্ধের সময় সদ্য ইন্টারমিডিয়েট পাস করা নিয়ামত আলী খোকনের করা নকশাতেই ১৯৭২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির সময় কক্সবাজারে একটি শহীদ মিনার নির্মিত হয়েছিল, যে স্মৃতি তাকে এখনও আপ্লুত করে। 


মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি, লেখক ও গবেষক মফিদুল হক বলেন, 'একাত্তরে ভারতে আশ্রয় নেওয়া প্রায় এক কোটি শরণার্থী ছাড়াও অভ্যন্তরীণ শরণার্থীর সংখ্যা ছিল দুই কোটিরও বেশি। পাকিস্তানের দালাল রাজাকার-আলবদরদের পরিবার ছাড়া এমন পরিবার খুঁজে পাওয়া দুস্কর, যুদ্ধের দিনগুলোতে যাদের একবারও অন্য কোথাও পালাতে হয়নি।'


'শরণার্থী ৭১' বইয়ের লেখক সুখেন্দু সেন বলেন, 'শরণার্থীদের যারা ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন, তাদেরও বেশিরভাগ প্রথমে দেশের অভ্যন্তরে থাকার চেষ্টা করেছেন। শিবিরে আশ্রয় গ্রহণের পরও যুদ্ধে গেছেন অনেকে এবং অনেকে আবার যুদ্ধে আহত হয়ে শিবিরে ফিরে এসেছেন, যেমনটা এসেছিলেন সুনামগঞ্জের যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা হরেন্দ্র তালুকদার।' 


সমকালের সঙ্গে আলাপে হরেন্দ্র তালুকদার বলেন, তারা চার বন্ধু যাচ্ছিলেন যুদ্ধে যোগ দেবেন বলে। সেটা একাত্তরের এপ্রিলের শেষ অথবা মে মাসের শুরু দিককার ঘটনা। এর আগপর্যন্ত দেশের অভ্যন্তরেই নানান জায়গায় পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন। যুদ্ধে যোগ দিতে যাওয়া চারজনের মধ্যে তিনিই ছিলেন কনিষ্ঠ। ওই বছরই তার ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল। সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জের নয়াহালট দিয়ে সুরমা নদী পেরোনোর সময় ছোট নৌকা দেখে হরেন্দ্র দ্বিতীয় দফায় নদী পার হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। এই এক সিদ্ধান্তের কারণে তিনি এখনও বেঁচে আছেন। বাকি তিনজনের সবাই ওপারে গিয়েই রাজাকারদের হাতে ধরা পড়েন। তাদের মধ্যে মহেন্দ্র দাসের স্ত্রী ছিলেন সন্তানসম্ভবা। পরে মহেন্দ্রর স্ত্রীর সঙ্গে হরেন্দ্র তালুকদারের দেখা হয়েছিল মেঘালয়ের মৈলাম শরণার্থী শিবিরে; যুদ্ধে আহত হওয়ার পর হরেন্দ্র শিলং থেকে চিকিৎসা নেওয়ার পর এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন ওই শিবিরে। মৈলামের ওই শিবিরেই মহেন্দ্রর একটি ছেলে হয়। ওই ছেলেটিই এখন একজন স্কুল শিক্ষক। আহত হয়ে শিবিরে আটকা পড়া জীবন ছিল দুঃসহ। শিবিরের এক ঘরে হয়তো মরা কান্না চলছে, অন্য ঘরে তখন বিয়ে হচ্ছে। আহত হরেন্দ্র ভাবতেন- আবার কবে যুদ্ধে যেতে পারবেন? কবে দেশ স্বাধীন হবে, কখন ফিরে যেতে পারবেন? 


সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার পল্লী উন্নয়ন কর্মকর্তা সৌরভ ভূষণ দেব বলেন, নিজের ভিটা, পেশা, পরিবেশ ছেড়ে অপমানজনক যে উদ্বাস্তু জীবন বেছে নিতে হয়েছিল, তা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার স্বপ্নে প্রতিটি মুহূর্ত কাটত শরণার্থীদের। যুদ্ধকালীন ৯ বছর বয়সের ওই দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে সৌরভ বলেন, 'যখন যুদ্ধের পরিণতি অনিশ্চিত ছিল তখনও যেমন বাড়ি ফেরার আকুলতা ছিল, নভেম্বরের মধ্যভাগ থেকে সংশয়ের দোলাচল কাটা শুরু হয়ে ডিসেম্বরে এসে যখন বিজয় বিষয়ে স্থির বিশ্বাস তৈরি হয়; তখনও বাড়ি ফেরার একই আকুলতা কাজ করেছে। ১০ ডিসেম্বর মুক্ত হয় সুনামগঞ্জ।

শুরু হয় দেশে ফেরার প্রস্তুতি। দেরি আর সইছিল না। ১০ ডিসেম্বরের পর একদিন বাবা একা সুনামগঞ্জ থেকে ঘুরে আসলেন। বাবার কাছ থেকে জানলাম, আমাদের বাসাটি যারা দখল করেছিল তারা পালিয়েছে। সুনামগঞ্জ থেকে এসেই সবাইকে নিয়ে ফেরার তোড়জোড় শুরু করে দিলেন। যেহেতু নিবন্ধিত শরণার্থী তাই একটু দেরি হলো। অবশেষে মৈলাম ডেভেলপমেন্টের অ্যাসিস্ট্যান্ট রিলিফ অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন অফিসারের স্বাক্ষরিত ছাড়পত্র মিলল ৭ জানুয়ারি ১৯৭২ তারিখে। এ যেন আমাদের মুক্তির ছাড়পত্র, কলঙ্ক মোচনের সনদ। পরদিনই ৮ জানুয়ারি আমরা সপরিবারে সুনামগঞ্জ ফিরে আসলাম। মৈলাম থেকে সুনামগঞ্জ শহরের দূরত্ব ২০ কিলোমিটারের কম হবে না। দুপুরের মধ্যেই বাসায় ফিরলাম। বাসায় ঢোকার আগেই আমার মায়ের চোখ দিয়ে জল ঝরতে শুরু করল। কান্না আটকে রাখতে পারেননি তিনি। এ কান্না কষ্টের নয়, কষ্টমুক্তির। আমরা ভাইবোনেরা কিন্তু কান্নার ধারেকাছে দিয়েও গেলাম না। আমরা তখন অনেকটা বিস্ময়-ভরা চোখ দিয়ে সবকিছু দেখছিলাম। শহরে ঢোকার পর পথে পথে মুক্তিযোদ্ধাদের চেকপোস্ট, পুড়িয়ে দেওয়া ঘরবাড়ি, দোকানপাট, বাসাভর্তি আগাছা, ঘরের ভেতরের বাঙ্কার; সবকিছুই আমাদের কাছে নতুন লাগছিল।' (শেষ)

আরও পড়ুন

×