ঢাকা মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪

গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি কবে

থমকে গেছে উদ্যোগ

গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি কবে

ফাইল ছবি

আবু সালেহ রনি

প্রকাশ: ২৪ মার্চ ২০১৮ | ২১:৩৩ | আপডেট: ২৬ মার্চ ২০১৮ | ১৫:০৩

একাত্তরের ২৫ মার্চের কালরাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বর্বরোচিত ও নৃশংস হত্যাকাণ্ডকে জাতীয়ভাবে 'গণহত্যা দিবস' পালন করা হলেও এর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের উদ্যোগ থমকে আছে। গত বছর সংসদে গণহত্যা দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরপরই এর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের প্রস্তাব জাতিসংঘে উত্থাপনের ঘোষণা দিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীসহ সরকারের নীতিনির্ধারকরা। তবে তাদের সে ঘোষণা এখনও আলোচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে আজ রোববার দ্বিতীয়বারের মতো জাতীয়ভাবে পালিত হচ্ছে গণহত্যা দিবস।


গত বছরের ১১ মার্চ সংসদে সর্বসম্মতভাবে ২৫ মার্চকে 'গণহত্যা দিবস' ঘোষণা করা হয়। সংসদে উত্থাপিত প্রস্তাবে বলা হয়, 'সংসদের অভিমত এই যে, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে বর্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক সংঘটিত গণহত্যাকে স্মরণ করে ২৫ মার্চকে গণহত্যা দিবস ঘোষণা করা হোক এবং আন্তর্জাতিকভাবে এ দিবসের স্বীকৃতি আদায়ে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ করা হোক।' 


পরে গত বছরের মার্চেই জাতিসংঘে ২৫ মার্চের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে প্রস্তাব উত্থাপনের ঘোষণা দেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী ও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীসহ অনেকে। তবে এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। অন্যদিকে জাতিসংঘের এক ঘোষণা অনুসারে ২০১৫ সাল থেকে ৯ ডিসেম্বর বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস পালিত হয়ে আসছে। 


এ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি কি সম্ভব? মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক অবশ্য আশাবাদী। তিনি সমকালকে বলেন, ৯ ডিসেম্বর বিশ্বব্যাপী গণহত্যা দিবস পালিত হচ্ছে। অথচ যে দিন আন্তর্জাতিকভাবে এ দিবসটি পালিত হয়, তার পেছনের কোনো ইতিহাস নেই। এ জন্য বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এটা পরিবর্তন করে ২৫ মার্চে করার জন্য আমাদের যেসব যুক্তি ও তথ্য-উপাত্ত রয়েছে, সেগুলো জাতিসংঘে তুলে ধরা  হবে। এরই মধ্যে মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যার তথ্য-উপাত্ত নিয়ে আমরা ডকুমেন্টারি তৈরি করেছি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিভিন্ন দূতাবাসের মাধ্যমে এ বিষয়ে কাজ  করছে। পরিস্থিতি যখন আমাদের অনুকূলে আসবে অর্থাৎ জাতিসংঘে ভোট হলে ফল আমাদের পক্ষে আসবে, তখনই প্রস্তাব উপস্থাপন করা হবে। 


তবে মন্ত্রীর এই বক্তব্যের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করেছেন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির। 


তিনি সমকালকে বলেন, ২০১৫ সালের ১১ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত ১৯৩টি দেশ ৯ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস পালনের জন্য সর্বসম্মত ভোট দিয়েছিল, সেখানে বাংলাদেশও ছিল। এখন সেই বাংলাদেশ যদি তিন বছর পর ৯ ডিসেম্বরের পরিবর্তে ২৫ মার্চকে আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস পালনের জন্য জাতিসংঘে প্রস্তাব করে, তা মোটেই কার্যকর হবে না। এ জন্য বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্যর্থতাকেই দায়ী করছেন তিনি। 


এই অনিশ্চয়তার মধ্যে ২৫ মার্চের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায় করা সম্ভব কি-না, এমন প্রশ্নে মুক্তিযুদ্ধ গবেষক শাহরিয়ার কবির বলেন, "গত বছর সংসদে ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস পালনের পাশাপাশি জাতিসংঘে এ বিষয়ে প্রস্তাব উত্থাপনের সর্বসন্মত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। দুঃখের বিষয়, গত এক বছরে দৃশ্যত কোনো উদ্যোগই গ্রহণ করেনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। একটি দিবস (৯ ডিসেম্বর) ইতিমধ্যে বিশ্বব্যাপী পালিত হচ্ছে। এ জন্য বাংলাদেশ সরকারের উচিত 'একাত্তরে বাংলাদেশে গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি'- এই এজেন্ডা নিয়ে জাতিসংঘে প্রস্তাব উত্থাপন করা এবং সেটি দ্রুত করতে হবে। নয়তো বাংলাদেশ এ বিষয়ে কূটনীতিতে আরও পিছিয়ে যাবে।"


অবশ্য কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে ৯ ডিসেম্বরের পরিবর্তে ২৫ মার্চ আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি আদায় করা সম্ভব বলে মন্তব্য করেছেন সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ও কূটনীতিক ওয়ালিউর রহমান। 


তিনি সমকালকে বলেন, জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত প্রতিটি দেশকে বাংলাদেশের পক্ষে ভোটের জন্য প্রস্তাব দিতে হবে। এটি জোরালো হলে যুক্তিসঙ্গত দাবি আদায় করা যাবে। কারণ রুয়ান্ডা, আর্মেনিয়া, যুগোস্লাভিয়াসহ বিশ্বে যেসব দেশে গণহত্যা হয়েছে, তার মধ্যে একাত্তরে বাংলাদেশে পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরতা জঘন্যতম। ২৫ মার্চ যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে অসংখ্য ঘুমন্ত বাঙালিকে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। গণহত্যাসহ ৩০ লাখ শহীদের তথ্য-উপাত্ত সঠিকভাবে জাতিসংঘে উপস্থাপন করা হলে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায় করা অসম্ভব কিছু নয়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই স্বীকৃতি আদায়ে কাজ করছে বলেও জানান তিনি। 


এর আগে গত বছরের মার্চে গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির প্রস্তাব জাতিসংঘে উত্থাপনের ঘোষণা দিয়েছিলেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। তিনি বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক সমকালকে বলেন, 'অনানুষ্ঠানিকভাবে আন্তর্জাতিক ফোরামে গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির বিষয়ে আলাপ-আলোচনা হয়েছে। এটি চলমান থাকবে।'


অনুসন্ধানে জানা যায়, গত কয়েক দশকে মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের জন্য মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটিসহ বিভিন্ন সংগঠন তাদের উদ্যোগে আন্তর্জাতিক ফোরামে দাবি জানিয়ে আসছে। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি ২০০৭ সালে প্রথম ২৫ মার্চকে আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবসের স্বীকৃতি চেয়ে জাতিসংঘে চিঠি দেয়। পরে ওই চিঠির ধারাবাহিকতায় ২০১৫ সালের মার্চে জাতিসংঘ থেকে পাল্টা চিঠি দিয়ে বাংলাদেশে দিবসটি কীভাবে পালন করা হয় এবং এ-সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত পাঠানোর জন্য বলা হয়েছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে নির্মূল কমিটির পক্ষ থেকে তখন জাতিসংঘের সংশ্নিষ্ট দপ্তরকে জানানো হয়, বাংলাদেশে এখনও দিবসটি ঘোষণা হয়নি। তবে বিভিন্ন সংগঠন ও সাধারণ মানুষ গণহত্যায় শহীদদের স্মরণে নানা কর্মসূচি পালন করে থাকে।


শাহরিয়ার কবির বলেন, "এটি খুবই বিব্রতকর ছিল। তারা যখন বলল- 'তোমার দেশেই দিবসটি স্বীকৃতি পায়নি, সেখানে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি কেন দিতে হবে।' পরে বিষয়টি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানানো হলে তারাও কোনো উদ্যোগ নেয়নি। বরং ওই বছরের ১১ সেপ্টেম্বর যখন ৯ ডিসেম্বরকে আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবসের ঘোষণা দেওয়া হয় তখন সেই প্রস্তাবে সমর্থন দিয়েছিল বাংলাদেশ।"


বাংলাদেশের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি না থাকলেও বিশ্বব্যাপী পাকিস্তানি বর্বরতার বিষয়টি স্বীকৃত। যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, আর্জেন্টিনা, হংকং, পোল্যান্ডসহ বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত আছে। একাধিক বিদেশি গবেষকও একাত্তরের গণহত্যা নিয়ে গবেষণা করছেন। দেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজ নামে একটি কোর্স চালু করা হয়েছে। এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরও বছরব্যাপী গণহত্যাবিষয়ক বিভিন্ন ধরনের সংক্ষিপ্ত কোর্স ও আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করে থাকে।


১৯৪৮ সালে গৃহীত জাতিসংঘের কনভেনশন অন দ্য প্রিভেনশন অ্যান্ড পানিশমেন্ট অব দ্য ক্রাইম অব জেনোসাইডে গণহত্যার পাঁচটি বৈশিষ্ট্যের কথা বলা রয়েছে। প্রথমত, কোনো গোষ্ঠীর মানুষকে হত্যা; দ্বিতীয়ত, তাদের শারীরিক ও মানসিকভাবে চরম ক্ষতিসাধন; তৃতীয়ত, জীবনমানের প্রতি আঘাত ও শারীরিক ক্ষতিসাধন; চতুর্থত, জন্মদান বাধাগ্রস্ত করা এবং পঞ্চমত, শিশুদের অন্য গোষ্ঠীর হাতে তুলে দেওয়া। এই পাঁচটি উপাদানের কোনো একটি থাকলেই কোনো ঘটনা গণহত্যা হিসেবে চিহ্নিত হবে। 


বিশ্বব্যাপী উনিশ শতক থেকে নৃশংস গণহত্যার মধ্যে রয়েছে- আর্মেনীয় গণহত্যা, হলোকাস্ট ও ন্যানকিং গণহত্যা, কম্বোডীয় গণহত্যা, একাত্তরের ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চলাইটের নামে বাঙালি গণহত্যা, বসনীয় গণহত্যা, বেলজিয়ামের রাজা লিওপোল্ডের গণহত্যা এবং সর্বশেষ মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা। তবে এর মধ্যে বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) একাত্তরের ২৫ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বর্বরোচিত গণহত্যা জঘন্যতম। ওইদিন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে এক রাতেই প্রায় ৫০ হাজার বাঙালিকে গুলি করে হত্যা করেছিল পাকিস্তানি বাহিনী। 


মুক্তিযুদ্ধে শহীদ আলীমের স্ত্রী শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী এ বিষয়ে সমকালকে বলেন, বিশ্বের অন্যান্য দেশে যেসব গণহত্যা হয়েছে, তা ছিল বছরব্যাপী। তবে বাংলাদেশে ২৫ মার্চ এক রাতেই পাকিস্তানি বাহিনী হাজার হাজার বাঙালিকে হত্যা করেছে, যেটা নজীরবিহীন। এ নিয়ে গবেষণা হওয়া প্রয়োজন। গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায় করা সম্ভব হলে পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ত্বরান্বিত হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

আরও পড়ুন

×