ঢাকা মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪

ইয়াবা পরিবার

ইয়াবা পরিবার

আতাউর রহমান

প্রকাশ: ২২ মে ২০১৮ | ১৯:১৩

পুলিশের কনস্টেবল ছিলেন শাহজাহান মিয়া। চাকরিজীবনে আইনের আওতায় নিয়েছেন বহু মাদক ব্যবসায়ীকে। অবসরজীবনে তার পরিবারই এখন মাদক কারবারে। তার মৃত্যুর পর পরিবারটি ঢাকা শহরে ইয়াবা বিক্রির দোকান খুলে বসেছে। পরিবারটির কে নেই মাদক ব্যবসায়? শাহজাহানের বৃদ্ধ স্ত্রী, দুই ছেলে ও দুই মেয়ে, পুত্রবধূ, জামাতা, এমনকি তার এক বোনও ইয়াবা কারবারের অংশীদার।

জানা গেছে, একদা কনস্টেবল শাহজাহানের জীবন ছিল নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা। তার অবর্তমানে পুরো পরিবারটিই এখন ফুলেফেঁপে অগাধ সম্পদের মালিক। প্রাণঘাতী নেশা ইয়াবা বিক্রি করে তারা ঢাকায় আলিশান বাড়ি ও একাধিক গাড়ি কিনেছেন। ব্যাংকে আছে কোটি কোটি টাকা। মালয়েশিয়ায় পরিবারটির 'সেকেন্ড হোম' রয়েছে বলেও ধারণা করা হচ্ছে। সেখানে থাকে এ পরিবারের দুই সদস্য। পরিবারটির ইয়াবা বিক্রির টাকার লেনদেন আর ব্যাংকের হিসাব অনুসন্ধান শুরু করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকও।

মাদকদ্রব্য  নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) সূত্র জানায়, শাহজাহানের স্ত্রী মনোয়ারা বেগম, বড় মেয়ে আসমা আহমেদ ডালিয়া, অপর মেয়ে স্বপ্না আহমেদ, ছেলে সৈয়দ মাহবুবুর রহমান, ডালিয়ার স্বামী রবিউল ইসলাম, স্বপ্নার স্বামী শামীম আহমেদ, মাহবুবুরের স্ত্রী সৈয়দা সুমাইয়া ইসলাম নয়ন এবং মাহবুবুরের ফুফু মাহমুদা রানী ইয়াবা ব্যবসায় জড়িত। এ ছাড়া মাহবুবুরের অপর এক ভাইও ইয়াবা ব্যবসা করে। এক বোন মালয়েশিয়ায় তাদের সেকেন্ড হোম দেখাশোনা করে বলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

কর্মকর্তারা বলছেন, এখন পর্যন্ত এই পরিবারের আটজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। শুরুর দিকে বুঝে উঠতে না পারলেও পরে জানা যায়, তারা সবাই একই পরিবারের। ইয়াবাও আসে একই চ্যানেলে, তবে বিক্রি হয় ভিন্ন ভিন্ন পন্থায়। চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার নাছির নামের একজন পরিবারটিকে ইয়াবা সরবরাহ করে থাকে।

ডিএনসির সূত্রাপুর সার্কেলের পরিদর্শক হেলাল উদ্দিন ভূঁইয়া জানান, এই পরিবারে ইয়াবা ব্যবসার সূত্রপাত করে আসমা আহমেদ ডালিয়া। এরপর ধীরে ধীরে পুরো পরিবারটিই অবৈধ এ ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ে। গত বছর ঢাকার এলিফ্যান্ট রোডের আলিশান ফ্ল্যাট থেকে ডালিয়াকে তার মা, স্বামীসহ গ্রেফতারের পর তাদের ইয়াবা বাণিজ্যের বিষয়টি সামনে আসে। এরপর ডিএনসি পরিবারটির প্রতি নজরদারি শুরু করে। সর্বশেষ গত এপ্রিলে ডালিয়ার ভাই ও ভাবিকে গ্রেফতার করেন ডিএনসির গোয়েন্দারা। সম্প্রতি পুলিশের তৈরি করা ৮২ মাদক ব্যবসায়ীর তালিকায়ও রয়েছে ডালিয়ার নাম।

পরিদর্শক হেলাল বলেন, পরিবারের আটজনের মধ্যে ডালিয়ার মা ও ফুফু জামিনে রয়েছে। অপর ছয়জন কারাগারে। এরই মধ্যে তাদের বিরুদ্ধে একটি মামলায় অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে।

যেভাবে ইয়াবা কারবারে :ডিএনসি সূত্র জানায়, ২০০০ সালের দিকে কনস্টেবল শাহজাহান মিয়া মারা যাওয়ার পর থেকেই তার বড় মেয়ে ডালিয়া হেরোইন ব্যবসায় জড়িয়ে যায়। তখন তাদের বাসা ছিল মোহাম্মদপুরে। ওই সময় সুইপার কলোনিতে হেরোইন বিক্রি করে মাদক কারবারে তার হাতেখড়ি। এর পর টাকার লোভে তার মা, ভাই, বোন ও স্বামীকেও মাদক ব্যবসায় নামায় সে। অঢেল টাকার মালিক হয়ে একসময়ে সমাজের উচ্চবিত্তদের সঙ্গে চলাফেরা শুরু করে। পরিবারটির মূল ব্যবসা ইয়াবা হলেও তারা চীন ও মালয়েশিয়া থেকে বাথরুমের বেসিন, কমোড ও ফিটিংস আমদানি করে থাকে।

মাদকদ্রব্য অধিদপ্তরের পরিদর্শক সুমনুর রহমান সমকালকে বলেন, ডালিয়া ও তার স্বামীকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা গেছে, মোহাম্মদপুরের সখিনা বেগম ওরফে নেত্রী সখিনা, কল্পনা ও সখিনার ভাগ্নি লিপির মাধ্যমে ডালিয়া মাদক ব্যবসায় জড়ায়। ২০০৩ সালে করা ২৩ নারী মাদক ব্যবসায়ীর তালিকায়ও তাদের নাম রয়েছে। হেরোইনের চাহিদা কমে যাওয়ায় ধীরে ধীরে ডালিয়া ইয়াবা ব্যবসায় জড়ায়। স্ত্রী ডালিয়ার হাত ধরেই মাদক ব্যবসার অন্ধকার পথে পা রাখে স্বামী রবিউল ইসলাম।

ডিএনসি সূত্র জানায়, ইয়াবা ব্যবসা করতে গিয়েই ডালিয়ার সঙ্গে পরিচয় হয় বেনাপোলের কুখ্যাত মাদক ব্যবসায়ী শামীম আহমেদের। তাদের মধ্যে পারিবারিক সখ্য গড়ে ওঠে। পরে মাদকসাম্রাজ্য শক্তিশালী করতে শামীমের কাছে ডালিয়া তার ছোট বোন স্বপ্নাকে বিয়ে দেয়। এরপর স্বপ্না স্বামীর হাত ধরে নামে মাদক ব্যবসায়। একইভাবে ডালিয়ার বড় ভাই সৈয়দ মাহবুবুর রহমানও মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ে। বিয়ের পর স্ত্রী সৈয়দা সুমাইয়া ইসলাম নয়নকেও নামায় একই ব্যবসায়। ডালিয়া মাদক বহনে তার বৃদ্ধ মা মনোয়ারা বেগম ও ফুফু মাহমুদা রানীকেও কাজে লাগায়।

জোগানদাতা নাছির :কোথা থেকে ইয়াবা পায় ডালিয়া ও তার পরিবার? খোঁজ নিতে গিয়ে মিলেছে আরও চমকপ্রদ তথ্য। এক ব্যক্তির কাছ থেকেই পুরো পরিবারটি ঢাকায় ইয়াবার চালান পায়। ওই ব্যক্তির নাম নাছির। মাদকসাম্রাজ্যে তার নাম সাতকানিয়ার নাছির। সব সময় থাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে। হাউজিং ব্যবসাসহ নানা ব্যবসার আড়ালে সে মূলত মাদকের জোগানদাতা। ডালিয়ার পরিবারসহ ঢাকায় আরও কয়েকজন মাদক ব্যবসায়ীকে পাইকারি দরে ইয়াবা সরবরাহ করে এই নাছির।

ডিএনসি সূত্র বলছে, এই নাছির 'হোয়াইট কালার ক্রিমিনাল'। বেশিরভাগ সময় থাকে বিদেশে। সেখানে বসেই পরিচালনা করে টেকনাফ থেকে ঢাকা পর্যন্ত মাদক ব্যবসা। সম্প্রতি পুলিশের তৈরি করা ৮২ মাদক ব্যবসায়ীর তালিকায় নাছিরের নামও রয়েছে।

ডিএনসির পরিদর্শক হেলাল উদ্দিন বলেন, ডালিয়া ও তার পরিবারের কয়েকজনকে গ্রেফতারের পর নাছিরের নাম বেরিয়ে আসে। তারা জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, নাছির টেকনাফ থেকে ঢাকায় তাদের কাছে ইয়াবা পাঠায়। চট্টগ্রামের সাতকানিয়া থানাসহ বিভিন্ন থানায় তার বিরুদ্ধে অন্তত ১১টি মাদক মামলা রয়েছে। সর্বশেষ ডালিয়া ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার অভিযোগপত্রেও নাছির অন্যতম পলাতক আসামি।

অঢেল সম্পদ :ডিএনসি জানায়, ডালিয়া ও তার পরিবারের সদস্যরা বিলাসবহুল জীবনযাপন করে। এলিফ্যান্ট রোডে অভিজাত একটি অ্যাপার্টমেন্টে তাদের রয়েছে বিশাল ফ্ল্যাট। এটিকে সাজানো হয়েছে রাজপ্রাসাদের মতো করে। কলাবাগান ও আদাবরেও রয়েছে তাদের ফ্ল্যাট। বিলাসবহুল গাড়ি রয়েছে তিনটি।

পরিদর্শক হেলাল উদ্দিন জানান, গত বছর ডালিয়াকে গ্রেফতারের সময় ৪০ হাজার পিস ইয়াবাসহ দুই লাখ ৮০ হাজার টাকাও জব্দ করা হয়। তদন্তে নেমে বিভিন্ন ব্যাংকে কোটি কোটি টাকার লেনদেনের তথ্যও মেলে। এর মধ্যে একটি অ্যাকাউন্টেই দুই কোটি টাকা জমা থাকার তথ্য মেলে। পরিবারটির নামে-বেনামে অঢেল সম্পত্তি রয়েছে বলে তারা ধারণা করছেন।

এই কর্মকর্তা বলেন, ডালিয়া ও তার পরিবারের ব্যাংক অ্যাকাউন্টগুলোর লেনদেন বন্ধ করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে আবেদন করা হয়েছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা জানান, ডালিয়ার এক ছেলে ও এক বোন মালয়েশিয়ায় বসবাস করে। জিজ্ঞাসাবাদে ডালিয়া বলেছে, সেখানেও তাদের সম্পত্তি রয়েছে। ডিএনসি ধারণা করছে, ইয়াবা বিক্রি করে ডালিয়া ও তার পরিবার মালয়েশিয়ায় 'সেকেন্ড হোম' তৈরি করেছে। তবে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদে তারা মুখ খোলেনি।

এখনও থামেনি ব্যবসা :ইয়াবা ব্যবসায় জড়িত থাকায় দেশে থাকা ডালিয়ার পরিবারের একজন বাদে সবাইকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তবে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সন্দেহ পরিবারটি এখনও জড়িত ইয়াবা ব্যবসায়। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, ডালিয়ার মা ও ফুফু জামিনে রয়েছে। মূল হোতা নাছিরকে এখনও গ্রেফতার করা যায়নি। ডালিয়ার এক ভাইও ধরাছোঁয়ার বাইরে। এ জন্যই সন্দেহ করা হচ্ছে, এরা এখনও ইয়াবা ব্যবসা করে যাচ্ছে।

অবশ্য মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, পরিবারটির দিকে গোয়েন্দা নজরদারি অব্যাহত রয়েছে। এক বছর আগে ডালিয়াকে গ্রেফতার করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় তার ভাই-ভাবিকেও আইনের আওতায় নেওয়া হয়।


আরও পড়ুন

×