ঢাকা মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪

প্রত্যাশার চাপ নিতে প্রস্তুত নয় রেল

ঈদ আসছে

প্রত্যাশার চাপ নিতে প্রস্তুত নয় রেল

তৌফিকুল ইসলাম বাবর, চট্টগ্রাম

প্রকাশ: ২৩ মে ২০১৮ | ১৯:৩৩

বরাবরের মতো ঈদে ঘরে ফেরা নিয়ে দুশ্চিন্তা এবারও। কারণ দেশের বেশিরভাগ সড়ক-মহাসড়কের অবস্থা ভালো নয়। সড়কের ঝামেলা এড়াতে ঘরমুখো মানুষের ভরসা তাই ট্রেন। নিরাপদ ও আরামের কারণে পছন্দের ট্রেনকে ঘিরে থাকে তাদের বাড়তি প্রত্যাশা। কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, যাত্রীদের প্রত্যাশার এমন চাপ নিতে পুরোপুরি প্রস্তুত নয় রেলওয়ে।

প্রতিবছরের ঈদে দূরপাল্লার কিছু রুটের নিয়মিত ট্রেনগুলোতে দু-একটি করে কোচ (বগি) সংযোজন করে বাড়তি কিছু যাত্রী বহন করা হয়। এ ছাড়া ঈদের তিন দিন আগে-পরে দু-তিনটি রুটে চালানো হয় কয়েকটি স্পেশাল ট্রেনও। ঈদে রেলের প্রস্তুতি বলতে এটুকুই। মূলত ইঞ্জিন, কোচ ও ট্রেন পরিচালনার সঙ্গে জড়িত লোকবল সংকটসহ বিভিন্ন কারণে যাত্রীদের বাড়তি প্রত্যাশা পূরণ করতে পারে না রেল। সড়কের দুরবস্থার কারণে অন্য যে কোনো বছরের তুলনায় এবার ট্রেনে যাত্রীর চাপ বাড়বে বলে মনে করা হলেও ঈদে রেলের প্রস্তুতি সেই আগের মতোই। তবে রেলমন্ত্রীসহ রেলের সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, এবার প্রস্তুতি আগের চেয়েও ভালো। ট্রেন পরিচালনার সঙ্গে সরাসরি জড়িত এমন পদে কিছু লোক নিয়োগ দেওয়ার পাশাপাশি নতুন কিছু ইঞ্জিন ও কোচ আমদানি করা হয়েছে। এগুলো কাজে লাগবে এবার।

রেলমন্ত্রী মো. মুজিবুল হক জানিয়েছেন, 'ঈদে যাত্রীদের নিরাপদে বাড়ি পৌঁছাতে সর্বোচ্চ সেবা দেওয়ার চেষ্টা করি। এবারও এর ব্যত্যয় ঘটবে না। যাত্রী চাহিদাসহ সার্বিক বিবেচনায় আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে এবারের ঈদে প্রস্তুতি ভালো।' আজ বৃহস্পতিবার দুপুরের দিকে ঈদের প্রস্তুতি নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে বিস্তারিত তুলে ধরবেন বলে জানিয়েছেন রেলমন্ত্রী।

ঈদে 'সোনার হরিণ' হয়ে উঠে ট্রেনের টিকিট। কাঙ্ক্ষিত টিকিট পেতে স্টেশন কাউন্টারে নির্ঘুম রাত পর্যন্ত কাটান যাত্রীরা। অনেকে স্টেশন থেকে হাসিমুখে বাড়ি ফিরলেও অনেককেই ফিরতে হয় খালি হাতে, হতাশ হয়ে। সংশ্নিষ্টরা বলছেন, সড়ক-মহাসড়কের খুবই বাজে অবস্থার কারণে এবারের ঈদে ট্রেনের টিকিট পেতে যে ঢল নামবে, সে তুলনায় টিকিটের ব্যবস্থা না থাকায় খালি হাতে ফিরতে হবে বিপুল যাত্রীকে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঈদে বাড়তি যাত্রী পরিবহনে বরাবরের মতো রেলের ওয়ার্কশপে পড়ে থাকা পুরনো কিছু কোচ-বগি সংস্কার-মেরামত করে ব্যবহার উপযোগী করা হচ্ছে। এবার প্রায় ১৫৫টি বাড়তি কোচ সংযোজন করা হবে। এরমধ্যে ৭৫টি রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের চট্টগ্রামের পাহাড়তলী ওয়ার্কশপে এবং ৮০টি পশ্চিমাঞ্চলের সৈয়দপুর ওয়ার্কশপে প্রস্তুত করা হচ্ছে। গত ঈদে রেলের দুই অঞ্চলে ১৭০টি কোচ সংযোজন করার ঘোষণা দেওয়া হলেও শেষ পর্যন্ত সব কোচ যুক্ত করা যায়নি। আর কোরবানির ঈদে পূর্বাঞ্চলে ৭২টি এবং পশ্চিমাঞ্চলে ৬৬টি কোচসহ দুটি অঞ্চলে ১৩৮টি কোচ সংযোজন করা হয়। একটি ক্যারেজ শপে একটি কোচ মেরামত করতে প্রয়োজনভেদে ১০ থেকে ১৫ দিন পর্যন্ত সময় লাগে বলে জানিয়েছেন কারখানা সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তারা।

গত ঈদে বাড়তি যাত্রী পরিবহনে রেলের পক্ষ থেকে সাতটি ট্রেনের ব্যবস্থা করা হয়। এগুলো চলাচল করে ঢাকা-দেওয়ানগঞ্জ-ঢাকা, পার্বতীপুর-ঢাকা-পার্বতীপুর, ঢাকা-খুলনা-ঢাকা, চট্টগ্রাম-নোয়াখালী-চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম-চাঁদপুর-চট্টগ্রাম রুটে। এবারও এসব রুটে স্পেশাল ট্রেন রাখা হতে পারে বলে জানা গেছে।

এ ব্যাপারে রেলওয়ের যুগ্ম মহাপরিচালক (অপারেশন) এসএম মুরাদ হোসেন বলেছেন, রেলমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলন করে আনুষ্ঠানিকভাবে ঈদ নিয়ে রেলের পরিকল্পনার কথা জানাবেন। তবে এবার বিভিন্ন ট্রেনে বাড়তি দেড়শ' কোচ সংযোজনের পাশাপাশি আগের মতো বিভিন্ন রুটে স্পেশাল ট্রেন চালানোসহ বিভিন্ন পরিকল্পনা রয়েছে।

চট্টগ্রামের পাহাড়তলীতে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের একমাত্র ওয়ার্কশপ ঘুরে দেখা গেছে, এর ক্যারেজ শপগুলোতে রীতিমতো কর্মযজ্ঞ চলছে। মেরামত করতে আনা কোনো শপে লাগানো হচ্ছে বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন, কোনো শপে চলছে রঙের কাজ, আবার কোনোটিতে আসন মেরামতের কাজ। এসব কাজে ব্যস্ত শত শত শ্রমিক-কর্মচারী। ঈদে মানুষকে ঘরে পৌঁছে দিতে এভাবে তৈরি করা হচ্ছে ট্রেনের কোচ। ওয়ার্কশপের শ্রমিকরা জানিয়েছেন, বছরজুড়েই ওয়ার্কশপে ব্যস্ততা থাকে। তবে ঈদের আগে সেই ব্যস্ততা আরও বেড়ে যায়। বিশেষ করে ঈদের দুই মাস আগে থেকে ঈদের জন্য অতিরিক্ত কোচ তৈরি করার কাজ শুরু হয়। এ কারণে অতিরিক্ত খাটতে হয়। অল্প সময়ে অধিকসংখ্যক কোচ মেরামত করার কাজ করতে হয় বলে অনেক সময় সব কাজ ঠিকঠাকমতো করা যায় না বলে জানিয়েছেন তারা। তবে শুধু পাহাড়তলী ওয়ার্কশপ নয়, এভাবে কোচ মেরামতের কাজ চলছে রেলের পশ্চিমাঞ্চলের সৈয়দপুর ওয়ার্কশপেও।

যোগাযোগ করা হলে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের বিভাগীয় তত্ত্বাবধায়ক (ওয়ার্কশপ) মো. মহিউদ্দিন জানিয়েছেন, 'এবারের ঈদে অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহনে আমাদের ৭৫টি পুরনো কোচ মেরামত করে দেওয়ার টার্গেট দেওয়া হয়েছে। সেই চেষ্টা চলছে। তবে লোকবল সংকটের কারণে স্বাভাবিক কাজ বিঘ্নিত হচ্ছে। দুই হাজার ১২৬ লোকবলের প্রয়োজন হলেও রয়েছে মাত্র এক হাজার ৫০ জন। তারপরও টার্গেট পূরণে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অতিরিক্ত শ্রম দিতে হচ্ছে।'

অভিন্ন তথ্য জানিয়েছেন পশ্চিমাঞ্চলের কারখানা-সংশ্নিষ্ট এক কর্মকর্তাও।

রেলের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঢাকা রেলস্টেশন থেকে প্রতিদিন স্ব্বাভাবিকভাবে ২০ হাজারের কিছু বেশি যাত্রী বিভিন্ন ট্রেনে করে গন্তব্যে যাতায়াত করে থাকেন। ঈদ উপলক্ষে দিনে বড়জোর ৩৫ থেকে ৪০ হাজারের মতো যাত্রী পরিবহনের ব্যবস্থা করতে পারবে রেলওয়ে। ঈদে এবার কমবেশি অর্ধকোটি মানুষ রাজধানী ছাড়তে পারেন। কিন্তু ইতিমধ্যে রেলের পক্ষ থেকে যে প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে তাতে ট্রেনে করে দুই লাখ থেকে আড়াই লাখের বেশি যাত্রী পরিবহন করা যাবে না। একইভাবে এবার চট্টগ্রাম মহানগরী ছাড়তে পারেন কমবেশি ২৫ লাখ মানুষ। এর মধ্যে প্রস্তুতি অনুযায়ী, প্রতিদিন গড়ে সাড়ে ছয় হাজারের বেশি যাত্রী পরিবহন করতে পারবে না রেল। অন্যদের সড়কপথের ওপর ভরসা করতে হবে।

রেলের সংশ্নিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে সমকালকে বলেন, এমনিতেই জোড়াতালি দিয়ে চালানো হচ্ছে ট্রেন। এ অবস্থায় ঈদে বাড়তি যাত্রী পরিবহনে প্রত্যাশা অনুযায়ী খুব বেশি কিছু করতে পারছে না রেল। তবু ঈদে বাড়তি চাপের কথা বিবেচনা করে কিছু কোচ মেরামত করে ব্যবহার উপযোগী করা হচ্ছে। তারা বলছেন, দিনে দিনে রেলের ক্ষমতা যেমন বাড়ছে, তেমনি বাড়ছে যাত্রীও। ফলে যাত্রীদের আশানুরূপ চাহিদা পূরণ করা যায় না।

রেলওয়ে সূত্র জানায়, রেলের সংস্কার নিয়ে ঢাকঢোল পেটানো হলেও বাস্তবতা হচ্ছে- কোচ এবং ইঞ্জিন ছাড়াও চালক ও পরিচালকসহ (গার্ড) ট্রেন পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত লোকবলের অভাব রয়েছে। স্টেশন মাস্টার ও সহকারী মাস্টারের অভাবে বন্ধ রয়েছে অনেক স্টেশন। টিকিট চেকার (টিটি) ছাড়া চলছে অনেক ট্রেন। নেই পর্যাপ্ত কোচ-বগি। প্রয়োজনীয় সংস্কার-মেরামত না করায় ট্রেন চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়েছে রেললাইনের বড় একটি অংশ।

সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দেশের প্রায় দেড় হাজার কিলোমিটার সড়কই চলাচলের অযোগ্য। মহাসড়কের ৪৩ শতাংশ সড়কের অবস্থা ভালো নয়। জাতীয় সড়ক, মহাসড়ক, জেলা সড়ক ক্যাটাগরিতে ২১ হাজার কিলোমিটার সড়ক রয়েছে। এর মধ্যে ৬২ দশমিক ৩২ শতাংশের অবস্থা খুবই খারাপ। এবার ঈদযাত্রায় ভাঙা সড়ক যাত্রীদের ভোগাবে। চাপ পড়বে ট্রেনের ওপর। যদিও ঈদের আগেই সড়কের ক্ষত সারিয়ে তুলতে সওজকে নির্দেশ দিয়েছেন সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।

আরও পড়ুন

×