ঢাকা মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪

কে নেবে ওদের দায়িত্ব

সড়ক দুর্ঘটনায় চিকিৎসাধীন পঙ্গুদের দুঃসহ জীবন

কে নেবে ওদের দায়িত্ব

রাজবংশী রায়

প্রকাশ: ২৩ মে ২০১৮ | ১৯:৩৯ | আপডেট: ২৪ মে ২০১৮ | ০৭:৪২

পরিবারে তারাই ছিলেন একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তাদের আয়ের ওপর নির্ভর করত পরিবারের ভরণ-পোষণ। কিন্তু নিয়তির কী নির্মম পরিহাস! তারাই এখন পরিবারের কাছে বড় বোঝায় পরিণত হয়েছেন। মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনা এলোমেলো করে দিয়েছে প্রত্যেকের জীবন। দুর্ঘটনায় কেউ হাত, কেউবা পা হারিয়েছেন। স্বল্প বেতনে চাকরি করে পরিবারকে নিয়ে বেঁচে থাকার যে স্বপ্ন তারা দেখেছিলেন, মাঝপথে এসে তা হারিয়ে গেল। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে ভবিষ্যতের অজানা আতঙ্ক তাদের তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। সামনে শুধুই অন্ধকার। সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে পঙ্গুত্ববরণকারী এমন কয়েকজনের সন্ধান পাওয়া গেছে। বর্তমানে তারা রাজধানীর জাতীয় অর্থোপেডিক পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (নিটোর) চিকিৎসাধীন, যা পঙ্গু হাসপাতাল নামে পরিচিত। সম্প্রতি সড়ক দুর্ঘটনায় আহত তিতুমীর কলেজের ছাত্র রাজীব হাসানের মৃত্যু দেশবাসীকে নাড়া দিয়েছিল। তবে পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন পঙ্গুত্বের শিকার এসব মানুষ এখনও অলক্ষ্যে রয়ে গেছেন। মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় পঙ্গুত্ববরণকারী এসব মানুষের দায়িত্ব কে নেবে-এমন প্রশ্ন সংশ্নিষ্টদের।

সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধ ও সচেতনতা সৃষ্টিতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসা 'নিরাপদ সড়ক চাই'-এর চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন সমকালকে বলেন, জনগণের দায়িত্ব রাষ্ট্র ও সরকারের। দুর্ঘটনায় পঙ্গুত্ববরণকারী মানুষের দায়িত্ব অবশ্যই রাষ্ট্রের নেওয়া উচিত। কারণ চালকের দক্ষতার অভাবে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে। যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা না করেই অনেক চালককে লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। রাস্তায় নেমে তারাই দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছে। যারা লাইসেন্স দিয়েছে তারা দায় এড়াতে পারে না। কী করলে দুর্ঘটনা প্রতিরোধ করা যাবে, সে সম্পর্কিত একটি প্রস্তাবনা সরকারের কাছে অনেক আগেই জমা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সাড়া মেলেনি বলে অভিযোগ করেন তিনি।

৫০০ শয্যার পঙ্গু হাসপাতালে কোনো শয্যাই ফাঁকা নেই। বিভিন্ন দুর্ঘটনায় আহত হয়ে তারা হাসপাতালে ভর্তি আছেন। তাদের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে চিকিৎসাধীন রোগীর সংখ্যাই বেশি। গত শনিবারও দুর্ঘটনায় হাত-পা হারানো পাঁচজনকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আহত হয়ে যারা হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসেন তাদের ৮০ শতাংশই সড়ক দুর্ঘটনার শিকার। সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ৪ থেকে ৫ শতাংশ মানুষ পঙ্গুত্বের শিকার হন।

হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. গনি মোল্লা বলেন, সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সচেতনতার প্রয়োজন। চালকদের দক্ষতার সঙ্গে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। এজন্য সরকারের পাশাপাশি পরিবহন মালিকদের উদ্যোগী ভূমিকা পালন করতে হবে।

সরেজমিনে হাসপাতাল ঘুরে দুর্ঘটনায় পঙ্গুত্বের শিকার অনেক মানুষের খোঁজ মিলেছে। তাদের মানবেতর জীবনের গল্প শুনে অশ্রুসিক্ত হতে হয়। তাদের একজন জয়পুরহাটের পাঁচবিবি উপজেলার বাসিন্দা দেলোয়ার হোসেন মণ্ডল। তিনি জয়পুরহাট শাখা ব্র্যাকের আয়েশা-আবেদ ফাউন্ডেশনে দর্জি প্রশিক্ষক হিসেবে চাকরি করেন। মাত্র পাঁচ হাজার টাকার বেতন দিয়েই চলে তার সংসার। গত ২০ এপ্রিল স্মার্টকার্ড নিতে স্ত্রীকে নিয়ে মোটরসাইকেলে জয়পুরহাটে যাচ্ছিলেন। নাটোরের সিংড়া উপজেলার কাছাকাছি যেতেই একটি ট্রাক তার বাইককে ওভারটেক করে। তখন তিনি দুর্ঘটনার শিকার হন। ট্রাকের চাকায় তার ডান পা পিষ্ট হয়। মোটরসাইকেলের পেছনে থাকা তার স্ত্রী রাস্তায় ছিটকে পড়েন। এলাকাবাসী তাদের উদ্ধার করে স্থানীয় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যায়। সেখান থেকে পঙ্গু হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। সেখানে তার ডান পা কেটে ফেলা হয়। দেলোয়ার মণ্ডল জানান, দুর্ঘটনার পর এলাকাবাসী ট্রাকটি আটক করে থানায় সোপর্দ করে। পরে থানা পুলিশ চিকিৎসা বাবদ তাকে ২৫ হাজার টাকা দেওয়ার শর্তে ঘটনাটি মীমাংসা করে দেয়।

সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তির এমন দুর্ঘটনায় স্ত্রী সাবিনা আক্তারের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়েছে। সাবিনা আক্তার তার স্বামীর পা হারানোর ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের কঠোর শাস্তির পাশাপাশি আর্থিক সাহায্য পেতে সহায়তার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছেন।

হযরত আলী :গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার বাসিন্দা হযরত আলী গত ১৭ এপ্রিল মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনার কবলে পড়েন। ওই দিন সকালে ডায়াবেটিস আক্রান্ত হযরত আলী চিকিৎসার জন্য কাপাসিয়া গ্রামের বাড়ি থেকে গাজীপুর জেলা সদরে রওনা হন। বাসে উঠতে গিয়ে মাটিতে পড়ে যান তিনি। তখন বাসের পেছনের চাকা তার ডান পায়ের ওপর দিয়ে চলে যায়। এতে তার পা থেঁতলে যায়। স্থানীয়রা উদ্ধার করে প্রথমে স্থানীয় একটি হাসপাতালে এবং পরে সেখান থেকে পঙ্গু হাসপাতালে আনা হলে সেখানে তার ডান পা কেটে ফেলা হয়।

হযরত আলী স্থানীয় একটি ফোরকানিয়া মাদ্রাসায় শিক্ষকতার পাশাপাশি একটি মসজিদে মুয়াজ্জিন হিসেবে কাজ করতেন। সেখান থেকে পাওয়া বেতন দিয়ে সংসার চালানোর পাশাপাশি তিন ছেলেমেয়ের পড়াশোনার খরচ চালাতেন। ডান পা হারিয়ে তিনি এখন দিশেহারা। যে বাস তার পা কেড়ে নিয়েছে, সেই বাস মালিকপক্ষ চিকিৎসার জন্য হযরত আলীকে ৫০ হাজার টাকা দিয়েছে। এরপর আর কোনো খোঁজ নেয়নি। হযরত আলী অনেকটাই বাকহীন। তার মেয়ে ফাতেমা জানান, দুর্ঘটনার শিকার হয়ে জ্ঞান ফেরার পর থেকে বাবা কারও সঙ্গে তেমন কথা বলছেন না। তাকে সান্ত্বনা দিতে গেলে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন। সংসার ও তিন ভাইবোনের পড়াশোনার খরচ কে চালাবে তা নিয়ে চিন্তিত ফাতেমা। ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের শাস্তির দাবি জানান তিনি। একইসঙ্গে বাস মালিকদের কাছে আর্থিক ক্ষতিপূরণ দাবি করেছেন।

শারমিন বেগম :দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত সংসারের হাল ধরতে চাকরি নিয়েছিলেন গাজীপুরের বাসিন্দা ১৪ বছর বয়সী শারমিন বেগম। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনার পর দারিদ্র্যের কাছে হার মানতে হয় তাকে। পড়াশোনা থামিয়ে চাকরি নেন গাজীপুরের কাশেম গ্যাস লাইট কারখানায়। মাত্র সাড়ে তিন হাজার টাকা বেতন পেতেন এই কিশোরী। মা জরিনা বেগম অন্যের বাড়িতে কাজ করেন। এই দুইজনের সামান্য বেতন দিয়েই চলত পরিবারটি। কিন্তু ১৮ এপ্রিল সকালে বাসা থেকে অফিসে যাওয়ার জন্য লেগুনায় ওঠে শারমিন। কিছুদূর যাওয়ার পর লেগুনা থেকে একজন যাত্রীকে নামতে দিতে গিয়ে রাস্তায় দাঁড়ায় সে। তখন পেছনে থেকে একটি বাস তার বাঁ পা পিষ্ট করে দিয়ে যায়। স্থানীয়রা উদ্ধার করে তাকে গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দীন মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখান থেকে তাকে পঙ্গু হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। এখানে তার বাম পা কেটে ফেলা হয়।

পঙ্গু হাসপাতালে বসেই শারমিনের সঙ্গে কথা হয়। ঘটনার বিবরণ জানতে চাইতেই হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে শারমিন। তার অভিযোগ, ঘটনার পরপরই স্থানীয়রা বাসটি আটক করলেও অজ্ঞাত কারণে তা ছেড়ে দেওয়া হয়। এমনকি তাকে কোনো ক্ষতিপূরণও দেওয়া হয়নি। চিকিৎসার জন্য এক আত্মীয়ের কাছ থেকে মাত্র ২০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছেন। এখন তাও প্রায় শেষ।

শারমিনের মা জরিনা বেগম তার মেয়ের জীবন নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, কে বিয়ে করবে তার মেয়েকে? ওর জীবনটাই নষ্ট হয়ে গেল। যারা শারমিনের জীবনটা নষ্ট করে দিল তাদের কঠোর শাস্তি দাবি করেন তিনি। মেয়ের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার জন্য একটি সরকারি চাকরি দাবি করেন জরিনা বেগম।

মুরাদ হোসেন :ট্রাকচালক মুরাদ হোসেনের ঘটনাটি একটু ভিন্ন। একটি যাত্রীবাহী বাসকে রক্ষা করতে গিয়ে ট্রাকের নিয়ন্ত্রণ হারান। একটি ব্রিজের খাম্বার সঙ্গে ট্রাকটির মুখোমুখি ধাক্কা লাগে। ওই ধাক্কায় পড়ে গিয়ে বাঁ পা হারান মুরাদ হোসেন। প্রায় এক মাস আগে কিশোরগঞ্জে ঘটনাটি ঘটে। ভবিষ্যৎ জীবন নিয়ে তিনি শঙ্কিত। বছর দেড়েক আগে বিয়ে করেছেন মুরাদ। স্ত্রী পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। অনাগত সন্তানকে লালন-পালন ও সংসার চালানোর বিষয় মনে এলেই অশ্রুসজল হন মুরাদ। যে প্রতিষ্ঠানের ট্রাক চালাতেন দুর্ঘটনার পর তারাও তার খোঁজ নিচ্ছে না। মুরাদ জানান, সড়কে যেসব দুর্ঘটনা ঘটে তা বাস অথবা ট্রাকচালকদের ভুলের কারণেই হয়। বেশিরভাগ চালক বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালান। আবার হাইওয়েতে গিয়ে অনেক সময় হেলপার দিয়েও গাড়ি চালানো হয়। এতে করে সড়কে প্রতিদিনই কোনো না কোনো দুর্ঘটনা ঘটছে। এতে বলি হচ্ছে সাধারণ মানুষ।

চালকদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে মুরাদ বলেন, সবার প্রতি আহ্বান থাকবে যথাযথ প্রশিক্ষণ নিয়ে গাড়ি চালাবেন। মনে রাখবেন, আপনার একটি ভুলের কারণে একটি পরিবারে সারাজীবনের জন্য দুঃস্বপ্ন নেমে আসতে পারে।

আরও পড়ুন

×