ঢাকা মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪

ধর্ষণের অনুসন্ধান ও বিচারে হাইকোর্টের ১৮ দফা নির্দেশনা

৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ডিএনএ পরীক্ষা বাধ্যতামূলক, তদন্তকারী সংস্থার ব্যর্থতাও শাস্তিযোগ্য অপরাধ

ধর্ষণের অনুসন্ধান ও বিচারে হাইকোর্টের ১৮ দফা নির্দেশনা

সমকাল প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৭ মে ২০১৮ | ২০:৩৯

ধর্ষণের ঘটনার সুষ্ঠু অনুসন্ধান ও বিচার নিশ্চিতে ১৮ দফা নির্দেশনা সংবলিত রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। এতে ধর্ষণ ও যৌননিপীড়নমূলক সব ঘটনায় বাধ্যতামূলকভাবে অভিযোগ প্রাপ্তির ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ডিএনএ পরীক্ষা করাতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি রিপোর্ট সংগ্রহ বা স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য নিকটস্থ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে তদন্তকারী সংস্থার যে কোনো ব্যর্থতাও শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য হবে। ধর্ষণের ঘটনায় মামলা দায়ের ও তদন্তের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট আইন না হওয়া পর্যন্ত সংশ্নিষ্টদের এই নির্দেশনা মেনে চলতে রায়ে বলা হয়েছে। এ ছাড়া হাইকোর্টের নির্দেশনার আলোকে একটি গ্রহণযোগ্য নীতিমালা তৈরি করতে আইন মন্ত্রণালয়, নারী ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং পুলিশ মহাপরিদর্শককে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতেও বলা হয়েছে রায়ে। বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি কাজী ইজারুল হক আকন্দের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এক রায়ে ১৮ দফা এই নির্দেশনা দেন। রাজধানীতে এক গারো তরুণীকে গণধর্ষণের মামলায় ২০১৬ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট এই রায় দেন। সম্প্রতি দুই বিচারপতির স্বাক্ষর শেষে ৪০ পৃষ্ঠার এই রায় প্রকাশ করা হয়। রায় প্রসঙ্গে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, ধর্ষণের ঘটনা সুষ্ঠু তদন্তে এটি যুগান্তকারী রায়। সুষ্ঠু তদন্ত নিশ্চিত করা হলে বিচারও নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। 


১৮ দফা নির্দেশনা : ১. ধর্ষণ, যৌননিপীড়ন বা এ-সংক্রান্ত ঘটনায় থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তাৎক্ষণিকভাবে অভিযোগ লিখিতভাবে রেকর্ড করবেন। এক্ষেত্রে ওই থানার আওতার মধ্যে ঘটনা সংঘটিত হোক বা না হোক, সেটা মুখ্য নয়। ২. অবিলম্বে এমন একটি সার্ভার তৈরি করতে হবে, যাতে এ ধরনের অভিযোগ সরাসরি অনলাইনের মাধ্যমে করা যায়। ৩. সুনির্দিষ্ট কারণ ছাড়া কোনো পুলিশ অফিসার যদি অভিযোগ গ্রহণে বিলম্ব করে, তবে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের সুনির্দিষ্ট বিধান থাকতে হবে। ৪. প্রত্যেক থানায় কনস্টেবলের নিচে নয়, এমন একজন নারী পুলিশ রাখতে হবে। অভিযোগ পাওয়ার পর ডিউটি অফিসার একজন নারী কর্মকর্তার (দায়িত্বপ্রাপ্ত) মাধ্যমে ও ভুক্তভোগীর পরিবারের সদস্য, শুভাকাঙ্ক্ষী, সমাজকর্মী বা আইনজীবীর উপস্থিতিতে অভিযোগ রেকর্ড করবেন। ৫. সবক্ষেত্রে ভুক্তভোগীর সমস্ত তথ্য সংরক্ষণে গোপনীয়তা রক্ষা করতে হবে। ৬. প্রত্যেক থানায় ভুক্তভোগীদের জন্য সহযোগিতাপূর্ণ নারী সমাজকর্মীদের একটি তালিকা তৈরি রাখতে হবে। ৭. ভুক্তভোগীর আইনজীবী, সংশ্নিষ্ট বন্ধু, সমাজকর্মী অথবা নিরাপত্তা কর্মকর্তার উপস্থিতিতে তার অভিযোগ রেকর্ড করতে হবে। ৮. অধিকার সুরক্ষায় রাষ্ট্রের দেওয়া অধিকার সম্পর্কে ভুক্তভোগীকে সচেতন করতে হবে এবং সে চাইলে যে কোনো তথ্য প্রদান করতে হবে। ৯. অভিযোগ পাওয়ার পর তাৎক্ষণিকভাবে ডিউটি অফিসারকে 'ভিক্টিম সাপোর্ট সেন্টার'-এ অবহিত করতে হবে। ১০. ধর্ষণ বা যৌন নিপীড়নের শিকার কোনো নারী বা মেয়ে করণীয় সম্পর্কে বুঝতে অক্ষম হলে তাকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিতে হবে। ১১. লিখিত তথ্য গ্রহণের পর কোনো প্রকার বিলম্ব না করে তদন্ত কর্মকর্তা ভুক্তভোগীকে একজন নারী পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য প্রেরণ করবেন। ১২. ভুক্তভোগীর দ্রুত সেরে উঠতে ভিক্টিম সাপোর্ট সেন্টারে সার্বক্ষণিক প্রয়োজনীয় সুবিধা থাকতে হবে। ১৩. ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নমূলক সব ঘটনায় বাধ্যতামূলকভাবে অভিযোগ প্রাপ্তির ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ডিএনএ পরীক্ষা করাতে হবে। ১৪. অপরাধ ঘটনার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ডিএনএসহ অন্যান্য নমুনা সংগ্রহ করে তা ফরেনসিক সায়েন্স ল্যাবে পাঠাতে হবে। ১৫. যে কোনো রিপোর্ট সংগ্রহ বা স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য নিকটস্থ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে তদন্ত সংস্থার যে কোনো ব্যর্থতা শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য হবে। ১৬. যত দ্রুত সম্ভব মামলার তদন্ত কর্মকর্তা তদন্ত রিপোর্ট প্রস্তুত করবেন। ১৭. নারী ও শিশুদের ওপর সংঘটিত অপরাধের ক্ষেত্রে '১০৯২১' নম্বরে ফোন করে যেন প্রতিকার পেতে পারে, সে বিষয়টি প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক এবং ওয়েব সংবাদমাধ্যমে ব্যাপক প্রচারণা চালাতে হবে। এবং ১৮. ভুক্তভোগীর নিরাপত্তা, প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং পরামর্শ দানের জন্য প্রত্যেক মহানগরে একটি করে সহায়তা কেন্দ্র স্থাপন করতে হবে। 


মামলার বিবরণে জানা যায়, ২০১৫ সালের ২১ মে রাতে রাজধানীর উত্তরা এলাকায় মাইক্রোবাসের মধ্যে এক গারো তরুণী গণধর্ষণের শিকার হন। পরে এ ঘটনায় মামলা করতে গেলে বিভিন্ন থানায় ঘুরে ঘুরে পুলিশের অসহযোগিতার কারণে ভোগান্তি পোহাতে হয় তার অভিভাবকদের। মেয়েটির বড় বোনের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, তাদের বাসা উত্তরায় হওয়ায় তারা প্রথমে মামলা করার জন্য তুরাগ থানায় যান। কিন্তু অন্য এলাকার ঘটনা বলে পুলিশ রাত ৪টার দিকে তাদের ফিরিয়ে দেয়। এরপর ভোর ৫টার দিকে তারা যান গুলশান থানায়। সেখানেও একই উত্তর মেলে। শেষে সাড়ে ৬টার দিকে ভাটারা থানায় গেলে বলা হয়, ওসি নেই, অপেক্ষা করতে হবে। পরদিন সকাল সাড়ে ৯টার দিকে ওসি আসেন এবং তাদের কথা শুনে সাড়ে ১২টার দিকে মামলা নথিভুক্ত করা হয়। চিকিৎসার জন্য তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয় আরও একদিন পর। পরে এ ঘটনায় পৃথক পাঁচটি মানবাধিকার সংগঠন বাদী হয়ে জনস্বার্থে হাইকোর্টে একটি রিট করে। ওই রিটের শুনানি নিয়ে একই বছরের ২৫ মে হাইকোর্ট রুল জারি করেন। এরপর ওই রুলের চূড়ান্ত শুনানি নিয়ে ২০১৬ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি রায় দেন হাইকোর্ট। এরই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়।

আরও পড়ুন

×