ঢাকা মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪

নদীর ভাঙন রোধে আর বিচ্ছিন্ন প্রকল্প নয়

ক্যাপিটাল ড্রেজিং চায় পরিকল্পনা কমিশন

ক্যাপিটাল ড্রেজিং চায় পরিকল্পনা কমিশন

মোহাম্মদ সাইফুদ্দিন

প্রকাশ: ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮ | ১৯:১৯

সর্বনাশা পদ্মার ভাঙনে নড়িয়ার মানুষ এখন প্রতিদিন সর্বহারা হচ্ছেন। শরীয়তপুর জেলার এ উপজেলায় নদীভাঙনে তিন মাসে সাড়ে তিন হাজার পরিবার বাস্তুচ্যুত হয়েছে। এই ভাঙন আরও কতদিন চলবে তা কেউ বলতে পারছেন না। শুধু নড়িয়ায় পদ্মার ভাঙন নয়, পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য মতে, এ মুহূর্তে ৫১ জেলায় ২৭২ স্থানে নদীভাঙন চলছে। পদ্মা, মেঘনা, যমুনার ভাঙন রোধে বিচ্ছিন্নভাবে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ও হচ্ছে প্রতি বছর। কিন্তু ভাঙন ঠেকানো যাচ্ছে না। এতে প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় করা অর্থ জলেই ভেসে যাচ্ছে।

এমন পরিস্থিতিতে পরিকল্পনা কমিশন বলছে, নদীগুলোতে ক্যাপিটাল ড্রেজিং করা হলে নদীভাঙন কমবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, সারাদেশের সব বড় নদীর পাশাপাশি শাখা নদী, উপনদী এবং খালগুলোকেও নিয়মিত খননের আওতায় আনতে হবে; অর্থাৎ ক্যাপিটাল ড্রেজিং করতে হবে। এ ছাড়া ভাঙন রোধে সঠিক নকশায় অবকাঠামো নির্মাণ করতে হবে। প্রকল্প বাস্তবায়নে তদারকি ও মূল্যায়ন কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। একই সঙ্গে নদীর ওপর নগরায়ণের চাপ কমাতে হবে। এ জন্য একটি মহাপরিকল্পনা প্রয়োজন। একই সঙ্গে মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দও দিতে হবে।

সম্প্রতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিবি) বাস্তবায়ন কৌশল নির্ধারণ, নতুন প্রকল্প নির্দিষ্টকরণ ও অনুমোদন-সংক্রান্ত বিষয়ে এক আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক হয়। পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সভাপতিত্বে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবরা এ সময় উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে নদীভাঙন রোধে বিচ্ছিন্নভাবে প্রকল্প না নিয়ে ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে পরিকল্পনা কমিশন। একই সঙ্গে নদী খনন থেকে পাওয়া মাটি দিয়ে নদী তীর সংরক্ষণের

ব্যবস্থার কথা বলেছেন তারা। কমিশনের কর্মকর্তারা বলেন, ক্যাপিটাল ড্রেজিং বা মৌলিক খনন ছাড়া নদীর তীর সংরক্ষণ প্রকল্পের কোনো সুফল পাওয়া যাচ্ছে না, ভবিষ্যতেও পাওয়া যাবে না। ভাঙন প্রতিরোধে নির্মিত অবকাঠামোও ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে নদীর স্রোত।

বৈঠকে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, ক্যাপিটাল ড্রেজিং করা হলে নদীর ভাঙন কমে যাবে এবং ড্রেজিং থেকে পাওয়া মাটি দিয়ে নদীর পাড় বাঁধ দিতে হবে। তীর সংরক্ষণের পাশাপাশি নদীর নাব্য বৃদ্ধি করতে হবে। তাই বিচ্ছিন্নভাবে নদীর তীর সংরক্ষণের প্রকল্প গ্রহণ না করে ক্যাপিটাল ড্রেজিং জরুরি। এ ছাড়া ড্রেজিং করা মাটি-বালু ব্যবহার করে ভূমি পুনরুদ্ধার করাও সম্ভব বলে তিনি মনে করেন।

বৈঠকে বলা হয়, পলি জমে নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে নদীর পানি ধারণ ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। ফলে তীর ভাঙছে। এতে বিলীন হচ্ছে গ্রাম, শহর ও জনপদ। ভাঙনের ফলে যুমনা নদীর গড় প্রশস্ততা এখন ১২ কিলোমিটার হয়েছে। এ ছাড়া পদ্মা ১০ কিলোমিটার, গঙ্গা পাঁচ কিলোমিটার এবং মেঘনার গড় প্রশস্ততা বেড়ে ৩ দশমিক ৪ কিলোমিটার পর্যন্ত হয়েছে।

সরকারের ১০০ বছরের ব-দ্বীপ পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, পদ্মা, মেঘনা, যমুনাসহ দেশের সব নদীর মূল গতিপথ ধরে খনন করা হবে। ফলে ছোট-বড় সব নদীর গড় প্রশস্ততা কমে আসবে। এতে হাজার হাজার হেক্টর ভূমি পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হবে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে হিমালয়ের পানি বাংলাদেশের নদীগুলো দিয়ে প্রবাহিত হয়। পানির সঙ্গে প্রচুর পরিমাণের পলিও আসে। এই পলির কারণে নদীগুলো পানি ধারণ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। ফলে ঢল তীরে আঘাত করে। এতে ভাঙন দেখা দেয়। প্রতি বছর নদীভাঙন হলেও হিমালয় অঞ্চলে অতিবৃষ্টির কারণেও কোনো কোনো বছর ভাঙন বেড়ে যায়। এ ছাড়া অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে নদীর গতিপথ বাধাপ্রাপ্ত হয়। এতে নদী তার নিজের গতিপথ খুঁজে নেয়। অন্যদিকে বাংলাদেশের বেশিরভাগ নদীর উৎপত্তিস্থল ভারত ও চীন। প্রতিবেশী দেশ এসব আন্তঃনদীগুলোতে পানি প্রবাহ বাড়ানোর কারণেও কোনো কোনো সময় এ দেশে নদীভাঙন ভয়াবহ রূপ ধারণ করে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে নদী বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত সমকালকে বলেন, প্রাচীনকাল থেকে নদীর ভাঙা-গড়া চলছে। প্রকৃতির নিয়মে নদী ভাঙবে। এ কারণে নদীকে শাসন করতে হয়। নদী তীর রক্ষায় কয়েক যুগ থেকে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু ভাঙন রোধ করা যাচ্ছে না। সঠিক পরিকল্পনা, প্রকল্পের যথার্থ নকশা, বাস্তবায়ন কাজে তদারকি এবং প্রকল্পের মূল্যায়ন না হওয়ার কারণে এসব প্রকল্পের সুফল পাওয়া যাচ্ছে না।

বাংলাদেশ নদী গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা পিন্টু কানুনগো সমকালকে বলেন, নদীভাঙন সমস্যা এখন জটিল আকার ধারণ করেছে। এর জন্য গবেষণার মাধ্যমে সমন্বিত মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। এ মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে বড় অঙ্কের আর্থিক বরাদ্দও দিতে হবে।

নদী গবেষণা ইনস্টিটিউটের সিনিয়র গবেষণা কর্মকর্তা ড. মনিরুজ্জামন খান বলেন, ভাঙন প্রতিরোধে পানি ধারণ ক্ষমতা বাড়াতে হবে। এর জন্য ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের পাশাপাশি নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ ড্রেজিংও করতে হবে। এ ছাড়া ধারণ ক্ষমতা বাড়াতে শাখা নদী, উপনদী, এবং সংযুক্ত খালগুলো খনন করতে হবে। নদীগুলোকে দখলমুক্ত করতে হবে।

জানা গেছে, শরীয়তপুরের জাজিরা ও নড়িয়া উপজেলায় পদ্মা নদীর ডান তীর রক্ষায় এক হাজার ৯৭ কোটি টাকার একটি প্রকল্প চলমান থাকলেও বর্তমানে ভাঙনের কারণে প্রকল্প ব্যয় আরও কয়েকগুণ বাড়তে পারে বলে মনে করছেন পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা। অন্যদিকে ঢাকা জেলার দোহারের মাঝিরচর থেকে নারিশাবাজার হয়ে মোকসেদপুর পর্যন্ত পদ্মা নদী ড্রেজিংয়ে এক হাজার ৪৮৩ কোটি টাকার একটি প্রকল্প সম্প্রতি অনুমোদন দিয়েছে একনেক। এই দুই প্রকল্পসহ পদ্মা নদী ভাঙন রোধে বর্তমানে পাঁচ প্রকল্পে ৩ হাজার ৪০৮ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে।

পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের আওতায় দেশের বিভিন্ন এলাকায় নদী তীর রক্ষা ও খনন কাজে বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পে বরাদ্দ আছে ২১ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে যমুনা তীর রক্ষায় মোট তিন হাজার ৩৬ কোটি টাকার প্রকল্প চলমান রয়েছে। মেঘনার ভাঙন রোধে বাস্তবায়ন কাজ চলছে ১০ প্রকল্পের মাধ্যমে। এসব প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে তিন হাজার ২০৮ কোটি টাকা।

আরও পড়ুন

×