জেএমবিকে অর্থ জোগাচ্ছে জঙ্গি শায়খের পরিবার
সাহাদাত হোসেন পরশ
প্রকাশ: ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৮ | ১৯:৪৬ | আপডেট: ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৮ | ০৪:০৯
নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জামা'আতুল মুজাহিদীন অব বাংলাদেশকে (জেএমবি) চাঙ্গা করতে সৌদি আরব থেকে অর্থায়ন করছে জেএমবির প্রতিষ্ঠাতা শায়খ আবদুর রহমানের পরিবারের সদস্যরা। ভারতের জেএমবিকেও আর্থিক সহায়তা করছে তারা। সম্প্রতি বিদেশ থেকে জঙ্গি অর্থায়ন-সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন সংশ্লিষ্ট দপ্তরে জমা দেওয়া হয়েছে। জঙ্গি কার্যক্রম সম্পর্কে খোঁজ রাখেন, এমন এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা সমকালকে এসব তথ্য জানান।
জানা গেছে, শুধু শায়খ আবদুর রহমানের পরিবার নয়, জঙ্গিবাদে জড়িয়ে দেশের বাইরে পালিয়ে যাওয়া আরও কেউ কেউ অর্থায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। উগ্রপন্থিদের চাঙ্গা রাখতে অর্থ সাহায্য দিচ্ছে সৌদি আরব থেকে শায়খ আবদুর রহমানের পরিবারসহ তিনটি গ্রুপ। পুলিশ ফেনী থেকে এরই মধ্যে জঙ্গি আবদুল্লাহ আল মঞ্জু ওরফে জাহাঙ্গীরকে গ্রেফতার করেছে। তার সঙ্গে পলাতক জঙ্গিদের যোগসূত্র পাওয়া গেছে।
২০০৫ সালে সারাদেশে জেএমবির শীর্ষ নেতাদের ধরপাকড় শুরু হয়। তখন সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা শায়খ আবদুর রহমানের অনেক নিকটাত্মীয়ই দেশ ছেড়ে সৌদি আরবে যায়। তাদের মধ্যে রয়েছে শায়খের বোনের স্বামী খোরশেদ আলম, আবদুর রাকিব, সাকিব ও নূর। সেখান থেকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে তহবিল সংগ্রহ করে তারা ব্যয় করছে জেএমবির পুনর্গঠনে। তাদের মধ্যে নূর অনলাইনে সংগঠনের জন্য সদস্য সংগ্রহ করছে। আবদুর রাকিব বর্তমানে মদিনা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে। বিভিন্ন ইসলামিক এনজিওর মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করে সে। বর্তমানে জেএমবির প্রধান অর্থ পৃষ্ঠপোষকতাকারী রাকিব। প্রতিনিধি নিয়ে নিয়মিত সে বাংলাদেশেও যাতায়াত করে।
একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা সমকালকে জানান, ২০০৫ সালের পর থেকে শায়খ আবদুর রহমানের ঘনিষ্ঠ অন্তত ২৫টি পরিবার দেশ ছেড়েছে। তাদের অনেকে এখন বিদেশে অবস্থান করে জেএমবিকে আর্থিকভাবে পুনর্গঠনে সহায়তা করছে। অনেকে কৌশলে এনজিও তহবিল সংগ্রহ করে ধর্মভিত্তিক প্রতিষ্ঠান তৈরি করছে। এভাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে এসব জায়গায় উগ্রপন্থিদের কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে।
পুরনো জেএমবির সাংগঠনিক কাঠামো দুর্বল। তবে নেটওয়ার্ক কমবেশি সারাদেশেই বিস্তৃত। বর্তমানে জেএমবির সদস্য সংখ্যা প্রায় ৫০০। ভারতে পলাতক সালাউদ্দিন সালেহীন মূলত বর্তমানে জেএমবির নেতৃত্বে রয়েছে। দলটির ৩০০ সদস্য গ্রেফতার হয়ে দেশের বিভিন্ন কারাগারে রয়েছে। তাদের মধ্যে ৭০-৮০ জন উল্লেখযোগ্য জঙ্গির পরিবারের পেছনে সংগঠনটি মাসে গড়ে প্রায় চার লাখ টাকা ব্যয় করে।
একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, জেএমবিতে পারিবারিক বলয় খুব সুসংহত। জেএমবির প্রতিষ্ঠাতা শায়খ আবদুর রহমানের শূরা বোর্ডে ছিল সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাই, সালাউদ্দিন ওরফে সালেহীন, আতাউর রহমান সানি, আবদুল আওয়াল, হাফেজ মাহমুদ ওরফে রাকিব হাসান, খালেদ সাইফুল্লাহ। তাদের মধ্যে আতাউর রহমান শায়খ আবদুর রহমানের ভাই। শায়খ আবদুর রহমানের মেয়ের জামাই আবদুল আওয়াল। তাদের মধ্যে রাকিব 'বন্দুকযুদ্ধে' মারা যায়। সালাউদ্দিন পলাতক। খালেদ সাইফুল্লাহ কারাগারে। এ ছাড়া বাকি তিনজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে। শায়খ আবদুর রহমানের জামাতা শায়খ আবদুল আওয়ালের ভাগিনা নব্য জেএমবির অন্যতম প্রধান সামরিক কমান্ডার রিপন ওরফে মামুনুর রশিদ। রিপন বিয়ে করে জেএমবি নেতা মাওলানা সাইদুর রহমানের স্ত্রীর বড় বোনের মেয়ে কোহিনূর বেগমকে। জেএমবির আরেক নেতা আবেশ রিপনের আপন খালাত ভাই। এ ছাড়া জেএমবি নেতা মাওলানা সাইদুর রহমানের ভায়রা জেএবির 'দায়ী বিভাগে'র প্রধান আনসার ওরফে জুবায়ের। আনসার বর্তমানে পলাতক। বর্তমানে জেএমবির অন্যতম শীর্ষ নেতা কারাবন্দি মুজাহিদ বিয়ে করেছে দলের অন্যতম নেতা মামুনের বোনকে। তবে এরই মধ্যে মামুনের ফাঁসি হয়ে গেছে। মুজাহিদের আরেক ভাই জেএমবির বোমার কারিগর। মুজাহিদের এক বোনও জেএমবি কানেকশনে গ্রেফতার হয়ে বর্তমানে কারাগারে রয়েছে। এ ছাড়া বগুড়ায় বোমা বিস্ফোরণে নিহত জেএমবি নেতা রাইসুল ইসলাম খান ওরফে ফারদিন হলেন মুজাহিদের আপন বোন জামাই। জেএমবি চট্টগ্রাম অঞ্চলের সামরিক কমান্ডার ছিল সে। চট্টগ্রামে বানৌজা ঈশা খাঁ ঘাঁটি মসজিদে বোমা হামলার অন্যতম প্রধান পরিকল্পনাকারী ছিল ফারদিন। দায়িত্বশীল সূত্র জানাচ্ছে, জঙ্গি সংগঠনের সদস্যরা তাদের পরিবারকে মানসিক ও আর্থিকভাবে সহায়তা করে থাকে। প্রতি মাসে চাঁদা তুলে হলেও তারা পরিবার ও সংগঠনের সদস্যদের পাশে দাঁড়ায়। বিয়ের ব্যাপারে উগ্রপন্থি সংগঠনের শীর্ষ নেতারা পারিবারিক বলয় মেনে চলার চেষ্টা করে। তেমনি অর্থ সাহায্য দিয়ে তারা নানাভাবে একে অন্যের পাশে দাঁড়ায়। এ কারণেই বারবার হোঁচট খেলেও ঘুরে দাঁড়াচ্ছে জেএমবি।
দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, জঙ্গি সংগঠনের সদস্য সংগ্রহ ও অর্থায়ন বন্ধ করা না
গেলে জঙ্গিবাদ পুরোপুরি মোকাবেলা করা যাবে না। জঙ্গিবাদ মোকাবেলায় শিক্ষা,
সংস্কৃতি, ধর্ম ও তথ্য মন্ত্রণালয়ের আরও জোরালো ভূমিকা থাকা দরকার।
জনপ্রতিনিধিদেরও জঙ্গিবাদবিরোধী প্রচারণায় আরও সক্রিয় হতে হবে।