ঢাকা মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪

ইউজিসির একই কর্মকর্তার এক মাসে চারবার বিদেশ সফর!

ইউজিসির একই কর্মকর্তার এক মাসে চারবার বিদেশ সফর!

সাব্বির নেওয়াজ

প্রকাশ: ০৫ নভেম্বর ২০১৮ | ২০:১৫ | আপডেট: ০৬ নভেম্বর ২০১৮ | ০৪:০৫

এক মাসে চারবার বিদেশ সফর করে আলোচনায় এসেছেন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) মধ্যম সারির এক কর্মকর্তা। অক্টোবর মাসে মোট চার দফায় তিনি বিভিন্ন দেশ সফরে যান। এর মধ্যে তিনটিই ছিল তার জন্য অপ্রয়োজনীয় সফর। বর্তমানেও বিদেশ সফরে রয়েছেন তিনি। এ কর্মকর্তার নাম মো. শাহীন সিরাজ। তিনি ইউজিসির প্রশাসন শাখার উপসচিব। তিনি মূলত ইউজিসির নিজস্ব কর্মকর্তা।

ইউজিসির প্রশাসন শাখার নথিপত্র থেকে জানা যায়, মো. শাহীন সিরাজ ১ অক্টোবর থেকে ৭ অক্টোবর পর্যন্ত সাত দিন থাইল্যান্ড সফর করেন। তিনি সেখানে বিশ্বব্যাংকের অনুদান সহায়তায় পরিচালিত 'উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়ন প্রকল্প' (হেকেপ)-এর অর্থে একটি প্রশিক্ষণে যান। 'পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন পারফরম্যান্স বেজড ম্যানেজমেন্ট, সিটিজেন চার্টার সার্ভিস' শীর্ষক এ প্রশিক্ষণে ইউজিসি, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, হেকেপসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মোট ২০ জন কর্মকর্তা অংশ নেন। এই প্রশিক্ষণে যান ইআরডির উপসচিব মো. জাহিদ হোসেন মুন্সি, আইএমইডির উপসচিব শেখ মো. আবদুর রহমান, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের উপসচিব জিন্নাত রেহানা, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী প্রধান আসমা নাসরীন, পরিকল্পনা কমিশনের সহকারী প্রধান শাইনি আজিজ, ইউজিসির রিসার্চ সাপোর্ট অ্যান্ড পাবলিকেশন বিভাগের পরিচালক ড. ফেরদৌস জামান, জনসংযোগ বিভাগের পরিচালক ড. একেএম শামসুল আরেফিন, ইউজিসির রিসার্চ সাপোর্ট অ্যান্ড পাবলিকেশন বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক ওমর ফারুখ, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বিভাগের উপপরিচালক জেসমিন পারভীন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ম্যানেজমেন্ট বিভাগের উপপরিচালক নাজমুল ইসলামসহ ইউজিসি ও হেকেপের আরও কর্মকর্তারা।

৭ অক্টোবর দেশে ফিরেই শাহীন সিরাজ পরদিন ৮ অক্টোবর ভারতের পাঞ্জাবের উদ্দেশে উড়াল দেন। সেখানে তিনি ১২ অক্টোবর পর্যন্ত 'লাভলি প্রফেশনাল ইউনিভার্সিটি' নামে একটি  বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সফর করেন। জানা গেছে, এই সফরে আরও অংশ নেন ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান, সচিব মো. খালেদ, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শাখার পরিচালক মো. ফখরুল ইসলাম।

এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে বাংলাদেশের শিক্ষা ও গবেষণা সুযোগ বিনিময় নিয়ে আলোচনা করা হয়। সেখানে অনুষ্ঠিত এক সভায় স্কলারশিপ, ফেলোশিপ, একাডেমিক এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রাম এবং উচ্চশিক্ষায় সহযোগিতা বিষয়ে আলোচনা হয়। তবে এ সফরে শাহীন সিরাজের ভুমিকা কী, তা নিয়ে ইউজিসির কর্মকর্তাদের মধ্যে ব্যাপক আলোচনা রয়েছে।

এ সফর থেকে ফিরে শাহীন সিরাজ ইউজিসি চেয়ারম্যানের সঙ্গী হয়ে ২৫ থেকে ২৭ অক্টোবর পর্যন্ত তৃতীয় দফায় সফরে যান ভারতের মেঘালয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে। ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নানকে সেখানে সম্মানসূচক 'ডিলিট' উপাধি দেয় ভারতের মেঘালয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (ইউএসটিএম)। আসামের গৌহাটিতে একটি হোটেলে বিশ্ববিদ্যালয়টির বিশেষ সমাবর্তন অনুষ্ঠানে এ সম্মানে ভূষিত করা হয় তাকে। বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষায় অনন্য অবদানের জন্য তিনি এ উপাধি লাভ করেন। শাহীন সিরাজ এ অনুষ্ঠানে অংশ নেন।

ইউজিসি সূত্র জানায়, অক্টোবর মাসে চতুর্থ দফায় তিনি সফরে যান মালয়েশিয়ায়। ২৯ অক্টোবর থেকে আগামী ৬ নভেম্বর পর্যন্ত তিনি একটি শিক্ষা সফরে সেখানে বর্তমানে অংশ নিচ্ছেন। ইউজিসির সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, এটি অনেকটা প্রণোদনা ভ্রমণ। এ সফরে ইউজিসির সচিব মো. খালেদ, পরিচালক ফখরুল ইসলাম, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দু'জন কর্মকর্তাসহ মোট ১৬ জন কর্মকর্তা অংশ নিচ্ছেন।

ইউজিসির একাধিক কর্মকর্তা জানান, এক মাসে একজন কর্মকর্তার চারবার বিদেশ সফর ইউজিসির ইতিহাসে নজিরবিহীন। এ ছাড়া প্রথম প্রশিক্ষণ ছাড়া বাকি তিনটি সফরে উপসচিব শাহীন সিরাজের অংশ নেওয়ার কোনো প্রয়োজন ছিল না। এটি সরকারি অর্থের অপচয়মাত্র। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দু'জন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, ইউজিসির বর্তমান প্রশাসনের ঘনিষ্ঠ হওয়ায় শাহীন সিরাজ এক মাসে এতবার বিদেশ সফরের এই অনৈতিক সুবিধা পেয়েছেন। জানা গেছে, প্রশাসন শাখার কর্মকর্তা হলেও তিনি সেখানে কাজ করেন না। ইউজিসি চেয়ারম্যানের একান্ত সচিব (পিএস) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। অথচ ইউজিসি চেয়ারম্যানের পিএস হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন নাজমুল ইসলাম। তিনি একদিনের জন্যও এ পদে দায়িত্ব পালন করতে পারেননি। নাজমুল ইসলামকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ম্যানেজমেন্ট বিভাগের উপপরিচালক পদে দায়িত্ব পালন করতে পাঠানো হয়। চেয়ারম্যানের পিএস পদের প্রভাব খাটিয়ে শাহীন সিরাজের বিরুদ্ধে বিভিন্ন পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের আত্মীয়স্বজনকে চাকরি দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।

এক মাসে চারবার বিদেশ সফর বিষয়ে জানতে চাইলে শাহীন সিরাজ সমকালকে জানান, তিনি নিজের ইচ্ছায় কোনো সফর করেন না। অফিস তাকে পাঠালে তিনি সেখানে যান। কোনো কর্মকর্তা নিজের ইচ্ছায় কোথাও সফরে যেতে পারেন কি? তিনি আরও জানান, তার বিরুদ্ধে প্রভাব খাটানোর অভিযোগ সত্য নয়। তিনি তার আত্মীয়স্বজনকে কোথাও চাকরিও দেননি।

ইউজিসি থেকে জানা গেছে, শিগগিরই ইউজিসি সদস্য অধ্যাপক ইউসুফ আলী মোল্লার নেতৃত্বে কর্মকর্তাদের আরেকটি দল মালয়েশিয়া সফরে যাচ্ছে। এতে ইউজিসির অপর সদস্য অধ্যাপক মো. আখতার হোসেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ম্যানেজমেন্ট বিভাগের পরিচালক কামাল হোসেন, রিসার্চ সাপোর্ট অ্যান্ড পাবলিকেশন বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক ওমর ফারুখ, উপপরিচালক নাহিদ সুলতানা, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের উপসচিব জিন্নাত রেহানাসহ মোট ২৪ জন এ সফরে যাচ্ছেন। আগামী ২৪ নভেম্বর তাদের মালয়েশিয়া সফরে যাওয়ার কথা রয়েছে।

জানা গেছে, সাম্প্রতিক সময়ে ইউজিসিতে বিদেশ সফরের হিড়িক পড়েছে। গত বছর হেকেপের অর্থায়নে অস্ট্রেলিয়ায় প্রশিক্ষণে যাওয়া ৬২ জনের মধ্যে ৩২ জনই ছিলেন জুনিয়র কর্মকর্তা। বিদেশে প্রশিক্ষণের শর্ত পূরণ না করেই সুযোগ পান তারা। এ ধরনের প্রশিক্ষণ শিক্ষার উন্নয়নে কোনোভাবেই কাজে আসছে না বলে জানিয়েছে ইউজিসির এক নির্ভরযোগ্য সূত্র।

হেকেপ সূত্র জানায়, প্রকল্পের আরডিপিপি অনুযায়ী, উচ্চশিক্ষায় নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের এসব প্রশিক্ষণে যাওয়ার কথা বলা হলেও তারা সব সময় থাকেন উপেক্ষিত। উচ্চশিক্ষার নানা প্রশিক্ষণ ও ট্যুরে ইউজিসির সঙ্গে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ইআরডি, আইএমইডি থেকে অনেক কর্মকর্তা অহরহ অংশ নেন। বৈদেশিক ঋণের অর্থে চলা এসব প্রকল্পের টাকায় এমন অনেক কর্মকর্তাও বিদেশ সফরে যান, যারা কোনোভাবেই উচ্চশিক্ষার সঙ্গে জড়িত নন।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, হেকেপ প্রকল্প শেষ হবে চলতি ২০১৮ সালে। এই প্রকল্পের ব্যয় প্রায় দুই হাজার ৫৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২৬২ কোটি টাকা দিচ্ছে সরকার। আর বাকি সবই বিশ্বব্যাংকের ঋণ।

সার্বিক বিষয়ে ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নানের বক্তব্য জানতে যোগযোগ করা হলেও পাওয়া সম্ভব হয়নি তাকে। জানা গেছে, তিনি বর্তমানে মালয়েশিয়া সফরে রয়েছেন।

আরও পড়ুন

×