ঢাকা মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪

দিনে ড্রাইভার রাতে কিলার

দিনে ড্রাইভার রাতে কিলার

সাহাদাত হোসেন পরশ

প্রকাশ: ১৯ মে ২০১৮ | ২০:১১ | আপডেট: ২০ মে ২০১৮ | ০৭:৫২

সোহেলের গ্রামের বাড়ি বরিশালের কোতোয়ালির সাহেবের হাটে। তিনি আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের শিক্ষক ফ্রান্সের নাগরিক ক্রিস্টোফার বাউচারের গাড়িচালক। বাউচারের স্ত্রী গীতা শ্রীলংকার নাগরিক। মাসে ১৫ হাজার টাকা বেতনে সোহেলের পেশা দিনে গাড়ি চালানো হলেও রাতে কন্ট্রাক্ট কিলার হিসেবে কাজ করত সে। একইভাবে সোহেলের ঘনিষ্ঠ বন্ধু রাসেলও পেশায় গাড়িচালক। তার গ্রামের বাড়ি বরিশালের মুলাদির খাসেরহাট। যমুনা ব্যাংকের একটি ব্রাঞ্চের ম্যানেজারের গাড়িচালক ছিল রাসেল। তবে সোহেলের মতো সেও ভাড়াটে খুনি।

সর্বশেষ গত ৯ মে রাতে ডিশ ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বাড্ডায় গুলি করে হত্যা করা হয় আবদুর রাজ্জাক বাবু ওরফে 'ডিশ বাবুকে'। এ হত্যাকাণ্ড ছাড়াও বাড্ডায় আরও দুটি খুনে ভাড়াটে কিলার হিসেবে কাজ করে সোহেল-রাসেল। এ ছাড়া চাঁদার দাবিতে ফেব্রুয়ারিতে তারা ধানমণ্ডির ২৭ নম্বরে এক ব্যবসায়ীর বাসার সামনে গুলি করে। আর বাড্ডা এলাকার আন্ডারওয়ার্ল্ড নিয়ন্ত্রণ নিয়ে প্রতিপক্ষকে গুলি করা তাদের প্রায় নিয়মিত কাজ ছিল। আদালতে দেওয়া সোহেল-রাসেলের ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি ও পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে এসব তথ্য উঠে আসে।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে এসেছে ডিশ বাবু হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িত ছিল সাফায়েত হোসেন তামরিন ওরফে রানা ওরফে তানভীর ওরফে রনি, সোহেল ও রাসেল। এরই মধ্যে তানভীর ডিবির সঙ্গে 'বন্দুকযুদ্ধে' নিহত হয়েছে। এ ছাড়া ডিশ বাবু হত্যার পরপরই হাতেনাতে গ্রেফতার সোহেল ও রাসেলকে রিমান্ডে নিয়ে বাবু হত্যা মামলায় জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার জবানবন্দি দেওয়ার পর বর্তমানে তারা কারাবন্দি।

তদন্ত-সংশ্নিষ্ট সূত্র জানায়, সোহেল জবানবন্দিতে জানায়, ১৭ বছর ধরে বাড্ডায় বসবাস করে আসছে সোহেল। রাসেলের বাসাও বাড্ডায়। বছর দশেক ধরে তাদের মাঝে বন্ধুত্ব। ক্যারম ও ক্রিকেট খেলার সূত্র ধরে আট বছর আগে তানভীরের সঙ্গে সোহেলের পরিচয়। মাস চারেক আগে হঠাৎ তানভীর ফোন করে সোহেলকে। গত ৭ মে তানভীর ফোন করে সোহেলকে বাড্ডার গুদারাঘাটে দেখা করতে বলে। ওই দিন সোহেল গাড়ি চালানো শেষে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে গুদারাঘাট যায়। সেখানে গিয়ে দেখে তানভীর ও উৎসব নামে দু'জন দুটি ব্যাগ কাঁধে নিয়ে তার জন্য অপেক্ষা করছে। কিছু সময় পর তাকে অপেক্ষা করার কথা বলে তারা চলে যায়। ১০ মিনিট পর উৎসব এসে সোহেলকে বৈশাখী সরণির একটি বাসায় নিয়ে যান। ওই বাসায় গিয়ে দেখে তানভীর ছাড়াও শুভ ও আদনান নামে আরও দু'জন বসে আছে। কিছু সময় পর তানভীর দুটি ব্যাগ এনে তার ভেতর থেকে একে একে পাঁচটি অস্ত্র বের করে। তখন তানভীর তাকে জানায়, উজ্জল নামে একজন তার সঙ্গে 'ফাউল' করছে; তাকে শায়েস্তা করতে হবে। সাড়ে ১০টা পর্যন্ত সেখানে অবস্থানের পর তানভীরের নির্দেশে নিজ বাসায় ফিরে আসে সোহেল।

পরদিন সকাল সাড়ে ১০টায় তানভীর ফোনে তাকে জানায়, রাসেলের সঙ্গে সব কথা হয়েছে। এরপর ওই দিন সন্ধ্যার পর তানভীরের সঙ্গে দেখা করতে বলা হয়। ওই নির্দেশনা অনুযায়ী ৮ মে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে রাসেলকে নিয়ে বৈশাখী সরণির বাসায় যায় সোহেল। রাতে তানভীর একটি ব্যাগ থেকে বের করে রাসেলের হাতে দুটি, সোহেলকে একটি ও তানভীর নিজে তিনটি অস্ত্র রাখে। সেখানে তানভীরের ঘনিষ্ঠ শুভও উপস্থিত ছিলেন। হঠাৎ শুভর মোবাইল ফোনে একটি কল আসে। ওই ফোন থেকে আসা কথা শেষ হওয়ার পরই কালো রঙের একটি পালসার মোটরসাইকেলে সোহেল, রাসেল ও তানভীর চড়ে বসে। মোটরসাইকেল চালাচ্ছিলেন সোহেল। তানভীর প্রথমে নির্দেশ দেয় বাড্ডার জাগরণী ক্লাবে যেতে। সেখানে পৌঁছার আগেই তার মোবাইল ফোনে আবারও কল আসে। ওই ফোন আসার পর পরই তানভীর মোটরসাইকেল ঘুরিয়ে পুনরায় বৈশাখী সরণির বাসায় ফেরত যেতে নির্দেশ দেয়। সেখানে যাওয়ার পর সবার সঙ্গে থাকা অস্ত্র একটি বাসায় রেখে যে যার মতো চলে যায়। যাওয়ার সময় সোহেলকে ৫০০ টাকা দেয় তানভীর। পরদিন সকালে তানভীর আবার সোহেলকে ফোন করে বিকেল সাড়ে ৫টার মধ্যে রাসেলকে নিয়ে গুদারাঘাট যেতে বলে। গাড়ি চালানো শেষে ওই দিন সন্ধ্যার পর রাসেলকে নিয়ে তানভীরের সঙ্গে দেখা করতে যায় সোহেল। আগের দিনের মতোই সোহেল ও রাসেলের হাতে এবং নিজেও পিস্তল তুলে নেয় তানভীর। পরে একটি মোটরসাইকেলে রাত ৯টার দিকে জাগরণী ক্লাবের দিকে যায় তারা। ক্লাবের মাঠে ঢোকার পর পরই তানভীর মোটরসাইকেল থেকে নেমে পড়ে। ওই সময় মাঠের পশ্চিম-উত্তর কোনায় কদম গাছের নিচে পাঁচ-ছয়জন চেয়ারে বসা ছিল। তাদের মধ্যে থেকে টার্গেট করে ডিশ বাবুকে গুলি করতে থাকে তানভীর। রাসেলও গাড়ি থেকে নেমে এলোপাতাড়ি গুলি করতে থাকে। মিশন শেষে তারা যখন এলাকা ত্যাগ করছিল তখন বাড্ডার আলাতুননেছা স্কুলের সামনে মোটরসাইকেল বন্ধ হয়ে যায়। তখনই এলাকাবাসী ধাওয়া করে তানভীর, রাসেল ও সোহেলকে আটক করে পুলিশের কাছে সোপর্দ করে।

এ ব্যাপারে ডিবির উত্তর বিভাগের ডিসি মশিউর রহমান সমকালকে বলেন, এখন পর্যন্ত ডিশ বাবুসহ তিনটি হত্যার সঙ্গে প্রাইভেটকার চালক সোহেল ও রাসেলের সম্পৃক্ততার তথ্য পাওয়া গেছে। মূলত ভাড়াটে কিলার হিসেবে তারা কাজ করে আসছিল।

তদন্ত-সংশ্নিষ্ট সূত্র জানায়, ২০১৫ সালে ৩ মে বাড্ডা জাগরণী সংসদ ক্লাবে আফতাবনগর পশুর হাটের ৬০ লাখ টাকা চাঁদার ভাগবাটোয়ারা নিয়ে স্থানীয় চাঁদাবাজ গ্রুপগুলোর বৈঠক হয়। বৈঠক চলাকালে সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন বাড্ডা থানা ছাত্রলীগের সহসভাপতি মোফাজ্জল হোসেন রাহিন। ওই হত্যাকাণ্ডে সোহেল-রাসেলের জড়িত থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। এ ছাড়া বিদেশে পলাতক সন্ত্রাসী রবিন, ডালিম, মেহেদী ও নাহিদের হয়ে বাড্ডায় অপরাধ জগৎ নিয়ন্ত্রণ করে আসছিল তারা। মূলত তারা শুটার হিসেবে দায়িত্ব পালন করত। আবার কখনও বড় বড় ছিনতাই-অপারেশনে তারা অস্ত্র নিয়ে হাজির থাকত। চাঁদার জন্য ভয় দেখাতে হলে তারা গুলি করে আসত। এর বিনিময়ে তারা বিদেশে পলাতক সন্ত্রাসীদের কাছে মাসে মোটা অঙ্কের টাকা পেতেন। এরই মধ্যে সোহেল ও রাসেলের ব্যবহূত দুটি বিদেশি পিস্তল জব্দ করেছে।

আরও পড়ুন

×