মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে ইশতিয়াক-পাপিয়া
মোহাম্মদপুর জেনেভা ক্যাম্প
ইন্দ্রজিৎ সরকার
প্রকাশ: ২৩ মে ২০১৮ | ১৯:৩৪
মোহাম্মদপুর জেনেভা ক্যাম্পের বোবা বিরিয়ানির গলি। দুই পাশে নানা রকম
দোকানপাট। গলির মুখে বাবর রোডের পাশের বন্ধ দোকানের সামনে বসে আছে দুই
যুবক। সতর্ক দৃষ্টি রাখছে চারপাশে। এর মধ্যে এক শিশু এসে তাদের একজনকে কিছু
টাকা দিয়ে চলে গেল। পরক্ষণে গলির ভেতরে ঢুকে গেল তারা। সঙ্গে থাকা স্থানীয়
এক বাসিন্দা জানালেন, ওই দু'জন হলো ইয়াবার খুচরা বিক্রেতা। আইন-শৃঙ্খলা
রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিতে তারা কৌশলে শিশুদের ব্যবহার করছে।
ক্রেতার কাছ থেকে টাকা নিয়ে আসা এবং পরে ইয়াবা পৌঁছে দেওয়ার কাজটি করানো
হচ্ছে শিশুদের দিয়ে। তবে এ চিত্র দিনের। সন্ধ্যার পর সেখানে মাদক ব্যবসা
হয়ে যায় 'ওপেন সিক্রেট'। রীতিমতো ফেরি করে বিক্রি হয় ইয়াবা-গাঁজা। সরেজমিনে
রাজধানীর মোহাম্মদপুরের সবচেয়ে বড় মাদকস্পট জেনেভা ক্যাম্পে গিয়ে জানা
গেছে এসব তথ্য।
সংশ্নিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, জেনেভা ক্যাম্পের মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছেন
দু'জন 'গডফাদার'। তারা হলেন ইশতিয়াক ও পাপিয়া। তাদের মধ্যে ইশতিয়াক তার
বাহিনীর লোকজনকে দিয়ে মাদক বেচে রীতিমতো কোটিপতি বনে গেছেন। তিনি ক্যাম্পে
থাকেন না। তার অন্যতম সহযোগী নাদিম ওরফে পঁচিশ, মোল্লা আরশাদ ও তানভীর
আদনান ক্যাম্পসহ আশপাশের এলাকায় মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন। আর পাপিয়া ও
তার স্বামী পাঁচু মিলে চালান মাদকের আরেকটি চক্র। অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় ৩২
নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান মিজান শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ীদের থেকে
নিয়মিত মোটা অঙ্কের টাকা পান।
পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার সমকালকে বলেন,
জেনেভা ক্যাম্পে নিয়মিত অভিযান চালিয়ে মাদক ব্যবসায়ীদের গ্রেফতার ও
মাদকদ্রব্য জব্দ করা হচ্ছে। শুধু এখন নয়, কয়েক বছর ধরেই এখানকার মাদক
ব্যবসা বন্ধে কঠোর অবস্থানে রয়েছে পুলিশ। কাউন্সিলরের সংশ্নিষ্টতার অভিযোগ
প্রসঙ্গে এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, অতীতে তার বিরুদ্ধে কিছু অভিযোগ ছিল।
তবে বর্তমানে তিনি নিজেই পুলিশের মাদকবিরোধী কার্যক্রমে সহায়তা করছেন।
জেনেভা ক্যাম্পের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, একসময় সব ধরনের
মাদকের আখড়া থাকলেও এখন ক্যাম্পে মূলত ইয়াবা পাইকারি ও খুচরা বিক্রি হয়।
কারণ ইয়াবার চাহিদাই সবচেয়ে বেশি। গাঁজার চাহিদাও কিছুটা রয়েছে। এর বাইরে
ক্রেতা চাইলে যে কোনো মাদক সরবরাহ করেন ব্যবসায়ীরা। পাকা ক্যাম্পের 'এ' ও
'বি' ব্লকের প্রথম অংশে সাকিল বুকস্ থেকে সিডির দোকান পর্যন্ত এলাকায় মাদক
ব্যবসায়ীদের আনাগোনা বেশি। পুরো ক্যাম্পজুড়ে মাদকের খুচরা বিক্রেতার
সংখ্যা প্রায় ৩০০। পাইকারি ব্যবসায়ী অবশ্য হাতেগোনা। এর মধ্যে অন্যতম হলেন
ইশতিয়াক। তিনি সরাসরি মিয়ানমার থেকে ইয়াবার চালান নিয়ে আসেন বলে জানা গেছে।
তার সহযোগীদের মধ্যে শুধু পঁচিশের অধীনেই আছে প্রায় একশ' বিক্রেতা। এক
বিক্রেতার সঙ্গে ক্রেতা পরিচয়ে কথা বলে জানা গেল, নাদিমের কাছ থেকে কমপক্ষে
৫০ পিস ইয়াবা কিনলে তা পাইকারি দরে পাওয়া যায়। প্রতি পিসের দাম ৯০ থেকে
১১০ টাকা। সেগুলো ক্রেতাপর্যায়ে ২০০-২৫০ টাকায় বিক্রি হয়। কিছুদিন আগে
গ্রেফতারের পর সম্প্রতি জামিনে মুক্ত হন নাদিম। মাদকবিরোধী অভিযান শুরুর পর
তাকে ক্যাম্পে কম দেখা গেলেও বিক্রেতারা সক্রিয় রয়েছেন। মাদকসম্রাট
ইশতিয়াকের হয়ে তানভীর আদনান ও মোল্লা আরশাদও ক্যাম্পের মাদক ব্যবসা
পরিচালনা করেন।
স্থানীয় সূত্র জানায়, মাদক বিক্রির টাকায় হেমায়েতপুরে প্রচুর পরিমাণ জমি
কিনেছেন ইশতিয়াক। সেখানে একটি ডুপ্লেক্স ছাড়াও আশুলিয়ার গাজীরচট ও
বেড়িবাঁধের পাশে তার দুটি বাড়ি রয়েছে। উত্তরাতেও তার একাধিক ফ্ল্যাট থাকার
তথ্য দিলেন কেউ কেউ। তার বিলাসবহুল ব্যক্তিগত গাড়ি ও একজন ব্যক্তিগত
সহকারীও রয়েছে। আরেক পাইকারি বিক্রেতা পাপিয়াও মাঝে গ্রেফতার হয়ে কারাগারে
ছিলেন। তখন তার হয়ে মাদক সাম্রাজ্য চালিয়েছেন তার ভাইয়েরা। তবে জামিনে
মুক্ত হওয়ার পর পাপিয়া আবারও হাল ধরেছেন। সঙ্গে বরাবরের মতোই রয়েছেন তার
স্বামী পাঁচু ও ভগ্নিপতি ইরফান। ক্যাম্পের বাসিন্দারা জানালেন, পাপিয়া ভালো
পরিবারের মেয়ে। উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়ালেখাও করেছেন। এ সময় তার সঙ্গে
প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে মাদক ব্যবসায়ী পাঁচুর। তারা বিয়ে করেন। এরপর
দু'জনে মিলেই শুরু করেন মাদক ব্যবসা।
এদিকে শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ীদের অধীনে থাকা খুচরা বিক্রেতাদের মধ্যে রয়েছেন
চুয়া সেলিম, টেরু সেলিম, হাতকাটা নাঈম, পেলু আরমান, আলমগীর উল্টা সালাম,
বেজি নাদিম, মোল্লা আনোয়ার ও ঢাকাইয়া নাদিম। নারী বিক্রেতাদের মধ্যে রয়েছেন
সীমা, নার্গিস, সয়রা, গান্নী, কালী রানী, বেচনি, সকিনা, কুলসুম ও রেশমা।
স্পটে বিক্রির পাশাপাশি 'হোম ডেলিভারি সার্ভিস'ও চালু করেছে তারা। ক্রেতারা
ফোনে অর্ডার দিলে নির্দিষ্ট ঠিকানায় পৌঁছে যায় ইয়াবা বা গাঁজা। মাঝে মাঝে
ক্যাম্পে অভিযান চালানো হলে এই ব্যবস্থা আরও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
স্থানীয় সূত্র জানায়, রাজনৈতিক দল ও বিহারি সংগঠনগুলোর কয়েকজন নেতাকর্মীর
ছত্রছায়ায় চলে এ মাদক ব্যবসা। তাদের মধ্যে স্থানীয় কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান
মিজানেরও সংশ্নিষ্টতার অভিযোগ রয়েছে। সূত্র বলছে, তার হয়ে ব্যক্তিগত
সহকারী মর্তুজা আহমেদ খান ও সৈয়দ সাঈদ ওরফে মাছুয়া সাঈদ মাদক ব্যবসায়ীদের
কাছ থেকে টাকা তোলেন। সাঈদ অবশ্য সম্প্রতি মাদকবিরোধী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে
নামকাওয়াস্তে যুক্ত হয়েছেন।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৩২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান মিজান
বর্তমানে সৌদি আরবে রয়েছেন। তবে এর আগে একই প্রসঙ্গে তিনি সমকালকে বলেন,
মাদক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে তার কোনো যোগসাজশ নেই। তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও
ক্যাম্পের কিছু লোকজন এসব অপপ্রচার চালায়।
কাউন্সিলরের ব্যক্তিগত সহকারী মর্তুজা আহমেদ খান বলেন, কাউন্সিলর ও তার
নিজের মাদক ব্যবসার সঙ্গে কোনো সম্পৃক্ততা নেই। বরং তারা মাদক প্রতিরোধে
কাজ করছেন। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে কিছু লোক তাদের বিরুদ্ধে অপবাদ দিচ্ছেন। আর
সৈয়দ সাঈদ আগে মাদক ব্যবসায় সম্পৃক্ত থাকলেও কাউন্সিলরের সংস্পর্শে এসে
তিনিও ভালো হয়ে গেছেন।
এ বিষয়ে জানতে সৈয়দ সাঈদের সঙ্গে একাধিকবার মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তিনি সাড়া দেননি।
এ ছাড়া জেনেভা ক্যাম্প রিলিফ কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম জিলানীর
বিরুদ্ধেও মাদক ব্যবসায় সম্পৃক্ততার অভিযোগ রয়েছে। গত বছর পুলিশ মাদকসহ
গোলাম জিলানী ও তার ছেলে গোলাম রব্বানীকে গ্রেফতার করে। মাদক ব্যবসায়ীদের
মদদদাতাদের মধ্যে বিহারিদের সংগঠন এসপিজিআরসি ও ইউএসপিওয়াইআরএমের সাবেক
নেতা ইকবাল আহমেদও রয়েছেন। মাদক ব্যবসায় সম্পৃক্ততার কারণে তাকে দুই সংগঠন
থেকেই বহিস্কার করা হয়। মাদক ব্যবসায়ীদের কাউকে পুলিশ ধরলে তিনি তদবির করে
ছাড়িয়ে আনেন। বিনিময়ে টাকা নেন মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে। পুলিশের পক্ষ
থেকেও ক্যাম্প থেকে চাঁদা আদায়ের অভিযোগ রয়েছে।
জেনেভা ক্যাম্প নন লোকাল রিলিফ কমিটির চেয়ারম্যান এস এম সীমা কোরায়শী বলেন,
অভিযান শুরু হলে মাদক ব্যবসায়ীরা গা-ঢাকা দেয়। তবে কয়েকদিন পরই ফিরে আসে।
এখানকার কমিউনিটি পুলিশিং কমিটিতে জায়গা পেয়েছে চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ীরা।
চুনোপুঁটি দু-একজনকে পুলিশে ধরিয়ে দিয়ে তারা আড়াল করছে বড় মাদক
ব্যবসায়ীদের।