ঢাকা মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪

অবাধেই চলছে মাদক কেনাবেচা

অবাধেই চলছে মাদক কেনাবেচা

বকুল আহমেদ

প্রকাশ: ২৫ মে ২০১৮ | ১৯:৩১

কড়াইল বস্তির বেলতলা থেকে স্যাটেলাইট বস্তির দিকে যেতে মাঝখানে একটি কালভার্ট। এর নিচ দিয়ে বয়ে গেছে একটি সরু খাল। কালভার্টটি 'বেলতলা ব্রিজপাড়' নামে পরিচিত। খালের পাশেই লাল-সবুজ রঙের জার্সি পরা এক যুবক দাঁড়িয়ে। মাঝেমধ্যে বিভিন্ন বয়সী মানুষ তার কাছে যাচ্ছে এবং কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ওই যুবক পকেট থেকে বের করে টাকার বিনিময়ে তাদের হাতে তুলে দিচ্ছে ইয়াবা ট্যাবলেট। এই চিত্র গতকাল শুক্রবার দুপুরের। পরে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, যুবকের নাম স্বপন।

কড়াইল বস্তির রাতের চিত্রও অভিন্ন। বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে গোডাউন বস্তির মসজিদের সামনের সড়কের পাশে ভ্যানে বসেছিলেন বীণা নামে এক নারী। তার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন রুবেল ও রোমান নামে দুই তরুণ। লোকজন তাদের কাছ থেকে গাঁজার পুরিয়া কিনে নিয়ে যাচ্ছে। রাস্তায় দাঁড়িয়েই এই দৃশ্য দেখা যায়। কৌতূহল জাগল ক্রেতা সেজে ওদের সঙ্গে কথা বলার। কিন্তু তারা নতুন মুখের কাছে গাঁজা বিক্রি করতে রাজি হন না, তা আগে থেকেই জানা ছিল। এ কারণেই একজন মাদকসেবীর সহায়তায় তাদের কাছে গিয়ে ৭০ টাকার গাঁজা কেনা হয়। প্রকাশ্যে গাঁজা বিক্রি করছেন, পুলিশ ধরবে না? এমন প্রশ্ন করা মাত্রই বীণা বললেন, 'মাল পাইছেন, চলে যান। ওসব জেনে লাভ নেই।'

এর পরই তিনি উল্টো প্রশ্ন ছুড়লেন- "পুলিশ 'ম্যানেজ' না থাকলে কারও বাবার ক্ষমতা আছে এই বস্তিতে ইয়াবা-গাঁজা বিক্রি করার?" কথা না বাড়িয়ে সেখান থেকে চলে আসি। বীণার কাছ থেকে কেনা গাঁজা ফেলে দিই রাস্তার পাশে।

রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাদকবিরোধী যুদ্ধের মধ্যে বনানী থানার কড়াইলের বিভিন্ন বস্তিতে প্রকাশ্যে সড়কের পাশে মাদকদ্রব্য বেচাকেনা অবাক করার মতই ঘটনা। এসব মাদক ব্যবসায়ীর মধ্যে ভয়-ভীতির ছাপ নেই।

তাহলে কী মাদকবিরোধী বিশেষ অভিযানের খবর ওই এলাকায় পৌঁছায়নি। নাকি বীণার মতো সবাই পুলিশকে 'ম্যানেজ' করেই চালাচ্ছে মাদক ব্যবসা? নাকি তারা এসব অভিযানকে পাত্তাই দিচ্ছে না। অবশ্য কড়াইল এলাকায় সরেজমিন অনুসন্ধানে বনানী থানার কয়েক পুলিশ সদস্যের কথা উঠে এসেছে। এর মধ্যে অন্যতম বনানী থানার এসআই আবু তাহের। তিনি কড়াইল বিট ইনচার্জ। মাদক ব্যবসায়ীদের কারও কারও কাছে তিনি 'ম্যানেজ' হয়ে থাকেন বলে জানিয়েছেন একাধিক মাদকসেবী এবং এলাকার সাধারণ মানুষ। ইয়াবা, গাঁজাসহ বিক্রেতা ও ক্রেতা ধরার পর ঘুষ নিয়ে ছেড়ে দেওয়ার অভিযোগও পাওয়া গেছে তার বিরুদ্ধে। এলাকাবাসী বলছেন, কারা মাদক ব্যবসায়ী, কারা সেবনকারী সবই পুলিশ জানে। পুলিশ ইচ্ছা করলে বস্তিতে মাদক নির্মূল সম্ভব।

অভিযোগ অস্বীকার করেছেন আবু তাহের। গতকাল বিকেলে ফোনে তার কাছে অভিযোগে বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'একসময় কড়াইলে মাদক ব্যবসায়ী অনেক ছিল। আমি বিট ইনচার্জ হওয়ার পর কমিয়ে নিয়ে এসেছি। যদি টাকা নিতাম, তাহলে কি ইয়াবা-গাঁজাসহ ব্যবসায়ীদের ধরতাম? আমি মাদকবিরোধী অভিযানের জন্য ডিএমপি থেকে পুরস্কার পেয়েছি। আল্লাহকে হাজির-নাজিল করে বলতে পারি, এ ধরনের অভিযোগ সত্য নয়। আমি আপ্রাণ চেষ্টা করছি মাদক নির্মূলে।'

আপনার চেষ্টার মধ্যেও প্রকাশ্যে কীভাবে মাদকদ্রব্য বিক্রি হচ্ছে- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'প্রকাশ্যে মাদক বিক্রি হচ্ছে না।' তাকে জানানো হয়- বৃহস্পতিবার রাতে ও শুক্রবার দুপুরে ইয়াবা-গাঁজা বিক্রির দৃশ্য দেখা গেছে। এরপর তিনি বলেন, ' আমি তো সারাক্ষণ ওই এলাকায় থাকি না।'

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মাদকবিরোধী অভিযান ঘোষণার পর থেকেই সারাদেশে র‌্যাব-পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর বিশেষ অভিযান শুরু করেছে। মাদক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে র‌্যাব-পুলিশের 'বন্দুকযুদ্ধে' নিহতের বহু ঘটনাও ঘটছে। বর্তমানে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রধান লক্ষ্য মাদক নির্মূল করা। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নিরাপত্তা বাহিনীর কর্তারা বলছেন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কেউ মাদকের সঙ্গে জড়িত থাকলে তার বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সরেজমিন ঘুরে জানা গেছে, বস্তির একেক এলাকার মাদক একেকজন নিয়ন্ত্রণ করে। এ ছাড়া সংঘবদ্ধ মাদক ব্যবসায়ীও রয়েছে। কাসেম ওরফে বাবা কাসেম কড়াইলের ইয়াবা ব্যবসার অন্যতম নিয়ন্ত্রক। বউবাজার বস্তির ইয়াবার বড় ব্যবসায়ীর মধ্যে রয়েছে- হারুন মিয়া, তার শ্যালক গুড্ডু ও সজীব, ইউসুফ কাজীর ছেলে মেহেদী হাসান অপু, লাল চাঁন, মাছ বাজারের ওসমানের ছেলে আফাজ ও আসেক, ঝিলপাড়ের চিরতার ছেলে ইব্রাহিম, সাইদুল ইসলাম, ক ব্লকের জসিম ও তার বোন পারভীন ও বউবাজার খামারবাড়ির শাহীন। বাবু ও ইমন নামে দু'জন তাদের অনেককে নিয়ন্ত্রণ করে বলে জানা গেছে।

মাদক ব্যবসার অভিযোগে জোছনা নামে এক নারীকে প্রায় দুই বছর আগে কড়াইলের টিঅ্যান্ডটি বস্তি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল কড়াইল মাদক প্রতিরোধ কমিটি। বর্তমানে নাখালপাড়ায় থাকেন তিনি। সেখান থেকেই কড়াইল বস্তির একাংশের ইয়াবা ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছেন তিনি এবং তার দ্বিতীয় স্বামী শাওন। মাঝেমধ্যে ইয়াবা নিয়ে বোরকা পরে বস্তিতে আসেন জোছনা। গ ব্লকের রীনা ও তার স্বামী সোহেল ইয়াবার অন্যতম ডিলার। তারা টিঅ্যান্ডটির ওয়্যারলেস কলোনীতে থাকেন। কয়েক দিন আগে তারা গ্রেফতার হয়েছেন। রীনার দুই ছেলেও তার ব্যবসায় সহায়তা করে। বেদে বস্তিতে পুলিশের সোর্স হিসেবে পরিচিত শহীদ ও তার ভাগ্নে হৃদয় ইয়াবার বড় কারবারি। বেদে বস্তির সিলেট হোটেলের পাশে তাদের ঘরে বসেই তারা ইয়াবা বিক্রি করে।

নাসির ও বশির দু'ভাই কড়াইলের বিভিন্ন এলাকায় ইয়াবা পাইকারি বিক্রি করে। তারা কক্সবাজার থেকে ইয়াবার চালান নিয়ে আসে। সম্প্রতি ইয়াবাসহ যাত্রাবাড়ী এলাকায় তারা গ্রেফতার হয়েছে। স্যাটেলাইট বস্তি এলাকায় স্থানীয় শ্রমিক লীগের নেত্রী তাছলি, তার সতিন হাছিনা পারভীন ও তাদের স্বামী মোস্তফার নিয়ন্ত্রণে অন্তত ১০ জন ইয়াবা বিক্রি করে।

অভিযোগ আছে, বনানী থানা পুলিশের কয়েক কর্মকর্তার সঙ্গে তাদের ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। এ ছাড়া জামাইবাজারের আবদুল খালেকের ছেলে জসিম, জিল্লু, বেদে বস্তির শিমুল, মোশারফ বাজারের শহিদুল ইয়াবার অন্যতম কারবারি।

আরও পড়ুন

×