ঢাকা মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪

ঢাকার প্রথম ছবি 'মুখ ও মুখোশ'

ঢাকার প্রথম ছবি 'মুখ ও মুখোশ'

সজিব তৌহিদ

প্রকাশ: ০৯ নভেম্বর ২০১৭ | ১১:০১ | আপডেট: ০৯ নভেম্বর ২০১৭ | ১১:০৫

সাতচল্লিশ উত্তর সময়ে পূর্ব পাকিস্তানের হলগুলোতে চলছিল কলকাতা ও লাহোরের চলচ্চিত্র। পশ্চিম পাকিস্তান ও ভারতভিত্তিক এসব সিনেমা দেখে তরুণ সমাজ বেশ প্রভাবিত হতে থাকে। এতে পূর্ব পাকিস্তানের সংস্কৃতিপ্রেমী মানুষের চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায় এই ভেবে যে-বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতি হুমকির মুখে পড়ছে। এমন প্রেক্ষাপটে পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা,  সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য তুলে ধরে ছবি নির্মাণের আহ্বান জানানো হয় পশ্চিম পাকিস্তানের খ্যাতমানা প্রযোজক এফ দোসানিকে। তিনি তা প্রত্যাখ্যানের পাশাপাশি বিরূপ মনোভাব প্রকাশ করেন। আর এতে প্রতিবাদী হন বাঙালি অভিনেতা আব্দুল জব্বার খাঁ। তিনি দোসানির এমন মনোভাবের জবাব দিতে মনস্থির করেন। আর সে জবাব হবে সিনেমা নির্মাণের মধ্য দিয়েই। সেই লক্ষ্যে সিনেমার চিত্রনাট্য লিখতে শুরু করেন তিনি, পাশাপাশি অর্থ যোগানের চেষ্টা অব্যাহত রাখেন। শেষ পর্যন্ত সহযোদ্ধাদের নিয়ে দোসানিকে উপযুক্ত জবাব দেন আব্দুল জব্বার খাঁ।

মঞ্চ নাট্যকর্মী ছিলেন এই আব্দুল জব্বার। নিয়মিত মঞ্চ নাটক করতেন। আহসানুল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুল থেকে ১৯৪১ সালে ডিপ্লোমা নিয়ে চাকরিতে যোগ দেন। ঢাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন ১৯৪৯ সালে। এরপর নাট্য সংগঠন গড়ে তোলেন। নাম দেন 'কমলাপুর ড্রামাটিক অ্যাসোসিয়েশন'। এর মাধ্যমে তিনি ‘টিপু সুলতান' ও ‘আলীবর্দী খান’ নামে নাটক মঞ্চস্থ করেন।

১৯৫৩ সালের নভেম্বর পর্যন্ত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে চলচ্চিত্র নির্মাণ কাজ শুরু হয়নি। তখন পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানে ভারতীয় বাংলা, হিন্দি, পশ্চিম পাকিস্তান ও হলিউডের ছবি চলত। এ সময় এক সভায় গুলিস্তান সিনেমা হলের অবাঙালি মালিক খান বাহাদুর ফজল আহমেদ বলেন, 'পূর্ব পাকিস্তানের আর্দ্র আবহাওয়ায় চলচ্চিত্র নির্মাণ করা সম্ভব নয়।' এ কথার তীব্র প্রতিবাদ করে আবদুল জব্বার খান বলেন, এখানে তো ভারতীয় ছবির শুটিং হয়েছে। তবে কেন পূর্ণাঙ্গ ছবি নির্মাণ করা যাবে না? এ নিয়ে চ্যালেঞ্জও ছুড়ে দেন তিনি। ঢাকার প্রথম বাংলা ছবি নিমার্ণের লক্ষ্যে উঠে পড়ে লাগেন। 'ডাকাত' নামে একটি নাটক ছিল তার। সেই নাটক থেকেই সিনেমার শুটিং শুরু হয়। পরে সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ফজল শাহাবুদ্দিনের পরামর্শে ছবিটির নাম দেন 'মুখ ও মুখোশ'। এ ছবি নির্মাণে প্রায় দুই বছর সময় লেগে যায়। ছবির কাজ শুরু হয় ১৯৫৩ সালের ডিসেম্বরে। আর শেষ হয় ১৯৫৫ সালের ৩০ অক্টোবর।

ছবি নির্মাণের মতো ব্যয়বহুল কাজ হাতে নিয়ে বেশ বিপাকে পড়ে যান আব্দুল জব্বার খাঁ। কোথায় পাবেন ছবির প্রয়োজনীয় অর্থ। নিজেরও তো সেরকম সামর্থ্য নেই। তাহলে বন্ধ হয়ে যাবে কি ছবি নির্মাণ?  এমন দোলাচলে এগিয়ে আসেন সংস্কৃতিপ্রেমী কলিম উদ্দিন আহমেদ দুদু মিয়া। ছবি নির্মাণে ওই সময়ে খরচ হয় প্রায় ৮২ হাজার টাকা। যার অর্ধেক দেন দুদু মিয়া। আর বাকি অর্ধেক খরচ বহন করেন আব্দুল জব্বার খাঁ ও তার চার বন্ধু। কলিম উদ্দিন আহমেদ দুদু মিয়া হলেন জনপ্রিয় নায়ক আলমগীরের বাবা। ছবিটি মুক্তির প্রথম দিকেই আয় হয় ৪৮ হাজার টাকা। পরে বিভিন্ন প্রদর্শনী ও টিভিতে সম্প্রচারে আয় হয় আরও কিছু অর্থ।

বহুল আলোচিত এই ছবির শুটিং লোকেশন ছিল ঢাকা কেন্দ্রিক। এর কারণ স্বল্প বাজেট। এছাড়া প্রথম ছবি বলে কথা। তাই পরীক্ষামূলক কাজ হিসেবে ঢাকা ও আশপাশ এলাকাকে শুটিং লোকেশন হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ঢাকার তেজগাঁও, কালীগঞ্জ রাজারবাগ, কমলাপুর, লালমাটিয়া, সিদ্ধেশ্বরী, জিঞ্জিরা ও টঙ্গী ছিল ছিবিটির শুটিং স্পট। 

অসামাজিক কর্মকাণ্ড, পারিবারিক কলহ ও দুর্নীতির মতো বিষয়বন্তু নিয়ে 'মুখ ও মুখোশ' নির্মিত হয়েছে। বাংলাদেশ তথা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য সবাক চলচ্চিত্র এটি। এর দৈর্ঘ্য ৯৯ মিনিট। অনেক চড়াই-উৎরাই পারি দিয়ে অবশেষে ১৯৫৬ সালের ৩ আগস্ট ছবিটি মুক্তি পায়। ছবির প্রথম প্রদর্শনী রূপমহল সিনেমা হলে উদ্বোধন করেন তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের গভর্নর শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক। তৎকালীন পুরান ঢাকার 'মুকুল' সিনেমা হলে ছবিটির শো চলে। পরে ছবিটি ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা ও নারায়ণগঞ্জসহ অন্যান্য প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি দেওয়া হয়। 

এরপর 'মুখ ও মুখোশ' নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের ব্যাপক সাড়া পড়ে যায়। বাংলার নিজস্ব ছবি দেখার জন্য সিনেমা হলে হুমড়ি খেয়ে পড়ে দর্শক। বাঙালিদের মধ্যে সিনেমা নিয়ে আবেগ ও উত্তেজনা আরো বেড়ে যায়। সিনেমা শুধু বিনোদন নয়,  প্রতিবাদে হাতিয়ার হয়ে ওঠে।

ছবিতে নায়িকার ভূমিকায় ছিলেন চট্টগ্রামের মেয়ে পূর্ণিমা সেন, ইনাম আহমেদ ছিলেন নায়কের ভূমিকায়, আব্দুল জব্বার খান অভিনয় করেন দ্বিতীয় প্রধান পুরুষ চরিত্রে। তবে অন্য নারী চরিত্রে অভিনয় নিয়ে তৈরি হয় বিপত্তি। ওই সময় ছবিতে নারীদের অভিনয় করা ভালো চোখে দেখা হত না। ফলে সিনামায় অভিনয়ের জন্য পরিবার থেকে নারীদের অনুমতি পাওয়া ছিল কষ্ট সাধ্য কাজ। 

তাই 'মুখ ও মুখোশ' ছবিতে অভিনয়ের জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেওয়া হলো। বিজ্ঞাপন দেখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ছাত্রী জহরত আরা ও ইডেন কলেজের ছাত্রী পিয়ারী বেগম আগ্রহ দেখান। এরপর অনেক জটিলতা উপেক্ষা করে তাদের ‘মুখ ও মুখোশ’ ছবিতে অভিনয় করানো হয়। এছাড়া এই ছবিতে অভিনয় করেন- সাইফুদ্দিন, বিনয় বিশ্বাস, রহিমা খাতুন, বিলকিস বারী, আমিনুল হক, আলী মনসুর, রফিক, নুরুল আনাম খান প্রমুখ। চলচ্চিত্রটির সংগীত পরিচালনা করেন সমর দাস। গানে কণ্ঠ দেন আবদুল আলীম ও মাহবুবা হাসনাত। সহকারী সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন ধীর আলী, শব্দগ্রহণে ছিলেন মইনুল ইসলাম। ছবিটি সম্পাদনা করেন আব্দুল লতিফ। আর পোস্টার ডিজাইন করেন সুভাষ দত্ত। উপদেষ্টা চিত্রগ্রাহক ছিলেন মুরারী মোহন। অঙ্গসজ্জার কাজ করেন শ্যাম বাবু। আর পরিবেশনায় ছিল ইকবাল ফিল্মস লি.। ছবিতে একই সঙ্গে পরিচালক, প্রযোজক,  রচয়িতা ও অভিনেতা হিসেবে ছিলেন ‘মুখ ও মুখোশ’-এর প্রধান স্রষ্টা আব্দুল জব্বার খাঁ। তিনি ‘ঈসা খাঁ’ (১৯৫০), প্রতিজ্ঞা’ (১৯৫১), ‘ডাকাত’ (১৯৫৩), ‘জগোদেশ’ (১৯৫৯) রচনা করে তখন ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠেন। ‘সমাজপতি ও মাটির ঘর' নামে নাটক করে জব্বার খাঁ স্বর্ণপদক লাভ করেন। সেই সময় ভারতের গোহাটিতে পরিচালনা করেন ‘টিপু সুলতান' নাটকটি। আব্দুল জব্বার খাঁ ১৯১৬ সালে ২১ এপ্রিল মুন্সিগঞ্জের লৌহজংয়ে জন্মগ্রহণ করেন। বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবন পার করে ১৯৯৩ সালের ২৮ ডিসেম্বর তিনি না ফেরার দেশে চলে যান।


আরও পড়ুন

×