ঢাকা মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪

চলচ্চিত্রে মুক্তি সংগ্রাম

চলচ্চিত্রে মুক্তি সংগ্রাম

সজিব তৌহিদ

প্রকাশ: ০৯ ডিসেম্বর ২০১৭ | ০৯:৩১ | আপডেট: ১০ ডিসেম্বর ২০১৭ | ১১:০৫

ষাটের দশকে লোক কাহিনিভিত্তিক বাংলা সিনেমাগুলো বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। পূর্ব বাংলার চলচ্চিত্র নির্মাতা ও পৃষ্ঠপোষকদের মধ্যে বাংলা সিনেমা নির্মাণে আগ্রহ বাড়তে থাকে। এরই মধ্যে ১৯৬৪ সালের এপ্রিলে স্ত্রী লক্ষ্মী ও পুত্র সন্তানকে নিয়ে ঢাকায় চলে আসেন আব্দুর রাজ্জাক নামে এক তরুণ। এই তরুণের উপস্থিতিতে ঢাকার বাংলা চলচ্চিত্র আরও প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। পরে তিনি 'নায়ক রাজ' হয়ে ঢাকাই চলচ্চিত্রে কিংবদন্তীতে পরিণত হন।

১৯৬৭ সালে নির্মিত হলো প্রথম ঐতিহাসিক গল্পের চলচ্চিত্র নবাব সিরাজদ্দৌলা। ছবিটি নির্মাণ করেন খান আতাউর রহমান। এতে নবাব সিরাজদ্দৌলা চরিত্রে অভিনয় করে দর্শকদের কাঁদান অভিনেতা আনোয়ার হোসেন। ছবির দৃশ্যপট ব্যথিত দর্শকদের হৃদয়ে স্বাধীনতার তীব্র আকাঙক্ষার জন্ম দেয়।

১৯৬৮ সালের শুরুর দিকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাকে কেন্দ্র করে পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক উত্তাপ বাড়তে থাকে। ঊনসত্তরের প্রেক্ষাপটে  'জয় বাংলা' সিনেমাটি সবার নজর কাড়ে। মাহবুব তালুকদারের কাহিনি ও সংলাপ রচনায় এবং ফখরুল আলম পরিচালিত ছবিটি তৎকালীন ‘জয় বাংলা' স্লোগানটি সর্বসাধারণের কাছে পৌঁছে দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ছবিটি নিয়ে মাহবুব তালুকদার লিখেছিলেন, 'ছবিটি মানসম্পন্ন ছিল না বলে তা নিয়ে আলোচনাও খুব বেশি হয়নি। তবে এর একটি ঐতিহাসিক গুরুত্ব অবশ্যই আছে।' অবশ্য এই ছবিতে ব্যবহৃত গাজী মাজহারুল আনোয়ারের লেখা ‘জয় বাংলা বাংলার জয়' দেশবাসীর কাছে সমাদৃত হয়। সেই গানের আবেদন আজও আছে। স্বাধীনতার ৪৬ বছর পরেও গানটি সমানভাবে জনপ্রিয়। বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনা নিয়ে 'জয় বাংলা' ছবিটি নির্মিত হয়।

এদিকে পূর্ব বাংলার স্বাধিকার আন্দোলন চূড়ান্ত স্বাধীনতার আন্দোলনে রূপ নিতে থাকে। সমসাময়িক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক ও চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান নির্মাণ করেন 'জীবন থেকে নেওয়া'। ছবিটি ১৯৭০ সালের এপ্রিলে মুক্তি পায়। সামাজিক এই চলচ্চিত্রে পাকিস্তানি স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা রূপকের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। ছবিতে অভিনয় করেন- রাজ্জাক,  সুচন্দা, খান আতাউর রহমান, রওশন জামিল, রোজী সামাদ, আনোয়ার হোসেনসহ অন্যরা। এ সিনেমায় প্রথমবারের মতো 'আমার সোনার বাংলা' গাওয়া হয়; যা পরে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। ছবিতে দেশপ্রেমের যে চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে তা অনন্য। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সাধারণ মানুষের সঙ্গে নির্মাতা, শিল্পী ও কলাকুশলীরা অংশ নেন। এদের মধ্যে অনেকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের 'শব্দ সৈনিক' হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জীবন্ত করে তুলে ধরতে ও স্বাধীনতার আন্দোলনকে সামনে এগিয়ে নিতে ক্যামেরা নিয়ে মাঠে নামেন চলচ্চিত্র নির্মাতা জহির রায়হন। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তিনি মুক্তিযুদ্ধের প্রামাণ্যচিত্র ‘স্টপ জেনোসাইড' ও ‘এ স্টেইট ইজ বর্ন' নির্মাণ করেন। যুদ্ধের পরিস্থিতি ধারণ করে আলমগীর কবির নিমার্ণ করেন ‘লিবারেশন ফাইটার্স' ও বাবুল চৌধুরী নির্মাণ করেন ‘ইনোসেন্ট মিলিয়নস' নামে প্রামাণ্যচিত্র। একাত্তরে নভেম্বর মাসের মধ্যে নির্মিত এই চারটি প্রামাণ্যচিত্রে পাকিস্তানি বর্বরতার চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়; যা মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বিভিন্ন সিনেমায় ব্যবহার করা হয়।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন উল্লিখিত চারটি প্রামাণ্যচিত্র ছাড়াও ১০ মিনেটের একটি সংবাদচিত্রও নির্মিত হয়। একাত্তরে বাংলার সাহসী তরুণ-যুবারা দেশকে স্বাধীন করার স্বপ্নে হাতে তুলে নেন রাইফেল। তখনই দেশের দুর্দশা ও সংগ্রামকে বিশ্বের কাছে পৌঁছে দিতে কিছু তরুণ শক্ত হাতে ধরেন ক্যামেরা। ২৫ মার্চ কাল রাতের গণহত্যার ছবি তুলেছিলেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নূরুল্লাহ। নৃশংস হত্যাযজ্ঞ শুরু হওয়ার পর জীবনের মায়া ত্যাগ করে নূরুল্লাহর বাসায় পড়ে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি নিম্নমানের ভিডিও ক্যামেরা দিয়েই তিনি গণহত্যার দৃশ্য ধারণ করেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় সেই ভিডিও চিত্রের ব্যবহারযোগ্য প্রিন্ট কাজে লাগানো সম্ভব হয়নি।

১৯৭১ সালে ১০ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠিত হওয়ার পর আবদুল জব্বার খানকে পরিচালক করে একটি চলচ্চিত্র বিভাগ খোলা হয়। তবে এই বিভাগের চেয়ে বেসরকারি উদ্যোগে ‘বাংলাদেশ লিবারেশ কাউন্সিল অব দি ইনটেলিজেনশিয়া' এবং ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী কলাকুশলী সহায়ক সমিতি'র যৌথ উদ্যোগ ও আর্থিক সহায়তায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘ধীরে বহে মেঘনা' নির্মাণের পরিকল্পনা করেন জহির রায়হান। কিন্তু যুদ্ধ শেষ হওয়ার দেড় মাসের মধ্যেই জহির রায়হান নিখোঁজ হন। পরে স্বাধীন দেশে আলমগীর কবির এ সিনেমাটি নির্মাণ করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের পটভূমিতে প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র 'ওরা ১১ জন' নির্মাণ করেন চাষী নজরুল ইসলাম। ছবিতে অভিনয় করা ওই ১১ জনের ১০ জনই বাস্তবের মুক্তিযোদ্ধা। সিনেমা নির্মাণে ব্যবহৃত অস্ত্র-শস্ত্র ও বুলেট সবকিছু ছিল আসল। ১৯৭২ সালের ১১ আগস্ট ছবিটি মুক্তি পায়। ছবিটি প্রযোজনা করেন মাসুদ পারভেজ। আল মাসুদের রচনায় এই ছবিতে অভিনয় করেন- খসরু, রাজ্জাক, শাবানা, নূতন, হাসান ইমাম, এটিএম শামসুজ্জামান, আলতাফ, মুরাদ, নান্টু, বেবী, আবু প্রমুখ। বাংলার গেরিলা বাহিনীর পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযান ও দেশ স্বাধীন নিয়ে চলচ্চিত্রটি নির্মিত।

আরো পড়ুন...

 বাংলা চলচ্চিত্রের উত্থানপর্বে লোককাহিনি

ঢাকার প্রথম ছবি 'মুখ ও মুখোশ'



আরও পড়ুন

×