ঢাকা মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪

ঢেলে সাজানো হচ্ছে বর্তমান ভ্যাট আইনই

ঢেলে সাজানো হচ্ছে বর্তমান ভ্যাট আইনই

আবু কাওসার

প্রকাশ: ১৮ মে ২০১৮ | ১৯:৩৪

চলতি অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার আগে নতুন মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) আইন বাস্তবায়নের বিষয় ছিল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। এবার সেই উত্তাপ নেই। আইনটি দুই বছরের জন্য স্থগিত করে সরকার। ফলে ১৯৯১ সালের ভ্যাট আইন বলবৎ থাকে। এরই মধ্যে পার হয়ে গেছে এক বছর। নির্ধারিত সময় অনুযায়ী আগামী ২০১৯ সালের জুলাই থেকে নতুন ভ্যাট আইন কার্যকর হওয়ার কথা। ৭ জুন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বর্তমান সরকারের শেষ বাজেট ঘোষণা করবেন। যদিও নতুন আইন বাস্তবায়নের বিষয়ে অর্থমন্ত্রী এখনও আশাবাদী। তারপরও ব্যবসায়ীসহ সবার আগ্রহ রয়েছে এ বিষয়ে আসন্ন ২০১৮-১৯ বাজেটে সরকার কী ঘোষণা দেয়।

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ বাজেট প্রণয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত সরকারের নীতিনির্ধারক সূত্রে জানা যায়, নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়নের পথ থেকে সরে আসছে সরকার। এর পরিবর্তে বিদ্যমান ১৯৯১ সালের ভ্যাট আইন আধুনিকায়ন ও যুগোপযোগী করা হবে। এ লক্ষ্যে প্রচলিত ভ্যাট আইনটিকে ঢেলে সাজানা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র সমকালকে বলেন, বাংলাদেশের বাস্তবতার আলোকে নতুন আইন বাস্তবায়ন করা কঠিন। বরং বিদ্যমান আইন সংস্কারের মাধ্যমে তা কার্যকর করা হলে অর্থনীতি গতিশীল হবে। বাড়বে রাজস্ব আদায়।

যোগাযোগ করা হলে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভুঁইয়া সমকালকে বলেন, বর্তমান ভ্যাট আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে অনলাইন প্রকল্পের আওতায় যে সব কর্মপদ্ধতি রয়েছে তা বর্তমান আইনে যুক্ত করা হবে। এ লক্ষ্যে বিধিমালা প্রণয়নের কাজ চলছে। এনবিআর চেয়ারম্যান আরও বলেন, প্রস্তাবিত বিধিমালা প্রণয়ন সম্পন্ন হলে বর্তমান ১৯৯১ সালের ভ্যাট আইনের কিছু ক্ষেত্রে সংশোধন করে তা কার্যকর করা হবে।

এনবিআরের সদস্য (ভ্যাট নীতি) রেজাউল হাসান সমকালকে বলেন, প্রচলিত আইনে অনলাইনে কার্যক্রমের সুযোগ নেই। যেহেতু অনলাইন হচ্ছে এক ধরনের আধুনিক কর্মপদ্ধতি।

তাই এ পদ্ধতি বিদ্যমান আইনে যুক্ত করা হবে। এ জন্য বিধিমালা লাগবে। তিনি আরও বলেন, বিধিমালা প্রণয়নের উদ্দেশ্য হচ্ছে অনলাইনের আওতায় যে সব কর্মকাণ্ড রয়েছে তা এক বছরের মধ্যে ব্যবহারের উপযোগী করে গড়ে তোলা। এর কারণ ব্যাখ্যা করে ভ্যাট অনলাইন প্রকল্পের পরিচালক ও এনবিআর সদস্য রেজাউল হাসান আরও বলেন, বর্তমানে অনলাইনের আওতায় নিবন্ধন ও রিটার্ন জমা দেওয়ার পদ্ধতি এনবিআরে অভ্যন্তরীণভাবে চালু আছে। কিন্তু এর প্রয়োগ যখন মাঠ পর্যায়ে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হবে তখন নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে। এই জটিলতা এড়াতে আইনি কাঠামো প্রয়োজন। এটি থাকলে তখন আর অনলাইনের কার্যক্রম নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলতে পারবে না। এ লক্ষ্যে বিধিমালা হচ্ছে, যা ১৯৯১ সালের আইন সংশোধনীর মাধ্যমে অন্তর্ভুক্ত করা হবে বলে জানান তিনি। জানা যায়, প্রস্তাবিত বিধিমালা বর্তমানে আইন মন্ত্রণালয়ে ভেটিংয়ের অপেক্ষায় আছে। ভেটিং সম্পন্ন হলে প্রজ্ঞাপন জারি করে বাজেট ঘোষণার পর তা কার্যকর করবে এনবিআর।

জানা যায়, নতুন বিধিমালার বিষয়ে পর্যালোচনার জন্য সরকারি-বেসরকারি প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে ৯ সদস্যের একটি কমটি গঠন করা হয়েছে। এতে এনবিআরের কর্মকর্তারাও আছেন। বর্তমানে ওই কমিটি এ বিষয়ে কাজ করছে। জানতে চাইলে কমিটির অন্যতম সদস্য এফবিসিসিআইর সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ফজলে ফাহিম সমকালকে বলেন, প্রস্তাবিত বিধিমালায় নতুন আইনের অনেক বিষয় আছে যেগুলো গ্রহণযোগ্য নয়। আবার কিছু বিষয়ে আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে।

এনবিআর সূত্র জানায়, বর্তমানে মাত্র ৩৭ হাজার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভ্যাটের আওতায় রয়েছে। এদের বেশিরভাগই বড়। অনলাইনে নিবন্ধন সম্পন্ন হলে প্রায় এক লাখ প্রতিষ্ঠান নতুন করে আওতায় আনা যাবে। চলতি অর্থবছরে ভ্যাট আদায় হতে পারে ৭০ থেকে ৭২ হাজার কোটি টাকা। এনবিআরের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের এক কর্মকর্তা জানান, সব প্রতিষ্ঠানকে অনলাইনের আওতায় আনা সম্ভব হলে বছরে ভ্যাট আদায় বর্তমানের চেয়ে তিন গুণ বাড়বে।

অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণের প্রধানতম খাত হচ্ছে এখন ভ্যাট। ২০১৩ সালের এনবিআরের এক সমীক্ষায় বলা হয়, ভ্যাট ব্যবস্থাকে ডিজিটালাইজেশনের আওতায় আনতে পারলে ভ্যাট আদায় বাড়বে জিডিপির ১ শতাংশ। অর্থাৎ কমপক্ষে ২ লাখ কোটি টাকার বেশি আদায়ের সুযোগ রয়েছে।

ব্যবসায়ীদের তীব্র আপত্তির মুখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরাসরি হস্তক্ষেপে গতবার শেষ মুহূর্তে নতুন ভ্যাট আইন দুই বছরের জন্য স্থগিত করা হয়। নতুন ভ্যাট আইনে বিশেষ ছাড়ের পরিবর্তে সর্বক্ষেত্রে অভিন্ন বা একই হারে (১৫ শতাংশ) ভ্যাট আরোপের বিধান করা হয়। যদিও প্রতিটি স্তরে রেয়াত বা ক্রেডিট সুবিধা দেওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়। কিন্তু ব্যবসায়ীরা নতুন আইনটি গ্রহণ করেননি। তারা বলেছেন, ওই আইন কার্যকর হলে পণ্যের দাম বাড়বে। চাপ বাড়বে ভোক্তার ওপর। ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশীয় শিল্পখাত বিশেষ করে এসএমই শিল্প। এতে করে কর্মসংস্থানের সুযোগ সংকুচিত হবে। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বাজেট পাশের আগের দিন জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুই বছরের জন্য নতুন ভ্যাট আইনের কার্যক্রম স্থগিতের ঘোষণা দেন। একইসঙ্গে যে আইনটি আছে তা চলমান রাখার কথা উল্লেখ করেন।

এদিকে নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় যে অনলাইন প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছিল তা অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এ লক্ষ্যে গত জানুয়ারিতে একনেক সভায় আলোচ্য প্রকল্পটির মেয়াদ আরও দুই বছরের জন্য বাড়ানো হয়। বিশ্বব্যাংক ভ্যাট অনলাইন প্রকল্পে ৫৫১ কোটি টাকা অর্থায়ন করে। এরই মধ্যে ওই টাকার বেশিরভাগই খরচ হয়ে গেছে। যদিও ওই টাকা কোথায়, কীভাবে খরচ হয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সূত্র জানায়, ভ্যাট অনলাইন প্রকল্পে ব্যয় আরও ১৫০ কোটি টাকা বাড়ানো হয়। ফলে আলোচ্য প্রকল্পটির মোট প্রাক্কলিত ব্যয় দাঁড়ায় ৭০১ কোটি টাকা। বাড়তি টাকা সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে জোগান দেওয়া হবে। এখন অনলাইন প্রকল্পের যাবতীয় কর্মপদ্ধতি বর্তমান আইনে সংযুক্ত করা হচ্ছে। এ জন্য ১৯৯১ সালের বিদ্যমান ভ্যাট আইন সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে এনবিআর, যা আগামী বাজেটে কার্যকর করা হবে।

সংশোধনীর প্রস্তাব :সূত্র জানায়, বর্তমান ১৯৯১ সালের ভ্যাট আইনের প্রধানত নিবন্ধন এবং রিটার্ন জমা দেওয়া- এই দুটি ক্ষেত্রে সংশোধনী আসছে। বিদ্যমান আইনে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন এবং মাসিক ভ্যাট রিটার্ন জমা দেওয়া হয় সনাতনী পদ্ধতিতে। কিন্তু নতুন আইনকে কেন্দ্র করে নেওয়া অনলাইন প্রকল্পে এসব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার সিদ্ধান্ত হয় ডিজিটাল বা স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে। ফলে অনলাইনে রিটার্ন ফরম এমনভাবে সাজানো হয় যে, তা বিদ্যমান ভ্যাট আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এখন নতুন আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নিবন্ধন কার্যক্রম এবং রিটার্ন ফরম পূরণ পদ্ধতি বর্তমান আইনের সঙ্গে অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব করা হচ্ছে। এজন্য সংশোধনীর প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। এনবিআরের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, বর্তমান আইনে এই দুটি ক্ষেত্রে সংশোধনীর মাধ্যমে প্রচলিত আইনকে আধুনিকায়ন করা হবে। এর ফলে ভ্যাটের আওতা বাড়বে, আদায় প্রক্রিয়া সহজ হবে ও রাজস্ব আদায় বাড়বে। সূত্র জানায়, ১৯৯১ সালের বিদ্যমান ভ্যাট আইনকে অনলাইনের আওতায় আনা হলে ছোট, মাঝারি ও বড় সব ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ডিজিটাল পদ্ধতিতে নিবন্ধন এবং রিটার্ন জমা দিতে পারবে।

আরও পড়ুন

×