ঢাকা মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪

ভর্তুকি বাড়ছে

ভর্তুকি বাড়ছে

আবু কাওসার

প্রকাশ: ২০ মে ২০১৮ | ২০:৩৪

জাতীয় বাজেটে দেওয়া বরাদ্দের একটি বড় অংশ ব্যয় হয় ভর্তুকি খাতে। সাধারণত ভর্তুকি বেশি হলে আর্থিক চাপ বাড়ে সরকারের। এ জন্য বাজেট প্রণয়নের সময় অনেকটা অস্বস্তিতে থাকে সরকার। কয়েক বছর ধরে ভর্তুকির চাপ কমায় স্বস্তিতে ছিল সরকার। তবে এবার সেই পরিস্থিতির কিছুটা ছন্দপতন হয়েছে। অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক অবস্থার কারণে এবার ভর্তুকির চাহিদা আগের চেয়ে বাড়ছে। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, আসন্ন ২০১৮-১৯ বাজেটে ভর্তুকিতে মোট ৩১ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। প্রস্তাবিত এই বরাদ্দ মোট দেশজ উৎপাদনের দেড় শতাংশ এবং চলতি অর্থবছরের চেয়ে প্রায় ১২ শতাংশ বেশি। চলতি অর্থবছর বাজেট ঘোষণার সময় ভর্তুকি খাতে মোট বরাদ্দ দেওয়া হয় ২৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে এ বরাদ্দ অপরিবর্তিত থাকছে। এর আগের অর্থবছরে ভর্তুকির পরিমাণ ছিল ২৩ হাজার কোটি টাকা। 


সূত্র জানায়, গত চার বছর ধরে ভর্তুকিতে বরাদ্দ কমে এলেও এবার বাড়াছে। অবশ্য এর যুক্তিসঙ্গত কারণও আছে। কিছু পণ্যের চাহিদা বাড়ছে। তার মধ্যে বিদ্যুৎ ও গ্যাস অন্যতম। উৎপাদন বাড়ার কারণে বিদ্যুতে বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি লাগছে। এবার নতুন করে যোগ হয়েছে এলএনজি। এলএনজি অনেক বেশি দামে আমদানি করা হচ্ছে। সেই দামে গ্রাহকের কাছে বিক্রি করা সম্ভব হবে না। ফলে এখানে ভর্তুকি দিতে হবে। 


এবার এলএনজির জন্য আলদা ভর্তুকি বরাদ্দ থাকছে। এলএনজি আমদানির প্রথম চালান দেশে এসে পৌঁছেছে এবং খালাসের অপেক্ষায় আছে। চলতি মাসের শেষ দিকে গ্রাহকরা এ গ্যাস ব্যবহার করতে পারবে। যদিও গ্রাহক পর্যায়ে গ্যাসের নতুন দাম এখনও নির্ধারিত হয়নি। তবে কম দামে যাতে সরবরাহ করা যায়, সে জন্য ভর্তুকি দেওয়া হবে। সূত্র জানায়, আগামী বাজেটে এলএনজির জন্য আড়াই থেকে তিন হাজার কোটি টাকা পৃথক বরাদ্দ থাকছে। এ ছাড়া এলএনজির দাম সহনীয় রাখতে আমদানি পর্যায়ে ১৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) প্রত্যাহার করা হতে পারে। শেষ পর্যন্ত বাজেটে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ৯ হাজার ২০০ কোটি টাকা ভর্তুকি বরাদ্দের প্রস্তাব থাকছে। 


অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, ভর্তুকি হচ্ছে এক ধরনের অনুৎপাদনশীল খাত। অর্থনীতির অদক্ষতার কারণেই ভর্তুকি দিতে হয়। এটি যত বেশি হবে, তত আর্থিক চাপ বাড়বে সরকারের ওপর। এ জন্য ভর্তুকি কমিয়ে আনার পরামর্শ দেন তারা। যদিও অর্থনীতিবিদদের মত গ্রহণযোগ্য নয় বলে মনে করেন সরকারের নীতিনির্ধারকরা। বাজেট প্রণয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, রাষ্ট্রের প্রয়োজনে সাধারণ মানুষের কথা বিবেচনা করেই ভর্তুকি দেয় সরকার। ভর্তুকি না দিলে কৃষিপণ্যের দাম আরও বাড়বে। বাড়বে বিদ্যুতের দাম, ব্যাহত হবে রফতানি। এতে করে অর্থনীতির স্বাভাবিক গতিধারা ব্যাহত হবে। সামাজিক অসন্তোষ দেখা দেবে। 


তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, অবশ্যই ভর্তুকির দরকার রয়েছে। তবে তার আগে টার্গেট গ্রুপ ঠিক করতে হবে সরকারকে। ভর্তুকি দেওয়ার ক্ষেত্রে এর কাঠামোগত সংস্কারের পরামর্শ দেন তিনি।। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সাবেক কর্মকর্তা ও বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, কৃষক চায় তার উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য দাম। এটি নিশ্চিত করতে পারলে ভর্তুকি দেওয়ার প্রয়োজন হবে না। 


জানা যায়, রফতানিকে উৎসাহিত করতে প্রণোদনা দেওয়ার বিষয়ে বেশি বরাদ্দের চাপ রয়েছে এবার। চলতি অর্থবছরের বাজেটে এ খাতে চার হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। জানা যায়, গত সপ্তাহে প্রণোদনার বিষয়ে সচিবালয়ে অর্থ সচিবের সভাপতিত্বে আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকে ব্যবসায়ীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে রফতানিতে প্রণোদনা আরও বেশি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আসন্ন বাজেটে রফতানিতে প্রণোদনা আগের চেয়ে ৫০০ কোটি বাড়িয়ে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা দেওয়া হচ্ছে। কৃষিতেও ভর্তুকির চাহিদা বাড়ছে। চলতি বাজেটে কৃষি উপকরণ (সার) আমদানিতে ৯ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। কৃষি মন্ত্রণালয় বলেছে, আন্তর্জাতিক বাজারে এখন জ্বালানি পণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী। তেলের দাম বাড়লে সারের দামও বাড়ে। সে জন্য কৃষিতে আরও বেশি ভর্তুকি দিতে হবে। জানা যায়, আসন্ন বাজেটে কৃষিতে বর্তমানের চেয়ে আরও ৫০০ কোটি বাড়িয়ে সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত করা হচ্ছে। 


জানা যায়, বর্তমানে ছয় থেকে সাতটি খাতে ভর্তুকি দেওয়া হয়। এর মধ্যে বিদ্যুৎ, কৃষি, রফতানি, খাদ্য, পাট ও পাটজাতপণ্য উল্লেখযোগ্য। এর বাইরে আরও কিছু খাতে ভর্তুকি দেওয়া হয়। তবে এসব খাতে বরাদ্দ খুব কম থাকে। আগে জ্বালানি তেলে সবচেয়ে বেশি ভর্তুকি লাগত। বিপিসি লাভজনক হওয়ায় গত দুই অর্থবছর থেকে জ্বালানি তেলে ভর্তুকি দিতে হয়নি। জানা গেছে, আগামী বাজেটেও এ খাতে কোনো বরাদ্দ থাকছে না। 


গরিব মানুষকে সাশ্রয়ী দামে খাওয়ানোর জন্য খোলা বাজারে (ওএমএস) চাল বিক্রি করে সরকার। এ জন্য চাল ও আটায় ভর্তুকি দেওয়া হয়। চলতি বাজেটে এ খাতে চার হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়। জানা যায়, আগামী বাজেটেও একই পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ রাখা হচ্ছে। এ ছাড়া পাট ও পাটজাত পণ্য রফতানিতে আগের মতো ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হচ্ছে। এ ছাড়া অন্যান্য খাতে দেড় হাজার কোটি টাকা দেওয়া হচ্ছে। সব মিলিয়ে আসন্ন বাজেটে ভর্তুকি বাবদ ৩১ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের প্রস্তাব করা হচ্ছে। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে মূল বাজেটে ভর্তুকি বাবদ বরাদ্দ ছিল ২৮ হাজার কোটি টাকা। তবে সংশোধিত বাজেটে তা কমে হয় ২৩ হাজার কোটি টাকা। 

আরও পড়ুন

×