কৌশল বদলাবে না বিএনপি
সমকাল প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২০ মার্চ ২০১৮ | ১৯:৫৪
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কারাভোগ দীর্ঘ হলেও 'কৌশল' বদলাবে না দলটি।
চলমান শান্তিপূর্ণ ও নিরুত্তাপ কর্মসূচির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে বিএনপি।
শীর্ষ নেতৃত্বের সম্ভাব্য দীর্ঘ অনুপস্থিতিতে দল পরিচালনার ক্ষেত্রেও কোনো
পরিবর্তন আসবে না। বর্তমানের মতো শীর্ষস্থানীয় নেতাদের যৌথ নেতৃত্বেই
পরিচালিত হবে দল। দুর্নীতির মামলায় খালেদা জিয়া কারাগারে গেলে দ্রুত সময়ের
মধ্যে মুক্তি পাবেন বলে আশা করেছিলেন বিএনপির নেতাকর্মীরা। তবে সে আশা
কার্যত গুড়েবালিতে পরিণত হওয়ায় কিছুটা হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে পড়েছেন তারা।
এ পরিস্থিতিতে দলটি কোন পথে এগোবে- তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে দলের ভেতর ও
বাইরে। অবশ্য পরবর্তী কর্মকৌশল নির্ধারণে দফায় দফায় বৈঠক করছেন দলটির
নীতিনির্ধারকরা। এসব বৈঠকে নতুন কর্মসূচি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হলেও কঠোর
কর্মসূচিতে না যাওয়ার পক্ষেই দলের বেশিরভাগ নেতা। অবশ্য কঠোর কর্মসূচি
দেওয়া ছাড়া খালেদা জিয়াকে মুক্ত করা এবং নির্দলীয় সরকারের অধীনে আগামী
নির্বাচনের দাবি আদায় সম্ভব নয় বলে মত দিচ্ছেন কিছু তরুণ নেতা।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সমকালকে বলেন, উচ্চ আদালতেও
সরকারি হস্তক্ষেপেই খালেদা জিয়ার জামিন হচ্ছে না। বিষয়টি আন্তর্জাতিক
পর্যায়ে পৌঁছাতেই বিদেশি আইনজীবী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে
তিনি বলেন, খালেদা জিয়ার কারাভোগ দীর্ঘ হলেও দল যৌথ নেতৃত্বেই পরিচালিত
হবে। দলের চেয়ারপারসনের অনুপস্থিতিতে যৌথ নেতৃত্বে দল ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী
অবস্থায় আছে এবং থাকবে। একইসঙ্গে তিনি বলেন, আপাতত তারা কোনো কঠোর
কর্মসূচি দিয়ে সরকারি ফাঁদে পা দেবেন না। সময় হলে কঠোর কর্মসূচি দেওয়া হবে।
খালেদা জিয়ার কারাবাস দীর্ঘায়িত হলে আন্দোলনের কৌশল, নীতিনির্ধারণসহ আগামী
জাতীয় নির্বাচন নিয়ে নানা পরিকল্পনা করছে দলটি। দলের সিনিয়র নেতারা মনে
করছেন, সরকার বিএনপির ওপর দমন-পীড়ন চালিয়ে রাজপথে নামানোর চেষ্টা শেষ
পর্যন্ত অব্যাহত রাখবে। কিন্তু সরকারের সেই পরিকল্পনার অংশ হতে চাইছেন না
তারা। বিএনপি একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত নিজেদের সাংগঠনিক, রাজনৈতিক
কার্যক্রম নির্বিঘ্নে রাখতে চাইছে। পরিবর্তিত সময়ে তারা কঠোর আন্দোলনে
যাবেন। এই নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত নিজেদের সাংগঠনিক শক্তি কম খরচ করে,
নেতাকর্মীদের রক্ষা করে কৌশলী রাজনীতি করতে চাইছেন তারা। পাশাপাশি
জনসম্পৃক্ততামূলক কর্মসূচি বাড়ানোর চিন্তা করা হচ্ছে। একইসঙ্গে জাতীয় ও
আন্তর্জাতিক সমর্থন নিজেদের অনুকূলে নিতে উদ্যোগী হবেন নেতারা। সরকারের
বাইরে থাকা সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে নির্বাচনী জোট গড়ার পরিকল্পনা নিয়েও কাজ
করছেন তারা। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশনা আর
সিনিয়র নেতাদের পরামর্শে এসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা হচ্ছে বলে জানা গেছে।
নিজেদের মধ্যে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে প্রায় প্রতিদিন রুটিনমতো বৈঠক
করছেন। রাজনৈতিক কৌশল নিয়ে আলোচনা করছেন। বৈঠকে নিয়মিতভাবে অংশগ্রহণ করছেন
দলের স্থায়ী কমিটির সদস্যসহ সিনিয়র নেতারা।
এসব বৈঠকে দলটির ধারাবাহিক শান্তিপূর্ণ আন্দোলন কর্মসূচির বিভিন্ন দিক ও
কৌশল নিয়ে আলোচনা করছেন তারা। তাদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে আইন-শৃঙ্খলা
বাহিনীর বাধার বিষয়ে অনেক নেতা এ বৈঠকে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন।
নেতারা জানান, বিএনপির শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির অংশ হিসেবে তারা সভা-সমাবেশের
মতো কর্মসূচি পালন করতে পারছেন না। প্রশাসনের অনুমতি না পাওয়ায় তিন দফায়
রাজধানীর সোহরাওয়ার্দীতে জনসভা করার উদ্যোগ নিলেও অনুমতি পাননি। তবে এর
প্রতিবাদে কঠোর অবস্থানে না গিয়ে শান্তিপূর্ণ পথেই হাটার চেষ্টা করছে
বিএনপি।
ঢাকার মতো সারাদেশে বিভাগীয় শহরগুলোতেও দলটি সমাবেশ করতে চেয়ে অনুমতি
পায়নি। কয়েক জেলায় দলীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ করতে পারলেও তাতেও ছিল
প্রশাসনের নানা প্রতিবন্ধকতা। এসব কিছুর পরও সরকারের ফাঁদে পা দেবে না এমন
ঘোষণা দিয়ে মানববন্ধন, অবস্থান কর্মসূচির মতো কর্মসূচি পালন করে আসছিল
দলটি। কিন্তু এসব কর্মসূচিতেও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বাধা, গ্রেফতারের ঘটনায়
নতুন উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে নেতাদের মধ্যে। এভাবে সরকারের কঠোর মনোভাব বজায়
থাকলে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিও বেশিদিন করা সম্ভব নয় বলে মনে করছেন তারা।
তাই আপাতত ধারাবাহিক কর্মসূচি থেকে সরে গিয়ে নতুন কর্মসূচি নিয়ে এগোতে
চাইছেন দলটির সিনিয়র নেতারা।
খালেদা জিয়াকে কারাগারে নেওয়ার পর বিএনপি পাঁচ দফায় বিক্ষোভ সমাবেশ,
মানববন্ধন, অবস্থান, প্রতীকী অনশন, গণস্বাক্ষর সংগ্রহ, জেলা প্রশাসকের কাছে
স্মারকলিপি পেশ, কালো পতাকা প্রদর্শনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে। এসব
কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপর ভূমিকায় অনেক কর্মসূচি
পণ্ড হয়ে যায়। এর পরও বিএনপি শান্তিপূর্ণ অবস্থান থেকে আন্দোলন চালিয়ে
যাওয়ার ঘোষণা দেয়। তবে এসব কর্মসূচিতে সাদা পোশাকধারী পুলিশের গ্রেফতার
আতঙ্ক বিরাজ করে নেতাকর্মীদের মধ্যে। এর মধ্যে গত ৮ মার্চ জাতীয় প্রেস
ক্লাবের সামনে বিএনপির অবস্থান কর্মসূচি পালনকালে সাদা পোশাকের পুলিশ
সমাবেশের মধ্য থেকে ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রদলের সভাপতি মিজানুর রহমান
রাজকে আটক করে। রাজ বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে দুই হাত
দিয়ে জড়িয়ে ধরেও রক্ষা পাননি। এ সময় আরও দু'জনকে আটক করে পুলিশ। গত ৬ মার্চ
গ্রেফতার করা হয় স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি শফিউল বারী বাবুকে। এ ঘটনাকেও
বিএনপির নেতারা অস্বাভাবিক হিসেবে দেখছেন। জাতীয় প্রেস ক্লাবের মতো জায়গা
থেকে প্রকাশ্যে অস্ত্র উঁচিয়ে সাদা পোশাকের পুলিশ কাউকে গ্রেফতারের নজির এর
আগে নেই বলে অনেকে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। তবে এ সবকিছুকে আড়াল করে দলের
নেতাকর্মীদের আতঙ্ক গ্রাস করেছে গত ১২ মার্চ ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রদলের
সহ-সভাপতি ও তেজগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত সভাপতি জাকির হোসেন মিলনের মৃত্যু।
পরিবার ও বিএনপির অভিযোগ, পুলিশি রিমান্ডে নির্যাতনে ছাত্রদল নেতা মিলনের
মৃত্যু হয়েছে।
বিএনপির শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে পুলিশের এমন বাধা, গ্রেফতার আর নির্যাতনের
কারণে দলটির নেতাকর্মীদের রক্ষা করতে নতুন কর্মসূচি দিতে চাইছেন নেতারা। এক
জায়গায় স্থির থেকে কোনো কর্মসূচি পালনের দিকে ঝুঁকতে চাইছেন না দলটির
সিনিয়র নেতারা। তারা মনে করছেন, তাদের মানববন্ধন কর্মসূচি কিংবা অবস্থান
কর্মসূচিতে সাদা পোশাকধারী পুলিশ অনুপ্রবেশ করে। এ সময়ে তারা টার্গেট করে
সক্রিয় নেতাকর্মীকে আটক করছে। তাদেরকে দিনের পর দিন রিমান্ডে নেওয়া হচ্ছে।
অন্যদিকে গ্রেফতারকৃত নেতাকর্মীদের জামিন প্রক্রিয়াও বিলম্বিত হচ্ছে। এ
কারণে দলের ক্ষয়ক্ষতি এড়িয়ে ভিন্ন উপায়ে নতুন কর্মসূচি নিয়ে পরিকল্পনা
করছেন সিনিয়র নেতারা। এর অংশ হিসেবে গত সোমবার রাতে চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক
কার্যালয়ে দুই ঘণ্টা বৈঠক করেন তারা।
খালেদা জিয়ার জামিন নিয়ে আদালতের অবস্থান বিএনপিকে উদ্বিগ্ন করে তুলছে।
বিষয়টি বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশি কূটনীতিকদের অবহিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে
দলটি। এ ছাড়া পরবর্তী করণীয় নির্ধারণে দু-একদিনের মধ্যে দলীয় ফোরামে আলোচনা
করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এর জন্য যৌথ সভা আহ্বান করবে দলটি। একইভাবে
২০ দলীয় জোটের বৈঠক আহ্বান করা হবে। এ বিষয়ে বৈঠকে উপস্থিত একজন নেতা
জানান, দলীয় প্রধানের মুক্তি ত্বরান্বিত করতে নতুন করে কর্মসূচি দেওয়ার
পরিকল্পনা করা হচ্ছে। আলাপ-আলোচনা করে নতুন কৌশল ঠিক করা হবে।
দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী জানান, সরকার শান্তিপূর্ণ
কর্মসূচিতে বাধা দিয়ে আতঙ্ক ছড়ালেও বিএনপির নেতাকর্মীরা এখন ভয়-ডরহীন। তারা
যে কোনো ঝুঁকি নিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসনের মুক্তির আন্দোলন অব্যাহত রাখবে।
নিজস্ব কৌশলে এই আন্দোলন চলবে। সরকার যত কৌশলে বিএনপিকে নির্যাতন করবে,
তারাও তত কৌশলী হবেন। খালেদা জিয়ার মুক্তির আন্দোলন ধীরে ধীরে আরও জোরদার
করা হবে। তাকে মুক্তি দেওয়া না হলে তা তীব্র থেকে তীব্র করা হবে বলেও তিনি
মন্তব্য করেন।
- বিষয় :
- কৌশল বদলাবে না বিএনপি