জোট ও সমমনাদের কাছে প্রার্থী তালিকা চেয়েছে বিএনপি
'শান্তিপূর্ণ' আন্দোলনের পাশাপাশি চলছে নির্বাচনের প্রস্তুতি
লোটন একরাম
প্রকাশ: ০৯ মার্চ ২০১৮ | ১৯:২৬ | আপডেট: ১০ মার্চ ২০১৮ | ০৮:০৬
দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে 'শান্তিপূর্ণ' আন্দোলনের
পাশাপাশি নির্বাচনের প্রস্তুতিও নিচ্ছে বিএনপি। দলের নেতারা মুখে
নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার, খালেদা জিয়ার মুক্তি ও সংসদ ভেঙে না দিলে
নির্বাচনে যাবে না বলে হুমকি দিলেও ভেতরে-ভেতরে চলছে নির্বাচনের যাবতীয়
প্রস্তুতি। ইতিমধ্যে ২০ দলীয় জোটের শরিক দল এবং জোটের বাইরে সমমনা দলগুলোর
কাছে 'সম্ভাব্য' প্রার্থীদের নামের তালিকা চেয়েছে বিএনপি। শেষ পর্যন্ত
নির্বাচনে গেলে জোটের শরিক ও সমমনা 'যোগ্য' নেতাদের যথাযথ মূল্যায়নের
আশ্বাসও দিয়ে যাচ্ছে দলটি। বিএনপি ও জোটের একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র এ তথ্য
জানিয়েছে।
বিএনপির আশ্বাসে পুরোপুরি সন্তুষ্ট হতে পারছেন না জোটের শরিক ও সমমনা
নেতারা। উদ্ভূত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে জোটের 'ভাঙন' ঠেকাতেই বিএনপি আগাম
প্রার্থী তালিকা চেয়েছে বলে মনে করেন তারা। আপাতত পরিস্থিতি মোকাবেলা করতেই
বিএনপি এ কৌশল নিচ্ছে বলে দাবি করেন জোট নেতারা।
বিএনপির নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, একাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ২০
দলীয় জোটের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি শরিক দলকে নিয়ে চিন্তিত বিএনপি। সরকারের
পক্ষ থেকে ওইসব দলের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে। জোট থেকে বের হলে প্রত্যাশিত
আসন দেওয়ার আশ্বাসও পাচ্ছেন তারা। ওইসব দলের নেতারা বিষয়টি দলের মহাসচিব
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ সিনিয়র নেতাদের অবহিত করেছেন।
এ বিষয়ে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সমকালকে বলেন, এ মুহূর্তে ২০ দলীয় জোটের
নেত্রী ও দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে আন্দোলনে রয়েছেন
তারা। খালেদা জিয়াকে মুক্ত করে নির্দলীয় সরকারের অধীনে এবং সংসদ ভেঙে
দেওয়ার পর নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেবে বিএনপি। এখনই আসন বণ্টনের
সময় হয়নি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নির্বাচনী জোট আছে, তাই শরিকদের
আসন তো দেওয়া হবেই। আসন বণ্টন নিয়ে জোটের মধ্যে কোনো সমস্যা হবে না।
সূত্র জানায়, বিএনপি মহাসচিব বিষয়টি দলের কারারুদ্ধ চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া
এবং লন্ডনে অবস্থানরত ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে অবহিত করেছেন।
দলের দুই শীর্ষ নেতার পরামর্শে শরিকদের যথাযথ মূল্যায়নের আশ্বাস দিয়ে
যেকোনো মূল্যে জোট অটুট রাখতে পরামর্শ দিয়েছেন। দলের হাইকমান্ডের পরামর্শ
অনুযায়ী জোটের শরিকদের সম্ভাব্য প্রার্থী তালিকা চাওয়া হয়েছে। বিশেষ করে
সরকারি দলের টার্গেট দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ বাড়িয়ে দিয়েছেন বিএনপি নেতারা।
সূত্র জানায়, জোটের ঐক্য অটুট রাখার পাশাপাশি আওয়ামী লীগকে মোকাবেলা করতে
জোটের বাইরে দলগুলোকে নিয়ে পৃথক জোট করারও জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে
বিএনপি। ইতিমধ্যে সমমনা ওইসব দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে ভেতরে ভেতরে নিবিড়
যোগাযোগ রক্ষা করছেন বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা। বিকল্পধারার চেয়ারম্যান
অধ্যাপক ডা. একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী, গণফোরামের সভাপতি ড. কামাল হোসেন,
জেএসডির সভাপতি আ স ম আবদুর রব, নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান
মান্না, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর আবদুল কাদের সিদ্দিকীর দলকে
নিয়ে ২০ দলের বাইরে মহাজোটের আদলে পৃথক 'প্ল্যাটফর্ম' গড়ার পরিকল্পনা
করছে। বিএনপির পরিকল্পনা, এই 'প্ল্যাটফর্ম' হবে আগামী নির্বাচনের জন্য।
নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে এলে নতুন ওই জোটের সঙ্গে নির্বাচনী মোর্চা করবে তারা।
সম্ভাব্য প্রার্থীদের নামের তালিকা চাওয়ার ব্যাপারে কৌশলগত কারণে প্রকাশ্যে
স্বীকার করতে রাজি নন বিএনপি নেতারা। নাম প্রকাশ না করে তারা বলছেন, জোটের
শরিকদের প্রত্যাশা কি- তা আগে থেকে জানলে ভালো হয়। সে জন্য আগাম তাদের
কাছে সম্ভাব্য প্রার্থী তালিকা চাওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে জোটের শরিক ও সমমনা নেতারাও এ মুহূর্তে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু বলতে
নারাজ। তারা বলছেন, এ ব্যাপারে কিছু বলার সময় এখনও হয়নি। তবে হয়তো বিএনপি
জোটের অটুট ধরে রাখতেই অনানুষ্ঠানিকভাবে আগাম প্রত্যাশিত সম্ভাব্য
প্রার্থীদের নামের তালিকা চাইতে পারে। কারণ বর্তমানে জোটের শরিকদের সামনে
সরকারের দিক থেকে লোভনীয় প্রস্তাব আসতে পারে। তাই বিএনপিও জোটের শরিকদের
প্রত্যাশা অনুযায়ী আসন দেওয়ার আশ্বাস দিতে পারে। তবে শেষ পর্যন্ত কয়টি আসন
দেবে- তা সময়ই বলে দেবে।
জোটভুক্ত লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির একজন নেতা জানিয়েছেন, তাদের কাছে
বিএনপির পক্ষ থেকে সম্ভাব্য প্রার্থী তালিকা চাওয়া হয়েছে। অবশ্য চেয়ারম্যান
কর্নেল (অব.) অলি আহমদ সমকালকে বলেছেন, এখন তাদের মুখ্য বিষয় বিএনপি
চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির আন্দোলন। আসন বণ্টন নিয়ে আলোচনার সময় এখন
নয়। অন্যদিকে দলের যুগ্ম মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম সমকালকে বলেন,
জোটনেত্রী খালেদা জিয়ার মুক্তির আন্দোলনের পাশাপাশি নির্বাচনের প্রস্তুতিও
নেওয়া প্রয়োজন বলে জোটের অনেক নেতাই মনে করেন।
বিজেপি চেয়ারপারসন ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থ সমকালকে বলেন, আসন
বণ্টনের ব্যাপারে জোটের অন্য দলের কারও সঙ্গে আলোচনা হলেও হতে পারে, তার
সঙ্গে হয়নি।
বিএনপির নীতিনির্ধারক সূত্র জানায়, জোট ও সমমনাদের নিয়ে ভোটযুদ্ধে লিপ্ত
হওয়ার প্রস্তুতির পাশাপাশি নিজ দলের নির্বাচনের প্রস্তুতি চলছে বিএনপি
অভ্যন্তরে। জোট ও সমমনা দলগুলোর জন্য ৫০ আসন রেখে বাকি আড়াইশ' আসনে জোটের
যোগ্য ও জনপ্রিয় প্রার্থী তালিকা প্রস্তুত করছে দলটি। ইতিমধ্যে সম্ভাব্য
প্রার্থী বাছাইয়ে দলীয় এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেও একাধিক জরিপ
চালিয়েছে বিএনপি। প্রতিটি আসনে জনপ্রিয় ও ত্যাগী ৩ জন নেতার নাম
তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।
জানা গেছে, খালেদা জিয়া কারাগারে থাকলেও বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলের শরিকরা
আসন ভাগাভাগির ফয়সালা চায়। বিএনপির এ পরিকল্পনায় ২০ দলের ছোট শরিকরা
প্রত্যাশিত আসন না পাওয়ার আশঙ্কা করছে। শরিকদের সঙ্গে বিএনপির অতীতের আচরণও
সুখকর নয় মনে করেন জোট নেতারা। এ পরিস্থিতিতে এবার ১৯ শরিকের দাবির
তালিকায় রয়েছে শতাধিক আসন। খালেদা জিয়াকে জেলে রেখে ভোটের আলাপে বিএনপি
প্রথম দিকে রাজি না থাকলেও জোটের চাপে এখন নড়েচড়ে বসছে। সম্ভাব্য প্রার্থী
তালিকা দিতে বলছে তারা। সব শরিকদের জন্য সর্বোচ্চ ৫০ আসন ছাড়বে তারা।
কিন্তু জামায়াতে ইসলামীর একারই দাবি ৫০ আসন। বাকি দলগুলোর দাবির তালিকায়
আরও অর্ধশতাধিক আসন।
জোট নেতাদের সূত্রে জানা গেছে, আগামী নির্বাচনে ২০ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক
জামায়াতে ইসলামী অন্তত ৫০ আসন চাইবে। ইতিমধ্যে তারা ওইসব আসনে সম্ভাব্য
প্রার্থীদের প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছে। অন্যদিকে জোটের আরেক
অন্যতম শরিক এলডিপি ৩০টি আসন চাইবে। ইতিমধ্যে গত ২ মার্চ সম্ভাব্য
প্রার্থীদের নামের তালিকাসহ গণমাধ্যমে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিও পাঠিয়েছে দলটি।
প্রার্থী দেওয়ার প্রস্তুতি রয়েছে এলডিপি। বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি ১টি আসন
চাইবে।
এছাড়া জাপার (জাফর) ২০টি, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম দুই অংশে ৫টি, খেলাফত মজলিশ
৩টি, কল্যাণ পার্টি ২টি, ন্যাপ ২টি, জাগপা ২টি, এনপিপি ১টি, এনডিপি ১টি,
মুসলিম লীগ-বিএমএল ১টি, ডেমোক্রেটিক লীগ ১টি, সাম্যবাদী দল ১টি, লেবার
পার্টি ১টি, পিপলস্ লীগ, ইসলামিক পার্টি, ইসলামী ঐক্যজোট, ন্যাপ ভাসানী
ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করতে চায়।
২০০১ ও ২০০৮ সালে চারদলীয় জোটের ব্যানারে নির্বাচনে অংশ নেয় বিএনপি। ২০০১
সালে শরিকদের ৪৫ আসন ছেড়েছিল বিএনপি। সেই সময়কার ইসলামী ঐক্যজোট ও বিজেপিকে
১৫ আসন ছাড়লেও, দল দুটির প্রার্থীরা 'ধানের শীষ' প্রতীকে নির্বাচনে অংশ
নেন। ২৭০ আসনে ছিল ধানের শীষের প্রার্থী। বাকিগুলোতে জামায়াত 'দাঁড়িপাল্লা'
প্রতীকে জোটের সমর্থনে ভোটে লড়ে। ২০০৮ সালে জামায়াতকে ৩৫ আসন ছেড়ে দেয়
বিএনপি। ২৬০ আসনে ছিল 'ধানের শীষ'-এর প্রার্থী। এর মধ্যে কয়েকজন ছিলেন শরিক
দলের। যারা বিএনপির প্রতীকে ভোটে লড়েছিলেন।