ঢাকা মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪

ভোটের হাওয়া মৌলভীবাজার-৪

ব্যক্তি নয়, নৌকা বনাম ধানের শীষের লড়াই

ব্যক্তি নয়, নৌকা বনাম ধানের শীষের লড়াই

নূরুল ইসলাম, মৌলভীবাজার, প্রনীত রঞ্জন দেবনাথ, কমলগঞ্জ ও শামীম আকতার হোসেন, শ্রীমঙ্গল

প্রকাশ: ০৮ ডিসেম্বর ২০১৭ | ১৯:১৬

ব্যক্তি নয়, প্রতীকেই জয়-পরাজয় নির্ধারণ হয় মৌলভীবাজার-৪ (শ্রীমঙ্গল ও কমলগঞ্জ) আসনে। বিএনপি ও জাতীয় পার্টির শাসনামলের দুটি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন ছাড়া প্রতিটি নির্বাচনেই এই আসনে জয় পেয়েছে নৌকা প্রতীক। তবে নৌকার একচেটিয়া দাপট থাকার পরও আগামী নির্বাচন নিয়ে এখনই চিন্তিত হয়ে পড়েছেন আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মীরা। এ আসনে অভ্যন্তরীণ কোন্দলে জর্জরিত আওয়ামী লীগ।

দীর্ঘ সময় আওয়ামী লীগের জেলা সভাপতির পাশাপাশি চিফ হুইপ ও বিরোধীদলীয় চিফ হুইপের দায়িত্ব পালন করায় নেতাকর্মীদের মধ্যে ব্যাপক প্রভাব-প্রতিপত্তি রয়েছে পাঁচবারের এমপি উপাধ্যক্ষ আবদুস শহীদের। এবারও তিনি মনোনয়ন প্রত্যাশা করছেন। তার প্রতিপক্ষ অবশ্য বলছেন, উপাধ্যক্ষ আবদুস শহীদ মন্ত্রিসভায় স্থান পাননি। দলের সভাপতির পদও হারিয়েছেন। আগামী নির্বাচনে দলীয় মনোনয়নও হারাতে পারেন। তার পাশাপাশি দলীয় প্রার্থিতার প্রতিযোগিতায় নেমেছেন অন্তত চারজন শক্তিশালী নেতা। বর্ষীয়ান এই নেতার সঙ্গে আওয়ামী লীগে দলীয় প্রার্থিতার প্রতিযোগিতায় নেমেছেন অন্তত চার শক্তিশালী নেতা- কমলগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান অধ্যাপক রফিকুর রহমান, শ্রীমঙ্গল উপজেলা চেয়ারম্যান রণধীর কুমার দেব, শ্রীমঙ্গল পৌরসভার সাবেক মেয়র আবদুর রহিম এবং জেলার সাবেক সিভিল সার্জন ডা. হরিপদ রায়।

অন্যদিকে, এ আসনে এমনিতেই বিএনপি সাংগঠনিকভাবে বেশ দূর্বল। তার ওপর গ্রুপিং রাজনীতির কারণে গৃহদাহের মধ্যে পড়েছেন স্থানীয় নেতাকর্মীরা। দলের জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য মুজিবুর রহমান চৌধুরীর সঙ্গে মনোনয়নের দৌড়ে শামিল হয়েছেন কমপক্ষে চার নতুন মুখ। এর মধ্যে একজন প্রবাসীও রয়েছেন। বিএনপির জেলা সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক কমলগঞ্জে পৃথক দুটি কমিটি নিয়ন্ত্রণ করছেন। দু'পক্ষের একাধিক অনুসারী আগামী নির্বাচনে দলের মনোনয়ন চাইছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন দলের জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য মুজিবুর রহমান চৌধুরী, শ্রীমঙ্গল পৌর মেয়র মহসিন মিয়া মধু, দলের শ্রীমঙ্গল উপজেলা সভাপতি আতাউর রহমান লাল হাজী, সাধারণ সম্পাদক ইয়াকুব আলী ও জেলা ছাত্রদলের সাবেক সহসভাপতি জালাল উদ্দিন জিপু।

আওয়ামী লীগে একাধিক নেতা মনোনয়ন চাইলেও তা নিয়ে খুব চিন্তিত নন বলে সমকালকে জানান উপাধ্যক্ষ আবদুস শহীদ। তিনি বলেন, 'দলের মনোনয়ন চাওয়া গণতান্ত্রিক অধিকার। আর আওয়ামী লীগ বড় দল। তাই অনেকেই সম্ভাব্য প্রার্থী তালিকায় থাকতেই পারেন। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।' তিনি জানান, ৫৩ বছর ধরে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে থাকলেও কারও সঙ্গেই তার কোনো দূরত্ব নেই। তৃণমূলের নেতাকর্মীসহ জনগণের ভালোবাসায় বার বার নির্বাচিত হয়ে তিনি জনকল্যাণে কাজ করেছেন।

দলের কয়েকজন নেতাকর্মীর দৃষ্টিতে, আবদুস শহীদ ত্যাগী নেতাকর্মীদের বঞ্চিত করে দলে পারিবারিক বলয় তৈরি করেছেন। ভাই মোসাদ্দেক আহমদ মানিককে দলের কমলগঞ্জ উপজেলার সভাপতি করেছেন। আরেক ভাই ইমতিয়াজ আহমদ বুলবুল ঠিকাদার কল্যাণ সমিতির সভাপতি ও জাতীয় উদ্যান লাউয়াছড়া সহ-ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি। আরেক ভাই ইফতেখার আহমদ বদরুল রহিমপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান।

এই আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশী আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য অধ্যাপক রফিকুর রহমান বলেন, হুইপ থাকাকালে উপাধ্যক্ষ আবদুস শহীদ নেতাকর্মীসহ সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিলেমিশে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতেন। কিন্তু চিফ হুইপ হওয়ার পর তিনি বদলে যান। উপেক্ষিত হন ত্যাগী নেতাকর্মীরা। বিএনপি ঘরানার লোকজন তার প্রিয় হয়ে ওঠেন।

কয়েকজন চা শ্রমিকের মতে, ২০০৯ সালে চা শ্রমিক নেতাদের শ্রীমঙ্গলের লেবার হাউস থেকে বিতাড়িত করে বিজয় বুনার্জীসহ কয়েকজনকে নেতৃত্বে আনা হয়েছিল। এর পেছনে উপাধ্যক্ষ আবদুস শহীদের ইন্ধন ছিল। ওই সময়ে চা শ্রমিকদের পক্ষে অবস্থান নেন অধ্যাপক রফিকুর রহমান। তাই তার প্রতি চা শ্রমিকদের কিছুটা দুর্বলতা রয়েছে বলে জানান চা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক রাম ভজন কৈরী।

সাতগাঁও ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান, হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সমর্থনপুষ্ট রণধীর কুমার দেবও চা বাগান-সংশ্নিষ্ট সংখ্যালঘু নেতা হিসেবে বেশ গ্রহণযোগ্য। তিনি গতবারের মতো আগামী নির্বাচনেও দলের মনোনয়ন চাইবেন। প্রধানমন্ত্রীর কাছে মনোনয়ন চাইবেন জানিয়ে তিনি বলেন, জনকল্যাণে তিনি সক্রিয় রয়েছেন।

মুক্তিযোদ্ধা আবদুর রহিম বলেন, গত নির্বাচনের মতো তিনি আগামী নির্বাচনেও দলের মনোনয়ন চাইবেন। তার বিশ্বাস, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে মনোনয়ন দেবেন। তার ক্ষোভ, এই আসনের একজন প্রভাবশালী নেতা ২০১৪ সালের নির্বাচন-পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ওপর হামলা, যানবাহন ভাংচুর ও গাড়ি পোড়ানোর চার্জশিটভুক্ত বিএনপি নেতাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছেন।

ডা. হরিপদ রায় বলেন, একজন চিকিৎসক হিসেবে তিনি সব সময়ই মানবসেবায় নিয়োজিত রয়েছেন। এখন জনপ্রতিনিধি হিসেবে জনসেবা করতে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চাইছেন। উপাধ্যক্ষ আবদুস শহীদ ও অধ্যাপক রফিকুর রহমান তার অগ্রজ ও শ্রদ্ধেয় নেতা হলেও দলের একজন কর্মী হিসেবে তিনি এ মনোনয়ন প্রত্যাশা করছেন।

এদিকে নির্বাচনী প্রস্তুতি সম্পর্কে বিএনপির কমলগঞ্জ উপজেলার একাংশের সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক গোলাম কিবরিয়া শফি বলেন, দলের জাতীয় নির্বাহী কমিটির নেতা মুজিবুর রহমান চৌধুরী দলীয় নেতাকর্মীদের মূল্যায়ন করেন না। তিনি আওয়ামী লীগের চিহ্নিত কিছু মানুষকে গুরুত্ব দেন। তৃণমূল নেতাকর্মীদের সঙ্গে তার কোনো যোগাযোগ নেই। তিনি ব্যস্ত ঢাকায় তার ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে। তাকে বাদ দিয়ে অন্য যে কোনো স্বচ্ছ ক্লিন ইমেজের নেতাকে মনোনয়ন দেওয়া হলে নেতাকর্মীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষও উজ্জীবিত হবেন। প্রায় একই কথা বলেছেন দলের আরেক যুগ্ম আহ্বায়ক আনোয়ার হোসেন বাবু।

মুজিবুর রহমান চৌধুরী অবশ্য এসব অভিযোগ অস্বীকার করেন। সমকালকে তিনি বলেন, পুলিশি হয়রানির ভয়ে তিনি এলাকায় যেতে পারেন না। কখনও এলাকায় গেলে পুলিশের গাড়ি তার কমলগঞ্জের বাড়ি কিংবা শ্রীমঙ্গলের রিসোর্টের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। তার পরও রয়েছে মামলা-হামলার ভয়। এর পরও তৃণমূল নেতাকর্মীদের সঙ্গে টেলিফোনে তার সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রয়েছে। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ থেকে সুযোগ-সুবিধা নেওয়া বিএনপির কয়েকজন নেতা উপাধ্যক্ষ আবদুস শহীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করছেন। তারা আওয়ামী লীগের বি-টিম হিসেবে পরিচিত। তবে নির্বাচনের সময় তারাও তাকে ভোট দেবেন বলে তার বিশ্বাস। তার প্রশ্ন, এই আসনে তিনি ছাড়া বিএনপির মনোনয়ন কে পাবেন?

আতাউর রহমান লাল হাজী বলেন, তিনি মানুষের কল্যাণে রাজনীতি করেন। জাতীয়তাবাদী চেতনায় আস্থাশীল। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নেতৃত্বের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। নির্বাচন করার প্রস্তুতি তার রয়েছে।

ইয়াকুব আলী জানান, তিনি দলের তৃণমূল নেতাকর্মী ও মানুষের সুখে-দুঃখে রয়েছেন। মনোনয়ন পেলে এই আসনটি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে উপহার দিতে পারবেন বলে মনে করছেন তিনি। তার কথা, বিএনপি বড় দল। এখানে নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা থাকলেও কোনো বিভেদ নেই।

কমলগঞ্জ উপজেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি দুরুদ আলী জানান, জাতীয় পার্টি এককভাবে নির্বাচনে লড়লে তিনি পার্টির মনোনয়ন চাইবেন।

সিপিবি কমলগঞ্জ শাখার সভাপতি আহমদ সিরাজ বলেন, কমলগঞ্জ ও শ্রীমঙ্গলে তাদের সাংগঠনিক ভিত্তি বেশ মজবুত। তাই দলের নির্বাচনকেন্দ্রিক যে কোনো সিদ্ধান্ত তারা মেনে নেবেন। তবে এখনই নির্বাচনের ব্যাপারে কিছু বলা সম্ভব নয় বলে তিনি জানান।

আরও পড়ুন

×