ভোটের হাওয়া : মৌলভীবাজার-২
অনৈক্য আওয়ামী লীগে, সুযোগ খুঁজছে জাপা-বিএনপি
নূরুল ইসলাম, মৌলভীবাজার ও শাকিল রশীদ চৌধুরী, কুলাউড়া
প্রকাশ: ২৩ মার্চ ২০১৮ | ১৯:৩৮
গত দু'বারের মতো আসন্ন নির্বাচনেও মৌলভীবাজার-২ (কুলাউড়া-কমলগঞ্জের একাংশ)
আসনে মহাজোটের প্রার্থিতা নিশ্চিত করতে চাইছে জাতীয় পার্টি। তবে আওয়ামী
লীগের স্থানীয় নেতারা এবার ছাড় দিতে নারাজ। অনৈক্যের ঝড় ও অভ্যন্তরীণ
দ্বন্দ্বে নানাভাগে বিভক্ত আওয়ামী লীগেও টানাপড়েন চলছে একাধিক
মনোনয়নপ্রত্যাশীর মধ্যে। এমনও শোনা যাচ্ছে, আওয়ামী লীগের সাবেক কেন্দ্রীয়
সাংগঠনিক সম্পাদক সুলতান মোহাম্মদ মনসুর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে
রেখে ঘরে ফিরছেন।
অন্যদিকে বিএনপিতে একক প্রার্থী অ্যাডভোকেট আবেদ রাজার জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে
দেখা দিয়েছেন ২০ দলীয় জোটের অন্তর্ভুক্ত জাতীয় পার্টির (জাফর) প্রার্থী,
তিনবারের এমপি নবাব আলী আব্বাস ও বিএনপিরই বহিস্কৃত নেতা সাবেক এমপি এমএম
শাহীন।
২০০৮ ও ২০১৪ সালে মহাজোটের স্বার্থে আওয়ামী লীগ এ আসনে জাতীয় পার্টিকে ছাড়
দেয়। ২০০৮ সালে জাতীয় পার্টির প্রার্থী জয়ী হলেও ২০১৪-তে আওয়ামী লীগের
বিদ্রোহী প্রার্থী আবদুল মতিনের কাছে পরাজিত হন মহাজোট প্রার্থী। পরে
বিজয়ীকে দলে ফিরিয়ে নেয় আওয়ামী লীগ। তবে ২০০১ সালের নির্বাচনে চারদলীয় জোট
প্রার্থী জামায়াতে ইসলামীর সিলেট জেলা আমির ডা. শফিকুর রহমানকে হারিয়ে জয়
ছিনিয়ে নেওয়া দলের বিদ্রোহী প্রার্থী এমএম শাহীনের বহিস্কারাদেশ এখনও
প্রত্যাহার করেনি বিএনপি।
এ আসনে এবার নৌকা প্রতীক পাওয়ার চেষ্টা করছেন বর্তমান জাতীয় সংসদ সদস্য ও
উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল মতিন, সাবেক এআইজি সৈয়দ বজলুর করীম,
সাবেক এমপি সুলতান মোহাম্মদ মনসুর, দলের সিলেট মহানগর শাখার সাংগঠনিক
সম্পাদক শফিউল আলম নাদেল, কুলাউড়া উপজেলা চেয়ারম্যান আ স ম কামরুল ইসলাম,
সিলেট বিএমএ সভাপতি রুকন উদ্দীন আহমদ, কুলাউড়া উপজেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক
রফিকুল ইসলাম রেণু, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শফি আহমদ সলমান ও যুক্তরাষ্ট্র
প্রবাসী আতাউর রহমান শামীম।
এদিকে দ্বন্দ্ব নিরসন করে স্থানীয় আওয়ামী লীগকে ঐক্যবদ্ধ করতে দলের সাবেক
কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক সুলতান মোহাম্মদ মনসুরকে সক্রিয় করে তোলার
প্রচেষ্টা চলছে। আগামী নির্বাচনে অংশ নেবেন কি-না? এমন প্রশ্নে সরাসরি
উত্তর না দিয়ে সুলতান মোহাম্মদ মনসুর সমকালকে জানান, নির্বাচনের তারিখ
নির্ধারণ হওয়ার পর কোথায় কীভাবে নির্বাচন করবেন, তা নিয়ে চিন্তা করবেন।
কুলাউড়ার সন্তান, জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি শফিউল আলম নাদেল নির্বাচনী
প্রচারণার অংশ হিসেবে এলাকায় বিনামূল্যে মেডিকেল ক্যাম্প ও চক্ষুশিবির,
শীতবস্ত্র বিতরণসহ উপজেলার ১৩টি ইউনিয়নেই মুক্তিযুদ্ধ পাঠাগার গড়ে তোলার
প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন। সমকালকে নাদেল বলেন, দলের নেতাকর্মী ও জনগণের
ভালোবাসায় রাজনীতিতে তিনি আজকের এ অবস্থান অর্জন করেছেন। জনগণের সুখ-দুঃখের
সঙ্গী হতে সম্ভাব্য একজন প্রার্থী হিসেবে কাজ করছেন তিনি। মনোনয়ন পেলে
নির্বাচনের প্রস্তুতি রয়েছে তার।
২০১৪ সালে দল থেকে মনোনয়ন পেলেও পরে কেন্দ্রীয় সভাপতির নির্দেশে মহাজোট
প্রার্থী মুহিবুল কাদির চৌধুরী পিন্টুকে প্রার্থিতা ছেড়ে দেওয়া মৌলভীবাজার
সদরের অধিবাসী সাবেক এআইজি সৈয়দ বজলুর করীম বলেন, তৃণমূল নেতাকর্মীদের
সঙ্গে তার সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রয়েছে। নেত্রীর নির্দেশে তিনি নির্বাচনী
এলাকায় কাজ করে যাচ্ছেন। মনোনয়ন পাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী এ নেতা বলেন, এবার
এ আসনটি অন্য কোনো দলকে ছাড় দেওয়া হবে না।
তবে কুলাউড়ার বরমচাল ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি আবদুর রউফ চৌধুরী বলেন, এ
আসনে কুলাউড়াবাসী বহিরাগত কাউকে দেখতে চায় না। তাই তৃণমূল আওয়ামী লীগ
নেতাদের মতামতে প্রার্থিতা চূড়ান্ত করার জন্য সংসদীয় বোর্ডের কাছে সুপারিশ
করা হবে। তাহলে দলীয় নেতাকর্মী ও জনগণ জনপ্রতিনিধিকে পাশে পাবেন।
কুলাউড়া উপজেলা চেয়ারম্যান আ স ম কামরুল ইসলাম জানান, প্রথমে উপজেলা ভাইস
চেয়ারম্যান, পরে চেয়ারম্যান হিসেবে জনকল্যাণে তিনি দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন।
বঙ্গবন্ধুর আদর্শের মানুষ হিসেবে জনগণের ভালোবাসায় তার পিতাও এ আসনের এমপি
ছিলেন। তিনিও জনগণের স্বার্থে সেই ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছেন। মনোনয়ন পেলে
জয়ের ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
দলের কুলাউড়া উপজেলা শাখার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শফি আহমদ সলমান বলেন, দলের
সিদ্ধান্তে গত নির্বাচনে তিনি মহাজোট প্রার্থীর পক্ষে নির্বাচনী কার্যক্রম
চালিয়েছেন। গত পৌরসভা নির্বাচনে তিনি মনোনয়ন পেলেও দলের একাংশের বিরোধিতায়
তখন নৌকা জিততে পারেনি। আগামীতে মনোনয়ন পেলে জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী তিনি।
উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি এবং বর্তমান এমপি আবদুল মতিনও সম্ভাব্য প্রার্থী
হিসেবে জনসংযোগ করছেন। সমকালকে এই এমপি বলেন, তিনি সব সময় স্রোতের উল্টোপথে
হেঁটে পাঁচবার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, দুই দফা উপজেলা পরিষদ
চেয়ারম্যান ও একবার এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি মনে করেন, এবার আওয়ামী লীগ
তাকে মনোনয়ন দেবে। তিনি বলেন, জনগণের প্রত্যাশা পূরণে তার সময়ে
স্কুল-কলেজ, রাস্তাঘাট সংস্কার ও ভবন নির্মাণে কোটি কোটি টাকার উন্নয়ন
কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়েছে। এলাকার ৮০ শতাংশ গ্রাম বিদ্যুতায়ন করা
হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে বর্তমান এমপি বলেন, সুলতান মোহাম্মদ মনসুর দলের
বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে দলের ক্ষতি করেছেন। দল থেকে তার মনোনয়ন পাওয়ার সুযোগ
আর নেই।
তবে কুলাউড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি অধ্যক্ষ আবদুর রউফ মনে করেন,
স্থানীয় পর্যায়ে এখন চেইন অব কমান্ড না থাকায় অনেকেই প্রার্থী হতে চাইছেন।
সুলতান মোহাম্মদ মনসুর সক্রিয় থাকার সময় নেতৃত্বে এমন দ্বন্দ্ব-বিভক্তি ছিল
না। তবে দলের হাইকমান্ড যাকে মনোনয়ন দেবে, তার জন্যই প্রচারণা চালাবেন বলে
জানান তিনি।
এদিকে জাতীয় পার্টির (এরশাদ) মৌলভীবাজারের সমন্বয়ক বড়লেখার আহমদ রিয়াজ
সক্রিয়ভাবে মাঠ পর্যায়ে কার্যক্রম চালাচ্ছেন। দলের চেয়ারম্যান হুসেইন
মুহম্মদ এরশাদের নির্দেশে মৌলভীবাজার-১ ও ২ আসনে নেতাকর্মীদের সংগঠিত করে
দলীয় কার্যক্রম পরিচালনার কথা জানান তিনি। এ ছাড়া সর্বশেষ নির্বাচনে মহাজোট
প্রার্থী জাতীয় যুব সংহতির জেলা আহ্বায়ক মুহিবুল কাদির চৌধুরী পিন্টুও
সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে মাঠে রয়েছেন।
মৌলভীবাজার-২ আসনে বিএনপি থেকে মনোনয়ন প্রত্যাশা করছেন জেলা বিএনপির
সহসভাপতি ও ২০০৮ সালের প্রার্থী অ্যাডভোকেট আবেদ রাজা। ২০০১ সালের
নির্বাচনের পর দল থেকে বহিস্কৃত তৎকালীন জেলা সহসভাপতি এমএম শাহীনও চাইছেন
বিএনপিতে ফিরে মনোনয়ন নিতে। বর্তমানে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে থাকলেও অচিরেই
ফিরে আসবেন বলে শোনা যাচ্ছে। এ ছাড়াও ২০ দলীয় ঐক্যজোট থেকে মনোনয়ন
প্রত্যাশা করছেন জাতীয় পার্টির (জাফর) কেন্দ্রীয় নেতা ও তিনবারের এমপি নবাব
আলী আব্বাস।
এ প্রসঙ্গে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থী আবেদ রাজা বলেন, ২০০৮ সালের মতো
এবারও ২০ দলীয় জোট তথা বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিলে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সব
রকম প্রস্তুতিই রয়েছে তার। প্রসঙ্গত তিনি মন্তব্য করেন, সাবেক এমপি নবাব
আলী আব্বাস ও তার দল ২০ দলীয় জোটে থাকলেও গত জেলা পরিষদ নির্বাচনে
স্বতন্ত্র প্রার্থী বিএনপির বহিস্কৃত নেতা এমএম শাহীনের পক্ষে প্রকাশ্যে
কাজ করেছেন। জোট ওই নির্বাচন বর্জন করলেও জাতীয় পার্টির এই নেতা জোটের
সিদ্ধান্ত পরিপন্থী কাজ করেছেন। তা ছাড়া কুলাউড়ায় তার দলের ভিত্তিও নেই।
নবাব আলী আব্বাস বলেন, কুলাউড়ার জনগণের আস্থা আছে বলেই তিনি তিনবার সংসদ
সদস্য হয়েছেন। এখনও তিনি জনগণের পাশে রয়েছেন। দল ও জোট নির্বাচনে অংশ নিলে
হাইকমান্ড তাকে মনোনয়ন দিয়ে তার কাজের স্বীকৃতি দেবে বলে প্রত্যাশা করেন
তিনি।
তা ছাড়া কেন্দ্রীয় জামায়াত নেতা ও সিলেট জেলা জামায়াতের সাবেক আমির ডা.
শফিকুর রহমানের এলাকায় গণসম্পৃক্ততা না থাকলেও ২০ দলীয় জোটের সম্ভাব্য
প্রার্থী তালিকায় তার নামও রয়েছে বলে জানা গেছে।
- বিষয় :
- ভোটের হাওয়া