ঢাকা মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪

রোহিঙ্গা সংকটের ৭ মাস

বিতাড়ন বন্ধ হয়নি

বিতাড়ন বন্ধ হয়নি

আবদুর রহমান, টেকনাফ ও মুহাম্মদ হানিফ আজাদ, উখিয়া (কক্সবাজার)

প্রকাশ: ২৪ মার্চ ২০১৮ | ২১:২৪

রাখাইনে সেনা অভিযান শুরুর সাত মাস পার হলেও সেখানে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন বন্ধ হয়নি। অবশিষ্ট রোহিঙ্গাদের বিতাড়ন করতেই মিয়ানমার এ নির্যাতন অব্যাহত রেখেছে বলে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া অনেকেই জানিয়েছেন। তাদের ভাষায়, এবার নির্যাতনের ধরন বদলে গেছে। এখন সেনাবাহিনীর সঙ্গে মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড পুলিশ ও বৌদ্ধরা যোগ দিয়েছে। তবে শুরু থেকেই বিভিন্ন ক্যাম্পে আশ্রয় নেওয়া নির্যাতনের শিকার এসব মানুষকে মানবিক সহায়তা দিয়ে আসছে বাংলাদেশ।


মোহাম্মদ ছালে নামে ষাটোর্ধ্ব এক রোহিঙ্গা জানান, রোহিঙ্গাদের গ্রামগুলো পুড়িয়ে বুলডোজার দিয়ে আলামত নষ্ট করার পর সেখানে রাখাইনদের বসতি করা হচ্ছে। যেসব গ্রামে রোহিঙ্গারা এখনও রয়েছে, তাদেরকে নির্যাতন করা হচ্ছে। কোনো রোহিঙ্গাকে ঘর থেকে বের হতে দিচ্ছে না। এতে তারা ব্যাপক খাদ্য সংকটে রয়েছে। ফলে এপারে চলে আসতে বাধ্য হচ্ছে।


গতকাল শনিবার বেলা দেড়টার দিকে টেকনাফের সাবরাং ইউনিয়নের হারিয়াখালী ত্রাণকেন্দ্রে পৌঁছে তিনি এসব কথা বলেন। তার বাড়ি মিয়ানমারের মংডু হাসসুরাত গ্রামে। নাফ নদ পেরিয়ে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ  করেন তিনি। 


ছালে আরও জানান, বিস্কুট খেয়ে মানুষ কতদিন থাকতে পারে! তাই ছেলেদের কান্না সহ্য করতে না পেরে ৫ দিন আগে দুই  কিলোমিটার দূরে একটি বাজারে খাবার কিনতে বের হন। এ সময় তার ওপর ব্যাপক নির্যাতন চালায় বিজিপি ও বৌদ্ধরা। পরে পালিয়ে বেঁচে যান। তারা রাতে গ্রামে গিয়েও ঘরবাড়িতে হামলা চালাচ্ছে। এ সময় সকাল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশে পালিয়ে যাওয়ার জন্য হুমকি দেয় তারা।


ত্রাণকেন্দ্রের সড়কের পাশে বসে কাঁদছেন রাজিয়া। কোলে ১ বছরের শিশু মাজেদ। সেও কাঁদছে। রাজিয়া জানান, তাদের এলাকায় মিয়ানমার সেনারা রীতিমতো তা ব চালিয়ে যাচ্ছে। যাকে পাচ্ছে মারধর ও হুমকি দিচ্ছে। অনেক দিন পালিয়ে থাকার পর স্বামী নুর হোসেনকে নিয়ে এপারে এসেছেন। এখনও থাকার জায়গা হয়নি তাদের। 


গত বছরের ২৫ আগস্ট নিরাপত্তা বাহিনীর চেকপোস্টে হামলার ঘটনাকে কেন্দ্র করে মিয়ানমার সেনাবাহিনী দেশটির রোহিঙ্গাদের ওপর নৃশংস অভিযান শুরু করে। এর পর থেকে এ পর্যন্ত ৭ লক্ষাধিক মানুষ বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছে। চলতি মাসে গতকাল পর্যন্ত টেকনাফ সীমান্ত দিয়েই ৭ শতাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছে বলে সমকালকে জানান হারিয়াখালী ত্রাণকেন্দ্রে দায়িত্বরত জেলা প্রশাসকের প্রতিনিধি ও উপজেলার জ্যেষ্ঠ মৎস্য কর্মকর্তা দেলোয়ার হোসেন। লেদা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নেতা আবদুল মতলব বলেন, সম্পূর্ণ বিতাড়নের জন্যই রোহিঙ্গাদের ওপর এখনও নির্যাতন অব্যাহত আছে। টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রবিউল হাসান বলেন, নাফ নদ পেরিয়ে যারা বাংলাদেশে ঢুকেছে, তাদেরকে ক্যাম্পে পাঠানো হচ্ছে। 


এদিকে উখিয়া-টেকনাফের প্রায় ৩০টি শরণার্থী ক্যাম্পে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা সরকারি-বেসরকারি সুযোগ-সুবিধা পেলেও ভাসমান অবস্থায় তারা দীর্ঘদিন ধরে থাকতে চান না। তা ছাড়া আসন্ন বর্ষা মৌসুমে ঝুঁকিতে পড়ার আশঙ্কায় স্বদেশে ফিরে যেতে চান। গতকাল কুতুপালং আশ্রয় ক্যাম্পের রোহিঙ্গা নেতারা এসব কথা জানান।


প্রত্যাবাসনে মিয়ানমার সরকারের কোনো সহানুভূতি নেই জানিয়ে রোহিঙ্গা নেতা ডা. ফয়সাল আনোয়ার জানান, বুচিডং ও রাশিডং এলাকায় বসবাসরত তাদের আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে ফোনে কথা বলে জেনেছেন, গ্রামের নারী-শিশুরা নিখোঁজ হয়ে যাচ্ছে। যুবকরা দিনে পাহাড়-জঙ্গলে আশ্রয় নেয়। রাতে বাড়ি ফিরলেও ভয়ে ঘুমাতে পারছে না। বিশেষ করে বুচিডং, রাশিডং এলাকায় অবশিষ্ট প্রায় ৪ লাখ রোহিঙ্গা হাটবাজারে যেতে পারছে না; শ্রমজীবীরা কাজ করতে পারছে না। খাদ্যসহ বিভিন্ন সংকটে তারা যে কোনো সময় এ দেশে চলে আসতে পারে। রাশিডংয়ের নেতা আশরাফ আলীর উদ্ৃব্দতি দিয়ে বালুখালী ক্যাম্পের লালু মাঝি জানান, রোহিঙ্গাদের এখন অপহরণ ও গুম করা হচ্ছে। 


সম্প্রতি মংডুর চাইদাথং থেকে আসা আহমদ নূর জানান, তার গ্রামে এখনও ৬০-৬৫টি পরিবার রয়েছে। রাখাইনের সশস্ত্র যুবকরা নেশাগ্রস্ত অবস্থায় বাড়িতে ঢুকে নারীদের শ্নীলতাহানি করছে। বলছে গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে। তিনি জানান, পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের জমি ও বাড়িতে সেনা ক্যাম্প করা হচ্ছে। রাখাইনদের বাড়িঘর নির্মাণ করে দিচ্ছে কর্তৃপক্ষ। এ অবস্থায় রোহিঙ্গারা বাপ-দাদার ভিটার অস্তিত্ব খুঁজে পাবে না। 


কুতুপালং রোহিঙ্গা বস্তি ম্যানেজমেন্ট কমিটির সভাপতি আবু ছিদ্দিক ও সম্পাদক মোহাম্মদ নূর জানান, তাদের ক্যাম্পে নতুন-পুরাতন মিলে প্রায় দেড় লাখ রোহিঙ্গা রয়েছে। নতুন যারা এসেছে তারা খুবই কষ্টে আছে। যেহেতু পলিথিনের ছাউনির নিচে ছেলেমেয়ে নিয়ে গাদাগাদি করে প্রচণ্ড খরতাপে বাস করতে হচ্ছে, তাই কষ্টটা বেড়েছে। 


রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম কমিটির সভাপতি অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী বলেন, সর্বশেষ ১৬ ফেব্রুয়ারি দু'দেশের স্বরাষ্ট্র্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে মিয়ানমার থেকে আসা ৬৭৩ পরিবারের ৮০৩২ রোহিঙ্গার তালিকা মিয়ানমারকে হস্তান্তর করা হয়। মিয়ানমার ওই তালিকা যাচাই-বাছাই করে ৩৭৪ জনকে ফিরিয়ে নিতে সম্মত হলেও কখন, কীভাবে প্রত্যাবাসন শুরু হবে তার সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রকাশ করেনি। এর মধ্যে সেখানে রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে। এমতাবস্থায় প্রত্যাবাসন অনিশ্চিত বলা চলে।


উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. নিকারুজ্জামান চৌধুরী বলেন, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফিরে না যাওয়া পর্যন্ত এখানে যাতে মানবিক বিপর্যয়ে না পড়ে, সেদিকে প্রশাসনের নজর রয়েছে। বর্ষার আগেই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থান থেকে তাদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হবে।

আরও পড়ুন

×