ঢাকা মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪

পণ্যমূল্যে কারসাজি

৫৫ টাকায় আমদানি করা ছোলা ৭৫ টাকায় ২৭ টাকার পেঁয়াজ ৪৫ টাকা - ৪০ টাকার চিনি ৬২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে

পণ্যমূল্যে কারসাজি

সারোয়ার সুমন, চট্টগ্রাম

প্রকাশ: ১৮ মে ২০১৮ | ১৯:৩৮

রমজানে অতি প্রয়োজনীয় কয়েকটি পণ্য আমদানি মূল্যের দেড়গুণ থেকে প্রায় দ্বিগুণ দামে বিক্রি হচ্ছে খুচরা বাজারে। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে গত চার মাসে আসা প্রতিকেজি ছোলার শুল্ক্কসহ আমদানি খরচ ছিল ৫৫ টাকা ৫১ পয়সা। অথচ খুচরা বাজারে ছোলা বিক্রি হচ্ছে ৭৫ টাকায়।

একইভাবে শুল্ক্কসহ ২৭ টাকায় আমদানি করা পেঁয়াজ ৪৫ টাকায় এবং ৬৮ টাকার রসুন বিক্রি হচ্ছে ১২০ টাকায়। আবার শুল্ক্ক, ব্যাংক ঋণ, পরিশোধন ব্যয় ও পরিবহন খরচ যুক্ত করার পরও ৮০ টাকার ভোজ্যতেল ১০৮ টাকা ও ৪০ টাকার চিনি ৬২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

আমদানি পর্যায় থেকে হাত ঘুরে খুচরা পর্যায়ে যেতেই দেশে কোনো কোনো ভোগ্যপণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে। কিছু মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ী বাড়াচ্ছেন পণ্যের দাম। চট্টগ্রামের বৃহত্তম পাইকারি মোকাম খাতুনগঞ্জে এবার দাম কিছুটা সহনীয় থাকলেও রমজানের শুরুতেই খুচরা পর্যায়ে দাম নিয়ে হচ্ছে ব্যাপক কারসাজি।

এ ব্যাপারে খাতুনগঞ্জ ট্রেড অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, আমদানি মূল্য হিসাব করলে দেখা যায় খুচরা বাজারে প্রায় দ্বিগুণ দামে বিক্রি হচ্ছে পেঁয়াজ, ছোলা, চিনিসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য। মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার থাকলে এমনটি হতো না। খাতুনগঞ্জে এবার দাম নিয়ে তেমন কারসাজি না হলেও খুচরা বাজারের চিত্র ঠিক বিপরীত।

এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ইলিয়াছ হোসেন বলেন, কিছু ব্যবসায়ী কারসাজি করার উদ্দেশ্যেই কাগজে-কলমে একাধিক ব্যক্তির কাছে পণ্য হাতবদল করছে। এভাবে হাতবদল করে পণ্যের দাম বাড়িয়ে নিচ্ছে তারা। খুচরা বাজারে একেক দোকানে পণ্যের দাম একেক রকম। আমদানির তুলনায় কোনো কোনো পণ্য খুচরা বাজারে দ্বিগুণ দামে বিক্রি হচ্ছে এখনও।'

অথচ রমজানে জিনিসপত্রের দাম না বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ব্যবসায়ীরা। ঢাকায় বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদের উপস্থিতিতে গত ১৩ মে অনুষ্ঠিত বৈঠকে ব্যবসায়ীরা পর্যাপ্ত পণ্য আমদানির কথা স্বীকার করেন। চট্টগ্রামে জেলা প্রশাসকের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত পৃথক আরেকটি বৈঠকেও এখানকার ব্যবসায়ীরা এবার পণ্যের দাম বাড়বে না বলে ঘোষণা দেন। চট্টগ্রামের বৈঠকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে কারসাজি করে কেউ দাম বাড়ালে মনিটরিং টিমের মাধ্যমে সাজা দেওয়ার বিষয়টিতেও তারা একমত পোষণ করেন।

৫৫ টাকার ছোলা বিক্রি হচ্ছে ৭৫ টাকায় : চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে গত চার মাসে ৭০ জন ব্যবসায়ী ৮৩২ কোটি টাকায় এক লাখ ৫০ হাজার টন ছোলা আমদানি করেন। এ পণ্য বাবদ তারা চট্টগ্রাম কাস্টমসে আমদানি শুল্ক্ক দেন ৭১ লাখ ৪৬ হাজার টাকা। শুধু আমদানি মূল্যের সঙ্গে শুল্ক্কহার যোগ করা হলেও প্রতি কেজি ছোলার দাম পড়ে ৫৫ টাকা ৫১ পয়সা। কিন্তু খুচরা বাজারে ছোলা বিক্রি হচ্ছে ৭৫ থেকে ৮০ টাকায়। অর্থাৎ আমদানি মূল্যের প্রায় দ্বিগুণ দামে বিক্রি হচ্ছে ছোলা। শীর্ষ আমদানিকারকদের মধ্যে বসুন্ধরা ট্রেডিং কোম্পানি ১৩৯ কোটি টাকায় এককভাবে সর্বোচ্চ ২৫ হাজার ৯১৭ টন ছোলা আমদানি করেছে। তাদের প্রতি কেজি ছোলার দাম পড়েছে ৫৩ টাকা ৬৩ পয়সা। ১১৫ কোটি টাকায় সাড়ে ২১ হাজার ৫০০ টন ছোলা বুট আমদানি করে দ্বিতীয় স্থানে আছে সিটি ডাল মিলস লিমিটেড। তাদের আমদানি করা ছোলার দাম পড়েছে ৫৩ টাকা ৪৮ পয়সা। অন্য শীর্ষ আমদানিকারকদের মধ্যে সিলভার ডাল অ্যান্ড মিলস লিমিটেড, লাকি ট্রেডিং, ইফাদ মাল্টি প্রোডাক্ট লিমিটেড, একে করপোরেশন, হাছান অটোমেটিক ডাল মিলস, সালমা ট্রেডিং, চৌধুরী করপোরেশন ও ট্রেড কোম্পানির প্রতি কেজি ছোলার দাম পড়েছে ৪৯ টাকা থেকে ৫২ টাকার মধ্যে। এসব প্রতিষ্ঠান দুই হাজার টন থেকে সর্বোচ্চ ২৫ হাজার ৯০০ টন পর্যন্ত ছোলা বুট আমদানি করেছে।

২৭ টাকার পেঁয়াজ ৪৫ টাকা :অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৮ সালের প্রথম চার মাসে ২০টি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান দেড় কোটি টাকায় ৫৫১ টন পেঁয়াজ আমদানি করে। এসব পণ্য আমদানি বাবদ তারা শুল্ক্ক দিয়েছে সাড়ে ৩২ হাজার টাকা। আমদানি মূল্যের সাথে শুল্ক্ক যোগ করা হলেও তাদের আমদানি করা প্রতি কেজি পেঁয়াজের মূল্য পড়েছে ২৭ টাকা ২৮ পয়সা। কিন্তু খুচরা বাজারে পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৪৫ থেকে ৫০ টাকায়। শীর্ষ পাঁচ পেঁয়াজ আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একে ট্রেডিং ৭৬ লাখ টাকা মূল্যের ২৬৬ টন পেঁয়াজ আমদানি করে। তাদের প্রতি কেজি পেঁয়াজ কিনতে খরচ হয়েছে ২৮ টাকা ৫৭ পয়সা। অন্যদের মধ্যে সুরমা টেক্স ২৫ লাখ টাকা মূল্যের ৮৭ টন, মক্কা এন্টারপ্রাইজ ১৪ লাখ টাকায় ৮৪ টন, জেনি এন্টারপ্রাইজ ১৬ লাখ টাকা মূল্যের ৫৮ টন ও এনএন এন্টারপ্রাইজ ১৮ লাখ টাকা মূল্যের ৫৬ টন পেঁয়াজ আমদানি করেছে। এদের প্রতি কেজি পেঁয়াজ কিনতে খরচ হয়েছে মাত্র ২৬ টাকা থেকে ২৮ টাকা।

৭২ টাকার রসুন ১২০ টাকা : রমজানের জন্য চলতি বছরের প্রথম চার মাসে ৭০টিরও বেশি প্রতিষ্ঠান ১১০ কোটি টাকায় ১৬ হাজার টন রসুন আমদানি করেছে। এ জন্য তারা শুল্ক্ক দিয়েছে ৫ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। আমদানি মূল্যের সঙ্গে শুল্ক্ক যোগ করা হলেও তাদের আমদানি করা প্রতি কেজি রসুনের মূল্য পড়েছে ৭২ টাকা ২৮ পয়সা। অথচ বাজারে রসুন বিক্রি হচ্ছে ১২০ টাকায়। শীর্ষ আমদানিকারকদের মধ্যে সর্বোচ্চ ১৭ কোটি টাকা মূল্যের আড়াই হাজার টন রসুন এনেছে মনজু এন্টারপ্রাইজ। প্রতি কেজি রসুনে তার আমদানি খরচ পড়েছে ৬৮ টাকা। অন্যদের মধ্যে ইমতিয়াজ এন্টারপ্রাইজ সাড়ে সাত কোটি টাকায় এক হাজার ৮৫ টন, ফাহাদ ট্রেডিং ৫ কোটি ২৩ লাখ টাকায় ৭৫৪ টন, ভাই ভাই ইন্টারন্যাশনাল সাড়ে চার কোটি টাকায় ৬৬৭ টন, ওয়াশিফ ট্রেডিং চার কোটি টাকায় ৬০৯ টন, নিউ ফাতেমা এন্টারপ্রাইজ ও এনএন এন্টারপ্রাইজ চার কোটি টাকায় ৫৮০ টন রসুন আমদানি করেছে। এদের প্রতি কেজি রসুন কিনতে আমদানি খরচ হয়েছে ৬৬ টাকা ৫০ পয়সা থেকে ৬৮ টাকা ৫০ পয়সা।

দ্বিগুণ দামে ভোজ্যতেল ও দেড়গুণ দামে চিনি :চলতি বছরের প্রথম চার মাসে এক হাজার ৯৮৫ কোটি টাকায় ২ লাখ ৯৬ হাজার টন ক্রুড অয়েল (অশোধিত তেল) আমদানি হয়েছে। এ হিসেবে প্রতি কেজি ক্রুড অয়েলের আমদানি খরচ পড়েছে ৬৭ টাকা। শুল্ক্ক, ব্যাংক ঋণ ও পরিবহন খরচ ১৩ টাকা যুক্ত করলে প্রতিকেজির দাম পড়ে ৮০ টাকা। তবে বাজারে ভোজ্যতেল বিক্রি হচ্ছে ১০০ থেকে ১০৮ টাকায়।

একইভাবে বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে চিনি। ২৯ টাকার চিনি বিক্রি হচ্ছে ৬২ টাকায়। গত চার মাসে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে পাঁচটি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান ২৬৪ কোটি ৬৪ লাখ টাকায় ৯৬ হাজার ৫০০ টন চিনির কাঁচামাল আমদানি করে। এ হিসেবে প্রতিকেজি চিনির কাঁচামালে আমদানি মূল্য পড়েছে ২৯ টাকা ৪৩ পয়সা। শুল্ক্ক, ব্যাংক ঋণ, পরিশোধন ও পরিবহন খরচ ১০ টাকা যুক্ত করলে প্রতিকেজির দাম পড়ে সর্বোচ্চ ৪০ টাকা। কিন্তু বাজারে চিনি বিক্রি হচ্ছে ৬২ থেকে ৬৫ টাকায়।

আরও পড়ুন

×