স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর উদযাপন দেশজুড়ে নানা মাত্রায় ছড়িয়ে পড়েছে। রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানের পাশাপাশি সামাজিক-সাংস্কৃতিক আয়োজনও থেমে নেই। যদিও কভিড-১৯ পরিস্থিতিতে খানিকটা সীমিত পরিসরে হচ্ছে, তার পরও স্বাধীন বাংলাদেশের অর্ধশতক পূরণের ফল্কগ্দুধারা বয়ে চলছে নাগরিকদের হৃদয়ে হৃদয়ে। এই মাহেন্দ্রক্ষণে দাঁড়িয়ে পেছনের দিকে তাকানোর পাশাপাশি সামনের দিকে তাকানোরও তাগিদ দিতে চাই আমরা। পঞ্চাশে আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে- এটা যেমন পর্যালোচনা করতে চাই, তেমনি শতবর্ষের বাংলাদেশকে আমরা কোথায় দেখতে চাই, সেটাও ভাবতে চাই এখনই। হাঁটতে চাই সেই স্বপ্ন পূরণের পথে।

স্বীকার করতে হবে, যে অঙ্গীকার সামনে রেখে বাংলাদেশ নামের নতুন রাষ্ট্র যাত্রা শুরু করেছিল- সেগুলোর দিকে ফিরে তাকাতে আমরা অনেক বেশি সময় নিয়ে ফেলেছি। একাত্তরের ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা ঘোষণার মধ্য দিয়ে যেসব লক্ষ্য সামনে রেখে দেশমাতৃকার মুক্তিসংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বাঙালি, তার কতগুলো পূরণ হয়েছে স্বাধীন স্বদেশে, সেই প্রশ্ন আরও আগেই ওঠা উচিত ছিল।

গোটা জীবন ব্যয় করে, জেল ও জুলুম তুচ্ছ করে বঙ্গবন্ধু যে স্বপ্নের 'সোনার বাংলা' গড়তে চেয়েছিলেন, তা কতটা সম্ভব হয়েছে? স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে দাঁড়িয়ে এই প্রশ্ন আজ নিজেকেই আমরা করতে চাই। এ ক্ষেত্রে নিজে থেকে কতটুকু অবদান রাখতে পেরেছি, নিজের দায়িত্ব কতটুকু পালন করতে পেরেছি, সেই আত্মসমালোচনাও করতে চাই।

স্বাধীনতারও আগে গত শতকের ষাটের দশকের সংগ্রামমুখর দিনগুলোকে আমরা অনেক সময়ই বাংলাদেশের জীবনে 'সোনালি অধ্যায়' হিসেবে চিহ্নিত করে থাকি। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের পথ ধরে বাঙালির স্বাধিকার সংগ্রামের যে সূচনা হয়েছিল, ঐতিহাসিক ছয় দফার মধ্য দিয়ে ষাটের দশকে তা চূড়ান্ত রূপ গ্রহণ করেছিল। কিন্তু ওই সোনালি সময়কে কেবল ভাষার মর্যাদা বা অর্থনৈতিক সাম্যের কাঠামোতে দেখলে চলবে না। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে তখন যেমন নতুনতর রেনেসাঁ এসেছিল, তেমনই রাজনীতিতেও লেগেছিল প্রগতিশীলতার ঢেউ। হাজার বছর ধরে অর্গলবদ্ধ বাঙালি জাতীয়তাবাদ বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল পূর্ব বাংলাকে। এক নতুন যুগের স্বপ্ন গোটা জাতির মধ্যে সঞ্চারিত করে দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। সবাই স্বপ্ন দেখেছিল- আসন্ন রাষ্ট্র হবে গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, আর্থসামাজিক বৈষম্যহীন। নতুন রাষ্ট্র জনমিতির দিক থেকে বাঙালি জাতীয়তাবাদের পীঠস্থান হলেও সেখানে অন্য সব জাতিসত্তার সমান সাংস্কৃতিক অধিকার ও ঐতিহ্যগত মর্যাদা নিশ্চিত হবে। সামষ্টিক সেই স্বপ্ন সবাই ব্যক্তিগতভাবে বুকে ধারণ করত বলেই বঙ্গবন্ধুর তর্জনীর নির্দেশে জীবন ও সম্পদ তুচ্ছ করে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মুক্তিযুদ্ধে।

মাত্র ৯ মাসে ৩০ লাখ তাজা প্রাণ ও দুই লাখ মা-বোনের সল্ফ্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে দাঁড়িয়েও বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকারের কথা ভোলেননি। যে কারণে রাষ্ট্রীয় আদর্শ হিসেবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ আমাদের প্রথম সংবিধানেই সন্নিবেশিত হয়েছিল। বস্তুত বঙ্গবন্ধুর মাত্র সাড়ে তিন বছরের শাসনামলে একটি আদর্শ ও উন্নত রাষ্ট্রের ভিত্তি গঠিত হয়েছিল। ওই সামান্য সময়ে দেশের প্রকৃতি থেকে প্রতিরক্ষা- সব বিষয়ে বঙ্গবন্ধু যেসব সুদূরপ্রসারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন, তার তুলনা তৎকালীন উন্নত বিশ্বেও ছিল না। যেমন জাতিসংঘে যখন সমুদ্রসীমাবিষয়ক সংস্থাই গঠিত হয়নি, বঙ্গবন্ধু তখন প্রতিবেশী ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারণে উদ্যোগী হয়েছিলেন। শুধু এটা নয়, এমন আরও অনেক উদাহরণ দেওয়া যাবে।

দুর্ভাগ্য আমাদের, পঁচাত্তরের মর্মন্তুদ পটপরিবর্তনের কারণে বাঙালি জাতির মুক্তির স্বপ্ন মুহূর্তেই ধূলিসাৎ হয়ে যায়। নতুন রাষ্ট্র যাত্রা শুরু করে পেছনের দিকে, অন্ধকার পঙ্কিল পথে। ষাটের দশকের সোনালি সংগ্রামের পথ ধরে, একাত্তরের অতুলনীয় আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক ও উন্নয়নমুখী যে বাংলাদেশ যাত্রা শুরু করেছিল, সেই দেশটিই যেন মুহূর্তে পাকিস্তানের অনুকরণে 'বাংলাস্তান' হয়ে ওঠার সব আয়োজন সম্পন্ন করে। স্বাধীনতার লাল সূর্য ছিনিয়ে আনা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধারা রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের শিকার হতে থাকেন একে একে। অন্যদিকে, একাত্তরের যেসব শকুন জাতীয় পতাকা খামচে ধরেছিল, তারা রাষ্ট্রের কেন্দ্রস্থলে স্থান পায়। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন দেশে তারা বুক ফুলিয়ে চলতে শুরু করে। এমনকি ঘটনার ধারাবাহিকতায় তাদের গাড়িতে ওড়ে লাখো শহীদের রক্তভেজা লাল-সবুজ পতাকাও।

পঁচাত্তরের পর গণতন্ত্র, মানবিক মর্যাদা, অর্থনৈতিক সাম্য, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জন্য আমাদের যৌথ স্বপ্ন ছিঁড়ে গিয়েছিল মুষ্টিমেয় ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর অবিমৃষ্যকারিতায়। আশার কথা, বঙ্গবন্ধুকন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে মুক্তিযুদ্ধের পথে। টানা তিন মেয়াদে প্রতিষ্ঠা হয়েছে গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা ও অর্থনৈতিক সক্ষমতা। একদা 'তলাবিহীন ঝুড়ি' বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের রোলমডেল। পঁচাত্তরের পর বিচারহীনতার যে নিকষ আঁধার আমাদের ঘিরে ধরেছিল, যুদ্ধাপরাধের বিচার ও বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের মধ্য দিয়ে তা দূর করা গেছে। তবে সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার পথে এখনও আমাদের হাঁটতে হবে অনেক দূর পথ। মনে রাখতে হবে, এখনও আমরা গঠন করতে পারিনি অসাম্প্রদায়িক মুক্ত সমাজ। এখনও আমাদের রাজনীতি ও সমাজকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে চিন্তার পশ্চাৎপদতা।

অস্বীকারের কোনোই অবকাশ নেই যে ধর্ম, বর্ণ, সম্প্রদায় নির্বিশেষে সবার রক্তভেজা এই দেশ থেকে সাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গিবাদ দূর করা যায়নি। স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রের পাশাপাশি বৈষম্যহীনতার যে স্বপ্ন আমরা দেখেছিলাম; ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও অর্থনৈতিক মুক্তির যে ডাক দিয়েছিলেন, তাও এখনও নিশ্চিত করা যায়নি। বিশেষভাবে বলতে হবে, আর্থসামাজিক উন্নয়ন হলেও রাজনৈতিক অগ্রগতি এখনও অধরা। আমরা জানি, রাজনীতি হচ্ছে সকল নীতির রাজা। রাজনীতি যদি না বদলায়, তাহলে সমাজ বদলানো কঠিন। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে দাঁড়িয়ে আমাদের রাজনীতিকে বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির পথে নিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় আজ দল-মত নির্বিশেষে প্রয়োজন।

আমরা যখন স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করছি, তখনই সুনামগঞ্জের নোয়াগাঁওয়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর বর্বরোচিত হামলা হয়েছে। প্রিয় লেখক হুমায়ুন আজাদের ভাষায় বলতে হয়- আমরা কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম? কয়েক দিন আগে সমকালেই লিখেছিলাম, 'কখনও কখনও মনে হয়, সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প যেন আগের চেয়েও ধূমায়িত হয়ে উঠছে। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক সুবিধার জন্য সাংস্কৃতিক মুক্তির প্রশ্নটিও যেন ক্রমেই ধূসর হয়ে যাচ্ছে। সাংস্কৃতিক মুক্তির দিগন্তে সবচেয়ে বড় বাধা যে সাম্প্রদায়িকতার পর্বত, সে কথা ভুলে যাওয়া চলবে না।' (বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ; ১৭ মার্চ, ২০২১)

আমরা যে বাংলাদেশ চেয়েছিলাম, তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। আমি মনে করি, বিলম্বে হলেও এখনই সক্রিয় হওয়ার সময়। আর সব বাধা পেরিয়ে শতবর্ষের লক্ষ্য অর্জন করতে হলে এখনই প্রস্তুত হতে হবে। বাঁকবদলের এখনই সময়।

শতবর্ষের বাংলাদেশ যেন হয় অর্থনৈতিক গতিময়তা, গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা, রাজনৈতিক দায়িত্বশীলতা, প্রশাসনিক দক্ষতা, প্রতিরক্ষা সক্ষমতার বাংলাদেশ। এসব গুণগত উন্নয়নের শপথ আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতেই নিতে পারি। যে প্রত্যাশা নিয়ে একদিন কৃষকের সন্তান হাতে অস্ত্র ধারণ করেছিলেন; কারখানার হাতুড়ি ছেড়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বাঙ্কারে অমিত বিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন শ্রমিক; ছাত্রছাত্রীরা ছেড়েছিলেন ক্যাম্পাস; নারীসমাজ সামলেছিল ঘর ও বাইরের চ্যালেঞ্জ; বুদ্ধিজীবীরা অসির বিরুদ্ধে মসিকেই সংগ্রামের হাতিয়ার বানিয়েছিলেন- স্বাধীনতার সেই স্বপ্ন পূরণ করার চ্যালেঞ্জ আমাদের গ্রহণ করতেই হবে।

বাংলাদেশের শতবর্ষে আমরা অনেকে নিশ্চিতভাবেই থাকব না। কিন্তু ভবিষ্যৎ প্রজন্ম একটি উন্নত, পরিণত রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার সুফল পেতে থাকবে।

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, দৈনিক সমকাল