আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেই শৈশব থেকেই উজানপথের যাত্রী; আজীবন বৈরী স্রোত ঠেলে এগিয়েছেন। তিনি যে আক্ষরিক অর্থেই বাইগার বা মধুমতীর মতো গোপালগঞ্জ অঞ্চলের বিভিন্ন নদীর উজান সাঁতরে বেড়ে উঠেছেন, এর সাক্ষ্য দেন তার জ্যেষ্ঠ কন্যা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। 'শেখ মুজিব আমার পিতা' গ্রন্থে তিনি লিখেছেন- 'আমার আব্বার শৈশব কেটেছিল টুঙ্গিপাড়ার নদীর পানিতে ঝাঁপ দিয়ে, মেঠোপথের ধুলোবালি মেখে। বর্ষার কাদাপানিতে ভিজে।' বঙ্গবন্ধু নিজেও 'আমার দেখা নয়াচীন' গ্রন্থে লিখেছেন- 'আমরা পূর্ব বাংলার লোক, নদীর পাড়ে যাদের ঘর, নদীর সাথে যাদের বন্ধুত্ব, ঢেউয়ের সাথে যাদের কোলাকুলি।'

খানিকটা প্রতীকী, কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ; শৈশব-কৈশোরে প্রকৃতির সঙ্গে মিশে উজান বাওয়ার এই অভিজ্ঞতা পরবর্তী জীবনে রাজনৈতিক ও আর্থসামাজিক ক্ষেত্রেও যেন কাজে লেগেছিল। আমরা দেখি, বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবন কখনোই সহজ ছিল না। এর কারণ, সব সময়ই তিনি অন্যায় ও অচলায়তনের বিপক্ষে লড়েছেন। যেমন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগে, তেমন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা পর্যন্ত। আবার স্বাধীন বাংলাদেশেও বঙ্গবন্ধুকে নানামুখী ষড়যন্ত্র সামাল দিতে হয়েছে। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে দেশীয় নানা অপশক্তির সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারীরা।

দুই.

সেই ১৯৩৮ সালে গোপালগঞ্জের মথুরানাথ ইনস্টিটিউট মিশন স্কুলে পড়ার সময় শেখ মুজিবকে প্রথম জেলে যেতে হয়েছিল একটি সাম্প্রদায়িক অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে। অখণ্ড বাংলার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক এবং শ্রমমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী গোপালগঞ্জ সফর সফল করতে গিয়েও সম্ভবত বুঝেছিলেন যে, রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র কতটা বিবেচনাহীন হতে পারে।

হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর হাত ধরেই মুসলিম লীগ রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধুর পদার্পণ। অল্প দিনেই তিনি নিজের নেতৃত্বগুণ প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন। কিন্তু দেখলেন, সেখানেও কোটারি স্বার্থ ও ষড়যন্ত্র। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন- 'মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠান পূর্বে ছিল খান সাহেব, খান বাহাদুর ও ব্রিটিশ খেতাবধারীদের হাতে আর এদের সাথে ছিল জমিদার, জোতদার শ্রেণির লোকেরা। এদের দ্বারা কোনোদিন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা হতো না। শহীদ সাহেব ও হাশিম সাহেব যদি বাংলার যুবক ও ছাত্রদের মধ্যে মুসলিম লীগকে জনপ্রিয় করতে না পারতেন এবং বুদ্ধিজীবী শ্রেণিকে টেনে না আনতে পারতেন, তাহলে কোনোদিনও পাকিস্তান আন্দোলন বাংলার কৃষকদের মধ্যে জনপ্রিয়তা লাভ করতে পারত না।'

তিন.

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু যদিও মনপ্রাণ ঢেলে কাজ করেছেন, দেশ বিভাগের সময় ঘনিয়ে আসার সময় ক্রমেই বুঝতে পারছিলেন যে, তৎকালীন পূর্ব বাংলায় আরেকটি উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা হতে যাচ্ছে। পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণ করতে যাচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। বিশেষত কলকাতাসহ অন্যান্য অঞ্চলের ওপর পূর্ব বাংলার দাবি নিছক কোটারি স্বার্থের কারণে ছেড়ে দেওয়া বঙ্গবন্ধুর পছন্দ হয়নি। আর নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা হওয়ার পরপরই মুসলিম লীগের প্রগতিশীল অংশের বিরুদ্ধে যে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছিল, বঙ্গবন্ধু সেটাও লিখে গেছেন- 'পাকিস্তান হওয়ার সাথে সাথেই ষড়যন্ত্রের রাজনীতি শুরু হয়েছিল। বিশেষ করে জনাব সোহরাওয়ার্দীর বিরুদ্ধে দিল্লিতে এক ষড়যন্ত্র শুরু হয়। কারণ, বাংলাদেশ ভাগ হলেও যতটুকু আমরা পাই তাতেই সিন্ধু, পাঞ্জাব, সীমান্ত প্রদেশ ও বেলুচিস্তানের মিলিতভাবে লোকসংখ্যার চেয়ে পূর্ব পাকিস্তানের লোকসংখ্যা বেশি। সোহরাওয়ার্দীর ব্যক্তিত্ব, অসাধারণ রাজনৈতিক জ্ঞান, বিচক্ষণতা ও কর্মক্ষমতা অনেককেই বিচলিত করে তুলেছিল।'

পরবর্তী ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় আমরা দেখি, বঙ্গবন্ধু ক্রমেই বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা হয়ে উঠছেন। সেইসঙ্গে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ও তাদের এদেশীয় দোসরদের ষড়যন্ত্রের প্রধান লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হচ্ছেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক শক্তি ও গতির সঙ্গে পাল্লা দিতে না পেরে, নানা ষড়যন্ত্রমূলক ও অন্যায় অভিযোগে তাকে কারান্তরীণ করা হচ্ছে। সদ্য প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানে তাকে প্রথম কারাগারে যেতে হয়েছিল ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ। বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ধর্মঘট পালনকাল সচিবালয়ের এক নম্বর গেটের সামনে বিক্ষোভরত অবস্থায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।

পরবর্তী ইতিহাস আমরা সবাই জানি। একের পর এক মামলা দিয়ে তাকে কারাগারে রাখা হতে থাকে। বঙ্গবন্ধুর মাত্র ৫৪ বছরের জীবনের মধ্যে ১২ বছরের বেশি সময়, তার মানে এক-চতুর্থাংশ জীবন কেটেছে কারান্তরালে। বাঙালির মুক্তির প্রাণভোমরাকে যেন শাসকগোষ্ঠী ও ষড়যন্ত্রকারীরা লোকচক্ষুর অন্তরালে রাখতেই স্বস্তিবোধ করত। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে কীভাবে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন ন্যায্য আন্দোলন দমন করতে গিয়ে একের পর এক ষড়যন্ত্রের জাল বোনা হয়েছে, বঙ্গবন্ধু নিজেই সেটা বলেছেন। 'আমাদের বাঁচার দাবী ৬-দফা কর্মসূচী' শীর্ষক পুস্তিকার শুরুতেই তিনি বলেন- 'অতীতে পূর্ব পাকিস্তানবাসীর নিতান্ত সহজ ও ন্যায্য দাবী যখনই উঠিয়াছে, তখনই এই দালালরা এমনিভাবে হৈহৈ করিয়া উঠিয়াছেন। আমাদের মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবী, পূর্ব-পাক জনগণের মুক্তি-সনদ একুশ দফা দাবী, যুক্ত-নির্বাচন-প্রথার দাবী, ছাত্র-তরুণদের সহজ ও স্বল্প-ব্যয় শিক্ষালাভের দাবী, বাংলাকে শিক্ষার মাধ্যম করার দাবী ইত্যাদি সকল প্রকার দাবীর মধ্যেই এই শোষকের দল ও তাহাদের দালালরা ইসলাম ও পাকিস্তান ধ্বংসের ষড়যন্ত্র আবিস্কার করিয়াছেন।'

এরপর আসে আরও ভয়াবহ ষড়যন্ত্রমূলক 'আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা'। ওই মামলায় তাকে ফাঁসিতে ঝোলানোর জাল পেতেছিল শাসকগোষ্ঠী। কিন্তু বাংলার দামাল ছাত্র-জনতা, শ্রমিক-কৃষক বুকের তাজা রক্ত দিয়ে তাদের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবকে মুক্ত করে এনে 'বঙ্গবন্ধু' উপাধিতে ভূষিত করেছিল। তার মুক্তির প্রশ্নে পূর্ব পাকিস্তানে যে গণঅভ্যুত্থান ঘটে, তার ঢেউ পশ্চিম পাকিস্তানে গিয়েও লাগে। পতন ঘটে কথিত 'লৌহমানব' আইয়ুব খানের একনায়কতন্ত্রের।

চার.

বঙ্গবন্ধু এক যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। তিনি অত্যন্ত বৈরী পরিবেশে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে পুনর্বাসন ও বিনির্মাণে উদ্যোগী হয়েছিলেন। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে অবকাঠামো ছিল খুবই নাজুক। বেশিরভাগ সড়ক, বন্দর, সেতু বিধ্বস্ত। শিল্পকারখানাও প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত। উপর্যুপরি বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফসল উৎপাদন করা যায়নি। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম, খাদ্যের দাম হু হু করে বাড়ছিল। বিশ্বজুড়েই দেখা দিয়েছিল মুদ্রাস্ম্ফীতি ও মূল্যস্ম্ফীতি। বিশ্বমোড়ল অনেকের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ায় বৈদেশিক সহায়তা ও বাণিজ্যও সহজ ছিল না।

এর মধ্যেও বঙ্গবন্ধুকে দ্বিমুখী ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করতে হয়েছে। প্রথম পক্ষ ছিল দেশের অভ্যন্তরীণ কায়েমি স্বার্থবাদী মহল। কারণ, বঙ্গবন্ধু একটি কল্যাণ রাষ্ট্রের গোড়াপত্তনের জন্য মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার অনুযায়ী এক সাম্য ও ন্যায়বিচারভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। আমরা দেখি, বঙ্গবন্ধু যে রাষ্ট্রচিন্তা করতেন, তার মূলে ছিল সাধারণ মানুষ ও তাদের কল্যাণ। শুধু চিন্তা করেই ক্ষান্ত হননি। তার রাষ্ট্রচিন্তার প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই বাহাত্তরের সংবিধানে, বৈষম্যহীন সমাজ গড়ার কথা সংবিধানের মূলনীতিতে যুক্ত রয়েছে। এর ১৪ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- 'রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হইবে মেহনতি মানুষকে-কৃষক ও শ্রমিককে-এবং জনগণের অনগ্রসর অংশসমূহকে সকল প্রকার শোষণ হইতে মুক্তি দান করা।'

এমন রাষ্ট্রীয় নীতি তাদেরই ক্ষুব্ধ করেছিল, যারা যুগে যুগে সাধারণ মানুষের ওপর অর্থনৈতিক শোষণ করে এসেছে। বঙ্গবন্ধুর বিশাল ব্যক্তিত্বের সামনে তারা কোনো বিরুদ্ধাচরণ করতে পারেনি। কিন্তু তলে তলে ঠিকই বঙ্গবন্ধু সরকারকে নাজুক করে তুলতে নানা ষড়যন্ত্র করে গেছে। এর পাশাপাশি ছিল, অতি বাম ও অতি ডানপন্থি রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠীগুলোর অপতৎপরতা। সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্রের পথচলায় যেখানে সব পক্ষের সর্বাত্মক সহযোগিতা কাম্য ছিল, সেখানে সম্ভাব্য সব রকম বিরোধিতা শুরু হয়। বঙ্গবন্ধু উদারতা দেখিয়ে পাকিস্তান প্রত্যাগত সামরিক কর্মকর্তাদের স্বাধীন দেশের সেনাবাহিনীতে আত্তীকরণ করেছিলেন; কিন্তু তাদের বেশিরভাগই এর প্রতিদান দিয়েছে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে।

পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট কতিপয় বিপথগামী সেনাসদস্যের নিষ্ঠুর বুলেটে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের প্রায় সবাইকে কেড়ে নেওয়ার পর সব ষড়যন্ত্রকারীর মুখ ক্রমেই উন্মোচিত হতে দেখেছি আমরা। বস্তুত, যারা স্বাধীন বাংলাদেশকে মনেপ্রাণে মেনে নিতে পারেনি, তারাই বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। বলা বাহুল্য এই ষড়যন্ত্র দেশীয় পরিমণ্ডল পেরিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও বিস্তৃত।

বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ জামাতা এবং বিশিষ্ট পরমাণুবিজ্ঞানী এম এ ওয়াজেদ মিয়া তার 'বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ' গ্রন্থে লিখেছেন- 'স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ, লক্ষ্য, মূল্যবোধ ও চিন্তা-চেতনাকে বিনষ্ট করাই ছিল এইসব হত্যাকাণ্ড ঘটানোর প্রধান উদ্দেশ্য। বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অফিসার ও অন্যান্য সদস্য কোনোভাবেই এই সমস্ত হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে জড়িত ছিল না। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শবিরোধী এবং পাকিস্তানপন্থী অতি মুষ্টিমেয় ও নগণ্য সংখ্যক অফিসার ও সাধারণ সৈনিক কতিপয় দেশী ও বিদেশী মহলের এজেন্ট হিসেবে এ সমস্ত হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। বঙ্গবন্ধুর নিজের নিরাপত্তার ব্যাপারে উদাসীনতা তাদের ষড়যন্ত্রের কার্যকরণকে সহজতর করেছিল।'

দেশীয় ষড়যন্ত্রকারীদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারীদের অপচেষ্টা কীভাবে মিলে গিয়েছিল, সেটা লিখেছেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর নূরুল ইসলাম। 'বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান :কাছ থেকে দেখা' গ্রন্থে তিনি লিখেছেন- 'জোরালো জাতীয়তাবাদী অবস্থানের কারণে '৭৫ সাল নাগাদ বঙ্গবন্ধু আসলে কোনো বৃহৎ শক্তির কাছেই আর বিশেষ ঘনিষ্ঠ বা আপন দলের ব্যক্তি হিসেবে বিবেচিত হননি। কোনো শক্তিমান দেশের আন্তর্জাতিক বা আঞ্চলিক স্বার্থরক্ষা করার জন্য তিনি তাদের কারও সঙ্গে সম্পর্ক করতে উৎসাহী ছিলেন না। তাঁর দৃষ্টিতে যে কোনো দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে মূল বিবেচনার বিষয়টি হচ্ছে, বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ।'

পাঁচ.

পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পরও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ষড়যন্ত্র থেমে ছিল না। তাকে ঘিরে নানা অপপ্রচার ও কুৎসা রটনায় ব্যস্ত ছিল বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশবিরোধী শক্তিগুলো। কেবল দেশে নয়, আন্তর্জাতিকভাবেও এসব রটনা পঁচাত্তর-পরবর্তী দিনগুলোতে কীভাবে চালানো হয়েছে, দুঃসময়ের মুখোমুখি হয়ে সেগুলো লিখে রেখেছেন এম এ ওয়াজেদ মিয়া- 'এই সময় মার্কিন, গণচীন, পাকিস্তানপন্থী শক্তিগুলো সর্বাত্মক অপপ্রচার তৎপরতায় লিপ্ত হয়।'

আরও বেদনা ও ক্ষোভের বিষয়, যে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য বঙ্গবন্ধু জীবনের সোনালি সময় কারাগারে কাটিয়েছেন, যে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য দিন-রাত খেটেছেন; সেই রাষ্ট্রে অধ্যাদেশ জারি করা হয় যে, তার ও পরিবারের সদস্যদের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিচার হবে না। ৩০ লাখ শহীদের রক্তভেজা পবিত্র সংসদে এমন বর্বরোচিত আইন পাস করা হয়। আশির দশকেও আমরা দেখেছি, বঙ্গবন্ধু ছিলেন যেন নিষিদ্ধ নাম। রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানাদি ও প্রচারমাধ্যমে তার প্রসঙ্গ ছিল ব্রাত্য। এমনকি স্বাধীনতা দিবস ও বিজয় দিবসেও বঙ্গবন্ধুকে বাদ দিয়ে উদ্ভট অনুষ্ঠান করা হতো। শুধু তাই নয়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ভূলুণ্ঠিত করে শহীদের রক্তভেজা পতাকা তুলে দেওয়া হয়েছিল স্বাধীনতাবিরোধীদের গাড়িতে। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের আস্ম্ফালন ছিল যত্রতত্র।

স্বস্তির বিষয়, বিলম্বে হলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ ফিরে এসেছে মুক্তিযুদ্ধের ধারায়। যেমন স্বাধীনতাবিরোধীদের, তেমনই বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার সম্পন্ন হয়েছে। তবে এখনও তাদের কেউ কেউ মুক্ত রয়েছে, কৃতকর্মের জবাব পায়নি।

আমাদের জাতীয় দুর্ভাগ্য, বঙ্গবন্ধুকে অকালে হারাতে হয়েছে। তার প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্মই তাকে বারবার ফিরিয়ে আনছে আমাদের মাঝে। জীবনে যেমন, তেমনই মৃত্যুর পরও বৈরী স্রোত ঠেলে বঙ্গবন্ধু ফিরেছেন স্বমহিমায়।

এটাও অবশ্য মনে রাখতে হবে, এখনও ষড়যন্ত্র থেমে নেই। বঙ্গবন্ধুর মতোই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এখনও ষড়যন্ত্রকারীদের প্রধান নিশানা। জাতীয় শোক দিবসে আমাদের অঙ্গীকার হোক- সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে দেশকে মুক্তিযুদ্ধের ধারায় এবং বঙ্গবন্ধুর প্রদর্শিত পথে এগিয়ে নিয়ে যাব।