- জাতীয় শোক দিবস
- সমকালীন দর্পণে সমকালের আপন চেহারা
প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী
সমকালীন দর্পণে সমকালের আপন চেহারা

সমকাল ১৬ অতিক্রম করে ১৭ বছরে পা দিয়েছে। দেড় যুগের কাছাকাছি সময় সমকাল ইতোমধ্যে অতিক্রম করেছে তার নীতি-আদর্শ ধারণ করে। এর মধ্যে তাকে অনেক চড়াই-উতরাই পাড়ি দিতে হয়েছে, তবু সমকাল তার সংকল্পে অটল থেকে এগিয়ে চলেছে। তার এই এগিয়ে চলা অব্যাহত থাকুক এবং আরও দৃঢ়-দীপ্ত হোক। আমাদের বিদ্যমান সমস্যা-সংকটের মধ্যে সংবাদমাধ্যম গুরুদায়িত্ব পালন করে চলেছে- তা অস্বীকারের উপায় কী। একটা কথা মনে রাখা দরকার, যে কোনো প্রতিষ্ঠানের মূল শক্তি তার কর্মী বাহিনী। সমকালও এর ব্যতিক্রম নয়। সমকালের কর্মীরা নিষ্ঠার সঙ্গে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করেছেন বলেই সমকাল সগর্বে এতটা পথ পাড়ি দিয়ে আজকের এ অবস্থানে এসেছে।
সমকালের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে কয়েক পর্বে বিষয়ভিত্তিক বিশেষ সংখ্যা প্রকাশের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জেনেছি। নিশ্চয়ই নানা জনের নানা মতের প্রতিফলন ঘটবে তাতে। সমকালের প্রকাশক, ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, সাংবাদিকসহ সংশ্নিষ্ট সবাইকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাই। একই সঙ্গে এও কামনা করি, সমকালের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে তাদের সবারই নিরন্তর প্রয়াস থাকবে।
আমাদের দেশে সাংবাদিকদের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মহল দ্বারা নিগৃহীত হতে হয়েছে। এ নিয়ে আমরা প্রতিবাদ করেছি, ক্ষোভ প্রকাশ করেছি। সাংবাদিকদের অনেক প্রতিপক্ষ থাকে। এই পেশার পথটা বরাবরই অমসৃণ। মানুষের অধিকারের পক্ষে অঙ্গীকারবদ্ধ থাকাই শুধু নয়; আমরাও আমাদের দায়িত্ব স্বচ্ছতা-বস্তুনিষ্ঠতা-দায়বদ্ধতার সঙ্গে পালন করছি কিনা, নজর তো সেদিকেও গভীর করা জরুরি।
বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের সামগ্রিক চিত্র কী- এ প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয় কখনও কখনও। সন্দেহ নেই, প্রিন্ট মিডিয়া কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সামনে হয়তো আরও কঠিন সময় আসছে। প্রযুক্তির বিকাশে মানুষের হাতের মুঠোয় রয়েছে প্রায় সব সুযোগ-সুবিধা। হাতে হাতে মোবাইল ফোন। মানুষ তার জানার আগ্রহ কিংবা ক্ষুধা এর সাহায্যেই এখন মিটিয়ে চলেছে চলতি পথেও। তার পরও আমি মনে করি, প্রিন্ট মিডিয়ার যে সনাতনি ধারা ও আবেদন, তা থেকেই যাবে। তবে সংবাদপত্র-সংশ্নিষ্ট সবাইকে বিশেষ করে বিনিয়োগকারীদের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার প্রস্তুতি রাখার প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি আরও জোরালোভাবে সামনে এসেছে। প্রযুক্তির বিকাশের ধারা প্রিন্ট মিডিয়াকেও স্পর্শ করেছে এবং এর ফলে তা সমৃদ্ধই হয়েছে। ভবিষ্যতে তা যে আরও বিকশিত হবে, তাতে কোনো সংশয় নেই।
এ প্রশ্নও আসে- সংবাদমাধ্যমের বিকাশের জন্য সরকারের করণীয় কী? গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কিংবা সমাজব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ বেশকিছু অনুষঙ্গ আছে। স্বাধীন সংবাদমাধ্যমও এর অন্যতম অনুষঙ্গ। সব গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ যত বিকশিত হতে থাকবে, গণতন্ত্রের ঔজ্জ্বল্য ততই বাড়বে। তবে এ জন্য দায় তো শুধু সরকারের একার নয়; দায় আছে আমাদেরও। আমরা যদি আমাদের দায়ের ব্যাপারে সচেতন-সজাগ না থেকে অন্যের দায় নিয়েই শুধু কথা বলতে থাকি, তাহলে চলবে কী করে! এ কথাও মনে রাখতে হবে, আমার অধিকার যেন অন্যায়ভাবে অন্যের অস্তিত্বকে বিপর্যস্ত না করে- সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে আমাকেই। সে দায়িত্বটি অবশ্যই আমার- সংবাদমাধ্যম জগতে এই বোধের প্রকাশ ঘটাতে হবে।
সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষার ব্যাপারে সরকারসহ সংশ্নিষ্ট সব পক্ষকেও সমগুরুত্ব সহকারে মনোযোগ রাখতে হবে। সাংবাদিকদেরও সতর্ক থাকতে হবে যেন কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত দায় তাদের বইতে না হয়। তা না হলে দেখা যাবে ভুল জায়গা নিয়ে তারা তোলপাড় করছেন। আর এর ফলে তোলপাড়ের মূল ক্ষেত্রটিই নিখোঁজ। এক শ্রেণির রাজনীতিবিদ এই সুযোগটি নেন; সরকারের প্রশাসনের একাংশও নেয়। এর ফলে সাংবাদিকতার পেশাগত মর্যাদা ক্ষয় পেতে থাকে। আমরা যেমন বস্তুনিষ্ঠতার মধ্য দিয়ে খবরের আড়ালের খবর কিংবা ঘটনার আড়ালের ঘটনা তুলে আনব, তেমনি দর্পণে আপন চেহারাও দেখতে হবে।
কথা ওঠে মুক্ত মতপ্রকাশের বিষয়েও। হ্যাঁ, মুক্ত মতপ্রকাশ গণতান্ত্রিক অধিকার। মতপ্রকাশের অধিকার অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ; তা ব্যক্তির সংবিধান-স্বীকৃত গণতান্ত্রিক অধিকারও বটে। কিন্তু আগেই বলেছি, আমার অধিকার অন্যায়ভাবে কারও অস্তিত্ব বিপন্নের কারণ হতে পারে না। এমন ঘটনা আমাদের সমাজে কম ঘটেনি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কিংবা অন্য কোনো পন্থায় গুজব রটিয়ে, মিথ্যা ছড়িয়ে এমন কিছু ঘটেছে, যা সামাজিক অস্থিতিশীলতা তো বটেই, জীবননাশের কারণ হয়েও দাঁড়িয়েছে। কাজেই মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পথ উন্মুক্ত থাকুক, কিন্তু কোনোভাবেই যেন তা স্বেচ্ছাচারিতায় রূপ না নেয়, এ ব্যাপারে দায়িত্বশীলদের সজাগ থাকতে হবে। জনসচেতনতাও এ ক্ষেত্রে অন্যতম বিষয়। এ ক্ষেত্রেও সংবাদমাধ্যমের রয়েছে গুরুদায়িত্ব এবং আমরা দেখেছি এ রকম পরিস্থিতিতে আমাদের মূলধারার সংবাদপত্র কিংবা অন্য প্রচারমাধ্যম বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে আসছে। সাংবাদিকতার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা। এই অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা এখন হারিয়ে যাওয়ার পথে। শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বের আরও অনেক দেশেই এমনটি লক্ষণীয়। কিন্তু দেশ-জাতি-সমাজের বৃহৎ স্বার্থে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা অত্যন্ত অপরিহার্য।
একটা কথা আমাদের সবারই মনে রাখা উচিত- সাংবাদিকতা একটা মহৎ পেশা। এটাই একমাত্র পেশা, যা মানুষের চিন্তা-চেতনা, নৈতিকতা-মূল্যবোধ, রুচি ও তার মনোজগৎ, মেধা- সবকিছুকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে। এটাই একমাত্র পেশা, যার লক্ষ্য হচ্ছে মানুষ। অবশ্য সব পেশার মধ্যেই মানুষের প্রয়োজন, যা চাহিদার একটা সংশ্নিষ্টতা থাকে। কিন্তু তার ভেতরে গোটা মানুষের উপস্থিতি নেই। সেখানে সবই আছে তবে খণ্ড খণ্ডভাবে। কিন্তু সাংবাদিকতা পেশার মূল কেন্দ্রটি হচ্ছে মানুষ এবং অখণ্ড মানুষ। তার ভালো-মন্দ, আনন্দ-বেদনা, ভালো লাগা, মন্দ লাগা, মেধা, রুচি- সবকিছুই চলে আসে সাংবাদিকতার পরিধির মধ্যে। এই পেশাটি যদি কোনো ক্ষুদ্রতা, সংকীর্ণতা কিংবা হীন স্বার্থ-বুদ্ধি দ্বারা বিদীর্ণ হয়, তাহলে এর সঙ্গে সংশ্নিষ্ট সবাই ছোট হয়ে যাবে। যে দেশে সাংবাদিকতার মান নেমে যায়, সে দেশের মানুষের নৈতিকতার মানটিও নেমে যায়। সাংবাদিকতার এই প্রতিষ্ঠানে অবিনশ্বর কেউ নয়। আমরা কীভাবে এ প্রতিষ্ঠানটি ব্যবহার করব, তার ওপরই নির্ভর করবে সমাজের সবাই কোন চোখে দেখছে একে। শুভকামনা সমকালের জন্য।
সম্পাদক, দৈনিক জাগরণ
মন্তব্য করুন