'বড় দুর্ভাগা এই দেশ জাতি পেয়েও অকূলে হারায়/বোঝেনি তারা কে এসেছিল সেদিন টুঙ্গিপাড়ায়।' বাংলাদেশের নিভৃত এক গ্রাম টুঙ্গিপাড়ায় ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ জন্মেছিলেন তিনি। বাংলার আকাশ, নদী, প্রকৃতি ও মানুষ মিলেমিশে একাকার হৃদয়ে তাঁর। স্বাপ্টিম্নক তিনি, দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর স্বপ্টেম্ন বিভোর। অন্যায়ের প্রতিবাদ ও প্রতিরোধে ছিলেন সোচ্চার, মধুমতীর স্রোতধারায় স্নাত মাটি ও মানুষের ভালোবাসায় ঋদ্ধ এক পুরুষ- শেখ মুজিবুর রহমান।

শেখ মুজিবের জন্মের কিছু আগেই পৃথিবীতে ঘটে গেছে রুশ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব। পৃথিবীর রাজনীতি দ্বিধাবিভক্ত হয়েছে শোষিত আর শোষকের পক্ষে। ব্রিটিশশাসিত ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনীতিতেও সক্রিয় হয়েছে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের নানা ধারা। অবিভক্ত ভারতে শোষণ, বঞ্চনা ও নিপীড়ন থেকে দেশের মানুষের মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় তরুণ শেখ মুজিব যুক্ত হয়েছিলেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে। রাজনৈতিক জীবনে তিনি উজ্জীবিত হয়েছিলেন রুশ বিপ্লবের মূলমন্ত্রে, বরাবর শোষিতের পক্ষে ছিল তাঁর অবস্থান। তিনি অন্তরে গভীরভাবে ধারণ করেছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদকে। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর স্বদেশি আন্দোলনও তাঁকে উদ্দীপ্ত করেছিল প্রবলভাবে। ভারতের প্রথম স্বাধীনতা-সংগ্রাম (সিপাহি বিদ্রোহ বলে প্রচারিত), কৃষক বিদ্রোহ, সাঁওতাল বিদ্রোহ, গারো-হাজং বিদ্রোহ, নীল বিদ্রোহসহ ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সংঘটিত সব আন্দোলন-সংগ্রাম তাঁকে অনুপ্রাণিত করেছে স্বদেশের মুক্তির ভাবনায়।

ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে সৃষ্ট পাকিস্তানে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে বাঙালির মহান ভাষা আন্দোলনের ভেতর দিয়ে উন্মেষ ঘটে বাঙালি জাতীয়তাবাদের। স্বৈরশাসকদের বৈষম্য, শোষণ, নিপীড়নের বিরুদ্ধে বাঙালির দীর্ঘ ২৩ বছরের স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে শেখ মুজিব হয়ে উঠেছিলেন বাঙালির আশা-আকাঙ্ক্ষার মূর্ত প্রতীক। তাঁর আহ্বানে একাত্তরে বাংলার মুক্তিকামী মানুষ অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করে পাকিস্তানি হানাদারদের কাছ থেকে ছিনিয়ে এনেছে লাল-সবুজের পতাকা; মুক্ত-স্বাধীন বাংলাদেশ। তাই তো বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ অবিচ্ছেদ্য, জন্মের বন্ধনে বাঁধা।
বঙ্গবন্ধু স্বপ্টম্ন দেখেছিলেন স্বাধীন-সার্বভৌম সোনার বাংলার। পাকিস্তানের কারাগার থেকে স্বাধীন স্বদেশে ফেরার পর তিনি মনোযোগী হলেন রাষ্ট্র গঠন ও যুদ্ধবিধ্বস্ত অবকাঠামো উন্নয়নে। অসংখ্য প্রতিকূলতা ও সীমাবদ্ধতার মধ্যেও অবিলম্বে স্বপ্টেম্নর সোনার বাংলা বিনির্মাণের ভিত্তি কাজগুলোর সূচনা করেন তিনি। জনমুখী প্রশাসনিক বিন্যাস, 'সবার প্রতি বন্ধুত্ব, কারও প্রতি বৈরিতা নয়'- এই পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণ, রাষ্ট্র পরিচালনার অত্যাবশ্যক আইন প্রণয়ন, তাঁর নির্দেশনা ও তত্ত্বাবধানে প্রত্যেক নাগরিকের আইনের দৃষ্টিতে সমতা, আইনের আশ্রয়লাভ, ব্যক্তিস্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতাসহ অন্যান্য মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করে ১৯৭২ সালে প্রণীত ও গৃহীত হয় বাংলাদেশের অনন্য সংবিধান। এই সময়ে স্বদেশে তাঁকে মুখোমুখি হতে হয় ধ্বংসপ্রাপ্ত অর্থনীতির পুনরুজ্জীবনসহ ক্ষতিগ্রস্ত ভৌত অবকাঠামোর সংস্কার ও পুনর্নির্মাণ, উৎপাদন ও বিতরণ ব্যবস্থা সচলকরণ, নির্যাতিত মা-বোনদের পুনর্বাসন, পাকিস্তানে আটকে পড়া বাঙালিদের দেশে ফিরিয়ে আনা, যুদ্ধোত্তর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ, কলকারখানা ও প্রাথমিক শিক্ষা জাতীয়করণসহ নানা চ্যালেঞ্জের। সে সময় তিনি ঐকান্তিকভাবে সচেষ্ট ছিলেন সংবিধানের চার মূলনীতি- জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা অনুসরণে ভবিষ্যতের সোনার বাংলার পথ বিনির্মাণের ভিত্তি কাজগুলোকে বেগবান করার জন্য।


বিশ্বব্যাপী বঙ্গবন্ধুর সুপরিচিত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও দূরদর্শিতার কারণে তাঁর সাড়ে তিন বছরের শাসনকালের মধ্যে বাংলাদেশ ১১৬টি দেশের স্বীকৃতি ও ২৭টি আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্যপদ লাভ করেছিল। কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকেই ঘরের শত্রু বিভীষণ হয়ে বাঙালির স্বাধিকার ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী, পাকিস্তানি শাসকদের অনুগত পরগাছাকুল নানা অপতৎপরতা ও ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিল। দেশীয় ষড়যন্ত্রকারীদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল আন্তর্জাতিক বিরুদ্ধ মতাদর্শের ক্রীড়নকরা। সাংবাদিক এমা রথস চাইল্ডের 'দুর্ভিক্ষের রাজনীতি' শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে আমরা জানতে পারি- ১৯৭৪ সালের বাংলাদেশের দুর্ভিক্ষ প্রাকৃতিক ছিল না, ছিল মানবসৃষ্ট। এমা তাঁর প্রতিবেদনে তুলে ধরেছিলেন চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষের পশ্চাৎ প্রেক্ষাপটের ষড়যন্ত্রের বিস্তারিত বিবরণ। ১৯৭৫ সালে শুরুতেই বঙ্গবন্ধু প্রশাসনিক ও দলীয় কাঠামো পরিবর্তনের মাধ্যমে সোনার বাংলা গঠনের পথে আরও এক ধাপ এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। বাংলাদেশের প্রশাসনিক প্রতিটি জেলার দায়িত্বে একজন করে গভর্নর নিয়োগ করা হয়। নিযুক্ত গভর্নরদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। অন্যদিকে সবাই মিলে স্বপ্টেম্নর বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে সব গণতান্ত্রিক দল ও ব্যক্তিকে নিয়ে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ গঠনের উদ্যোগ নেন।

কিন্তু স্বপ্টেম্নর সোনার বাংলার পথে এগিয়ে যাওয়ার সাধ তাঁর অপূর্ণই থেকে যায়?। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট গভীর রাতে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী দেশি-বিদেশি চক্রের পরিকল্পিত নীলনকশায় নৃশংস ঘাতকরা নির্মমভাবে হত্যা করে বাঙালির প্রাণপ্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবার-পরিজনকে। ক্ষমতা দখলকারী শাসকগোষ্ঠী বাংলাদেশের স্থপতি ও তাঁর পরিবার-পরিজনকে নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিচারের পরিবর্তে বিশেষ অধ্যাদেশ জারি করে খুনিদের দেয় দায়মুক্তি! খুনিদের শাস্তির বদলে বিদেশে বাংলাদেশের বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে সোনার বাংলার স্বপ্টেম্নর পথে বাংলাদেশের যাত্রা রুদ্ধ করা হয়। গুটিকতক বিপথগামী সৈনিকের হাতে নিহত রাষ্ট্রপ্রধান ও তাঁর পরিবার- এ অপপ্রচার চলেছে দীর্ঘদিন।

প্রকৃতপক্ষে, এ হত্যাকাণ্ড ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ববিরোধী দেশি-বিদেশি চক্রের গভীর ষড়যন্ত্র। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পর উল্টোরথে যাত্রা শুরু হয় বাংলাদেশের! অন্য এক বাংলাদেশ যেন, মনে হতো এ দেশে স্বাধীনতার জন্য দীর্ঘ ২৩ বছরের সংগ্রাম হয়নি। সত্তরের নির্বাচনে বাঙালির বিপুল বিজয়, একাত্তরের মার্চের অসহযোগ আন্দোলন, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ, মহান মুক্তিযুদ্ধ- এ সবকিছুই কখনও ঘটেনি এ দেশে! এসব মিথ্যা, সবই মায়া-মরীচিকা! স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ দেশের মুক্তিদাতা নন, পরম শত্রু! স্বাধীনতার স্বপ্টম্ন দেখালেন যিনি, যাঁর তর্জনী নির্দেশে একদিন চলেছে গোটা বাংলাদেশ, যাঁর অমোঘ আহ্বানে এ ভূখণ্ডের মানুষ যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে মুক্তিযুদ্ধে- বড় বিস্ময় জাগে মনে, স্বাধীনতার স্থপতি, অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু নিষিদ্ধ হলেন বাংলাদেশে! হায় অভাগা দেশ, অভাগা বাঙালি জাতি!

পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর হত্যার মধ্য দিয়ে ৩০ লাখ শহীদের আত্মদান, দুই লাখ মা-বোনের অসম্মানের বেদনা, স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণকারীদের মর্মপীড়া সব পদদলিত করে রাষ্ট্রক্ষমতায় সদর্পে আসীন হয়, তখন বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী পরাজিত শক্তি। চিহ্নিত রাজাকার ছাড়াও মুখোশধারী অনেক নব্য রাজাকার সেদিন মুখোশ খুলে বেরিয়ে আসে। দেশে চলে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি ও রাজাকারদের দোর্দণ্ড প্রতাপ। রাজাকারদের মন্ত্রী করা হলো। রাজাকার মন্ত্রী তার সরকারি বাহনে একাত্তরের শহীদের রক্তে রাঙানো লাল-সবুজে আঁকা আমাদের প্রাণের পতাকা উড়িয়ে দেশময় দাপিয়ে বেড়াল। ক্ষোভে, দুঃখে, লজ্জায় তরুণ এক কবি তাঁর খেদ প্রকাশ করলেন কবিতায়-'এদেশ কি ভুলে গেছে সেই দুঃস্বপ্টেম্নর রাত, সেই রক্তাক্ত সময়?/বাতাসে লাশের গন্ধ ভাসে মাটিতে লেগে আছে রক্তের দাগ।/এই রক্ত মাখা মাটির ললাট ছুঁয়ে একদিন যারা বুক বেঁধেছিল, জীর্ণ জীবনের পুঁজে তারা খুঁজে নেয় নিষিদ্ধ আঁধার।

আজ তারা আলোহীন খাঁচা ভালোবেসে জেগে থাকে রাত্রির গুহায়।'

১৫ আগস্ট আমাদের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হরণের দিন, সাম্প্রদায়িক শক্তির পুনরুত্থানের দিন, পরাজিত অন্ধকার ফিরে আসার দিন, স্বপ্নের সোনার বাংলার পথে বাংলাদেশের এগিয়ে চলা রুদ্ধ করার দিন। ১৫ আগস্ট বাঙালির পিতৃহত্যার রক্তে রাঙানো দিন, হৃদয়ে রক্তক্ষরণের দিন।

লেখক, প্রাবন্ধিক