- জাতীয় শোক দিবস
- ১৫ আগস্টের ইতিহাসচর্চা: কিছু বিভ্রান্তি প্রসঙ্গে
১৫ আগস্টের ইতিহাসচর্চা: কিছু বিভ্রান্তি প্রসঙ্গে

'বিপথগামী' সেনাসদস্যরা?
কোনো এক মনীষী বলেছিলেন, ইতিহাসের দখল নিয়ে ইতিহাসচর্চার ভেতরেই যুদ্ধ চলছে। সে যুদ্ধও যথেষ্ট রক্তাক্ত। এখন মৃতেরাও নিরাপদ নয়।
বঙ্গবন্ধুর শাহাদাতবার্ষিকী এলেই গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কিংবা বক্তৃতায় প্রায়ই বলতে শুনি যে, তিনি নিহত হয়েছিলেন কতিপয় বিপথগামী সেনাসদস্যের হাতে। এ কথাটি শুনে আমার মনে প্রশ্ন জাগে যে, এই শিরোপা বা অভিধাটা আদৌ সঠিক কিনা?
তার কারণ হচ্ছে, এই 'বিপথগামী' শব্দটা আমরা সচরাচর ব্যবহার করি পরিবারের কোনো উচ্ছন্নে যাওয়া, বখাটে বা মাস্তান হয়ে যাওয়া সন্তানের ক্ষেত্রে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যাকারী সেনাসদস্যদের ক্ষেত্রে এই 'বিপথগামী' শব্দটি ব্যবহার করলে এমন একটি ধারণা হয়, যেন হঠাৎ করে বিগড়ে যাওয়া বা বাজে সংসর্গে পড়ে বখে যাওয়া কিছু সেনাসদস্য এই কাণ্ডটি ঘটিয়েছে। কিন্তু যখন আমরা এই হত্যাকাণ্ডের পূর্বাপর ঘটনাপ্রবাহের অনুসন্ধান করি- আমরা দেখতে পাই, এটি হঠাৎ ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনা নয়। হুমায়ূন আহমেদ তাঁর উপন্যাস 'দেয়াল'-এ এ নিয়ে লিখেছেন- বইয়ের শুরুই হয় আন্ধা হাফিজের সাথে কর্নেল ফারুকের সাক্ষাতের বর্ণনা দিয়ে। যদিও তিনি উপন্যাসটি শেষ করে যেতে পারেননি, তবু যতটুকু লিখেছেন তাতে বিষয়টি স্পষ্ট যে, এর পেছনে একটি অভ্যুত্থান-পরিকল্পনা ছিল।
এবং অনেকদিন থেকে এই পরিকল্পনা চলে আসছিল। অন্তত ঘটনাটি ঘটানোর এক বছর আগে থেকে। ছ'মাস আগে থেকে যার জোরেশোরে প্রস্তুতি চলছিল। সুতরাং এই ঘটনার কুশীলবদের 'বিপথগামী' বলে লঘু করার কোনো অবকাশ নেই। এটি একটি অভ্যুত্থান ছিল এবং এর চক্রান্ত বা ষড়যন্ত্র যারা করেছে, তারা নিজেদের মধ্যে অনেকবার মিলিত হয়েছে, অনেক বিদেশি এবং দেশি শক্তি, সেনাবাহিনীর ভেতরের এবং বাইরের শক্তির সাথে তারা আলাপ-আলোচনা করেছে। এবং তার পরই আটঘাট বেঁধে তবেই এই ঘটনা তারা ঘটিয়েছে।
সুতরাং এখানে আমি আমার এই আপত্তিটা জানিয়ে রাখলাম যে, বঙ্গবন্ধুর শাহাদাতবার্ষিকীতে আমরা যেন এই 'বিপথগামী' শব্দটা ব্যবহারের আগে তাকে সপরিবারে হত্যা করে ঘটানো অভ্যুত্থানের পেছনের দীর্ঘ পরিকল্পনার কথা মনে রাখি।
সাম্রাজ্যবাদীরা জানত না?
বঙ্গবন্ধুর শাহাদাতবার্ষিকীর আলোচনায় আরেকটি ধারা আমাদের সাম্প্রতিক ইতিহাস চর্চায় ধরা পড়ে। সেটি হচ্ছে, যেনতেনভাবে প্রমাণ করা যে, ঘটনা যেটি ঘটেছে সেটি প্রধানত অথবা একমাত্র অভ্যন্তরীণ শক্তির চক্রান্তেই ঘটেছে। এর সাথে বিদেশি সাম্রাজ্যবাদী শক্তি বিশেষ করে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী শক্তি বা সিআইএ'র কোনো যোগসূত্র ছিল না। এটি আমার কাছে খুবই কষ্টকল্পিত মনে হয়। এটি ঠিক যে, সরাসরিভাবে আমরা এখনও এমন কোনো তথ্যপ্রমাণ পাইনি যে, ইউএসএ স্টেট ডিপার্টমেন্ট বা সিআইএ বঙ্গবন্ধুকে মেরে ফেলেছে।
কিন্তু এটাও ঠিক যে, ঢাকার মার্কিন দূতাবাস এবং ওয়াশিংটনের স্টেট ডিপার্টমেন্ট পরোক্ষ এবং প্রত্যক্ষভাবে জানত যে, বঙ্গবন্ধুকে মেরে ফেলার ষড়যন্ত্র চলছে। এবং এই ষড়যন্ত্র যে সেনাবাহিনীর একটি অংশ থেকে পরিচালিত হচ্ছে সেই সম্পর্কেও তারা অবগত ছিল। এটি বিভিন্ন সূত্র থেকেই এখন প্রমাণিত। এ নিয়ে বিশদ ভাবে লিখেছেন লরেন্স লিফশুলজ। এতে তো বিস্ময়ের কিছু নেই! কারণ তখন ঠান্ডাযুদ্ধের সময়ে বঙ্গবন্ধুর ব্যাপারে এটাই ভাবা হতো যে, তিনি সোভিয়েত শিবিরের দিকেই ঝুঁকে আছেন এবং ভারত-সোভিয়েত শক্তির দিকেই তাঁর পক্ষপাতিত্ব। তাঁর বক্তব্যে, কথাবার্তায়ও ঘনঘন গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র, সামাজিক ন্যায়বিচার, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা- এসব উঠে আসছিল। তিনি জুলিও কুরি শান্তি পুরস্কার পেয়েছেন ১৯৭৩ সালে। বিশ্বশান্তি পরিষদ থেকে দেওয়া এই পদকটিও সোভিয়েত বলয়ের দিক থেকে একটি বড় স্বীকৃতি। তিনি যে বছর এ পদকটি পেয়েছেন, সে বছর পদকটি পেয়েছেন ফিদেল কাস্ত্রোও।
আমরা সকলেই জানি যে, ১৯৭৩ সালেই চিলিতে সালভাদর আয়েন্দে সরাসরি মার্কিন মদদে নিহত হয়েছেন। এবং মধ্য আমেরিকার বিভিন্ন দেশে সিআইএ'র প্রত্যক্ষ মদদে ক্যু-পাল্টা ক্যু-এর ঘটনা, রাষ্ট্রপ্রধান নিহত হবার ঘটনা আকছারই ঘটছিল। নোবেলজয়ী ঔপন্যাসিক মারিও ভার্গাস ইয়োসা তাঁর 'হার্শ টাইমস' (নিস্করুণ সময়) উপন্যাসে গুয়েতেমালার পরিপ্রেক্ষিতে সেটা তুলে ধরেছেন। আরও বহু মানুষের লেখায় সেসব প্রকাশিত। এবং সেন্ট্রাল আমেরিকায় সিআইএ'র সংশ্নিষ্টতার ব্যাপারে নোয়াম চমস্কির কন্যা আভিভা চমস্কিও বিশদভাবে বর্ণনা করেছেন। এমনকি 'রোগ স্টেট' (দুর্বৃত্ত রাষ্ট্র) নামে যে বইটি বেরিয়েছে এবং বেশ জনপ্রিয়তাও পেয়েছিল-সেখানেও উইলিয়াম ব্লুম দেশে দেশে সিআইএ এবং স্টেট ডিপার্টমেন্ট ঠান্ডাযুদ্ধের পটভূমিতে প্রয়োজনে ক্যু-পাল্টা ক্যু করতে যে পিছপা ছিল না, এটা নানাভাবে তুলে ধরেছেন। আমি 'রোগ স্টেট'-এর লেখক ব্লুম সাহেবকে একটি ইমেইল লিখেছিলাম কয়েক বছর আগে; এবং জানতে চেয়েছিলাম যে, বাংলাদেশে এই বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পেছনে সরাসরিভাবে সিআইএ'র জড়িত থাকার ব্যাপারে তিনি কোনো প্রত্যক্ষ প্রমাণ পেয়েছেন কিনা। তিনি উত্তরে জানিয়েছিলেন যে, প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের বিষয়টি তিনি গবেষণায় আনেননি। তবে অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রে তিনি বিষয়টা তলিয়ে দেখেছেন।
কিন্তু, বাংলাদেশে এটার সম্ভাবনাকে তিনি এক কথায় উড়িয়ে দেননি। সবচাইতে বড় কথা হচ্ছে ক্রিস্টোফার হাচিন্সের মতো লেখক তাঁর 'ট্রায়াল অব হেনরি কিসিঞ্জার' বইতে সরাসরিভাবে মুজিব যে সিআইএ'র ষড়যন্ত্রে পড়ে নিহত হয়েছেন অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পেছনে যে সিআইএ ছিল, সেটি স্পষ্ট করে উল্লেখ করেছেন। এখন হয়তো আমাদের কাছে প্রত্যক্ষ প্রমাণ নেই, কিন্তু কোনো এক সময় এই প্রমাণ মিলবে, সে রকম সম্ভাবনা থেকেই যায়। শুধু অভ্যন্তরীণ শক্তির ওপর ভিত্তি করে চক্রান্তকারীরা এত বড় একটা ঘটনা ঘটিয়ে ফেলল, যার মাধ্যমে পুরো ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের অবস্থানটাই পরবর্তী ২০ বছরের জন্য বদলে গেল- এমনটা হতে পারে না। এর পেছনে বিদেশি মদদদাতা ছিল।
আমরা জানি খন্দকার মোশতাক আহমেদ নিজে ছিলেন কেবিনেটের ভেতরে এদের মদদদাতা। তাঁর সাথে মার্কিন যোগাযোগ ছিল। প্রশাসনের ভেতরে কেউ কেউ ষড়যন্ত্রে জড়িত ছিলেন বলে শুনেছি। সুতরাং প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সব প্রমাণ মিলিয়ে এটা পরিস্কার যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবগত থাকা অবস্থাতেই এ ঘটনাটা ঘটে। এবং তৎকালীন সোভিয়েত রাষ্ট্রদূত একাধিকবার বঙ্গবন্ধুকে এ ব্যাপারে সতর্ক করেছেন- এ নিয়ে আমরা বিভিন্ন সূত্রে লেখা পড়েছি। সোভিয়েত পক্ষ থেকে এটা বলার চেষ্টা করা হয়েছে যে, আপনি নিজের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিয়ে সতর্ক হোন। কিন্তু মুজিব সে কথায় কর্ণপাত করেননি। বাঙালিরা তার বিরুদ্ধাচরণ করতে পারে, কিন্তু তার দিকে বন্দুক তাক করতে পারবে না। ভারত এবং র'এর পক্ষ থেকেও বঙ্গবন্ধুকে এটা বলার চেষ্টা করা হয়েছে।
কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা স্টেট ডিপার্টমেন্টের পক্ষ থেকে, বা তার রাষ্ট্রদূতের পক্ষ থেকে কোনো একটা সাক্ষাৎকারে কখনও বঙ্গবন্ধুকে বলার কোনো নজির নেই যে তাঁর প্রাণনাশের আশঙ্কা রয়েছে। তৎকালের মার্কিন রাষ্ট্রদূত কখনও তাকে সতর্ক করেন নি। সুতরাং এ নিয়ে আমরা যারা অতি পিউরিস্ট প্রমাণাদি খুঁজছি যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা সাম্রাজ্যবাদী শক্তি বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিল না- এ ব্যাপারে আমার কিছুটা মৌন সমালোচনা বা দ্বিমত থেকেই যায় যে, এটা আমরা কেন করছি বা এ থেকে আমরা আসলে কী প্রমাণ করার চেষ্টা করছি? আমরা কি বলতে চাচ্ছি যে, সাম্রাজ্যবাদ লাভবান হয়নি এই বিনাশের দ্বারা? আমরা কি বলতে চাচ্ছি, বিশ্বজুড়ে তারা এই ধরনের চক্রান্ত চালিয়েছে-শুধু বাংলাদেশে এসে তারা নিরীহভাবে বলেছে যে, আমরা এর ভেতরে ঢুকতে চাই না? এটা কতটা বিশ্বাসযোগ্য?
তখন নাম নেওয়াও ছিল নিষিদ্ধ
এটা আজকের দিনে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে, কিন্তু এটা বাস্তব কথা যে, আমাদের ছাত্রজীবনে ১৯৭৫ সালের পর দীর্ঘ প্রায় ১৫ বছর এদেশে বঙ্গবন্ধুর নাম নেওয়াও প্রায় নিষিদ্ধ ছিল। বিশেষ করে জেনারেল জিয়ার শাসনামলে ১৯৭৬ থেকে ১৯৮১ সালের মধ্যে এটি খুব প্রবলভাবে বাস্তবায়িত হয়েছিল। আমি তখন ছাত্র হিসেবে মস্কোতে, মস্কো রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছি। যদিও আমি সরাসরিভাবে কোনো রাজনৈতিক দল বা সংগঠনের সাথে জড়িত ছিলাম না, তবুও মস্কোতে যাঁরা বঙ্গবন্ধু পরিষদ করতেন তাঁদের আমন্ত্রণে অনেক সভায় আমি গিয়েছি এবং দেখেছি যে, কতটা গোপনীয়তার সাথে সেই সভাগুলো পরিচালনা করা হতো। তাঁদের জিজ্ঞেস করলে তাঁরা বলতেন যে, বঙ্গবন্ধু পরিষদে কারা জড়িত এবং বঙ্গবন্ধু পরিষদের সভায় কারা যায়, সেই নামগুলো মস্কোর বাংলাদেশ দূতাবাস এবং প্রতিরক্ষার যিনি এটাশে তিনি সংগ্রহ করতেন। সেই মর্মে নামগুলো দেশের এনএসআই-এর কাছে প্রেরণ করা লাগতো। এবং তাঁদের সবাই যেহেতু কোনো না কোনো সময়ে দেশে ফিরবেন-তাই সম্পূর্ণ শঙ্কাহীনভাবে কেউই বঙ্গবন্ধু পরিষদ করতে পারতেন না। এটা শুধু মস্কোর ক্ষেত্রেই নয়, এটা ওয়াশিংটনের ক্ষেত্রেও ছিল একইরকম। আমি পরে শুনেছি যে, ওয়াশিংটনেও দূতাবাস এই কাজটি করত এবং বঙ্গবন্ধু পরিষদে যেতে অনেকেই দ্বিধাবোধ করতেন। দেশের ভেতরে অবস্থাটা তো ছিল খুবই বিপদসংকুল। দেশের ভেতরে এই বঙ্গবন্ধু পরিষদ করাটা ছিল অত্যন্ত দুঃসাহসের কাজ।
ঢাকাতে প্রফেসর মোশাররফ হোসেন বঙ্গবন্ধু পরিষদ করার ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এবং দীর্ঘ এক দশককাল তিনি এ সংগঠনে কাজ করে আসছিলেন। তিনি আমাকে বলেছিলেন যে, তখন কতটা ঝুঁকিপূর্ণ ছিল বঙ্গবন্ধু পরিষদ করা এবং বঙ্গবন্ধুর নাম নেওয়া। সুতরাং আজকে হয়তো আমাদের কাছে মনে হতে পারে যে, আমরা হয়তো জাতিগতভাবে একটা ঐকমত্যে পৌঁছেছি অন্তত বঙ্গবন্ধুর ব্যাপারে, তাঁর নাম নেওয়া বা তাঁর আদর্শ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে, তাঁকে স্মরণ করার ব্যাপারে; কিন্তু বিষয়টা এরকম ছিল না সব সময়। তাঁর নাম নেওয়াও ছিল নিষিদ্ধ। সেটা কেন ছিল- সেই প্রশ্নই আমাকে পরবর্তী প্রসঙ্গের দিকে নিয়ে যায়।
সেটি এই কারণে যে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের মধ্যে এমন একটি দিক ছিল- যেটি না প্রথাগত পুঁজিবাদ না প্রথাগত সমাজতন্ত্র, তিনি এমন একটি সিস্টেম বা আদর্শ দেশে দাঁড় করাতে চাইতেন, যার মধ্যে বাজারও থাকবে রাষ্ট্রও থাকবে। যার মধ্যে ওয়েলফেয়ারও থাকবে, ব্যক্তিগত খাতেরও সমৃদ্ধি থাকবে; রাষ্ট্রায়ত্ত খাতও থাকবে, সমবায় খাতেরও বিকাশ হবে। এই যে বহুমুখী ধারার সমাবেশ তিনি করতে চেয়েছিলেন, সেটি প্রথাগত বামপন্থি কিংবা প্রথাগত ডানপন্থি কাউকেই সন্তুষ্ট করতে পারেনি। তারা বরং বঙ্গবন্ধুর মধ্যে এমন একটি আদর্শের প্রক্ষেপণ দেখেছেন, যেখানে অবাধ বাজারমুখী পুঁজিবাদের একটা বিকল্প জড়িয়ে আছে। সে কারণে তাঁরা সংবিধান পরিবর্তন করেছেন এবং এই কারণে তাঁর নামটি উচ্চারণ করতে দিতেও তাঁরা ভয় পেতেন বা ঝুঁকিপূর্ণ মনে করতেন।
গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের দিকে
আজকের বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর শাহাদাতবার্ষিকীকে কেন্দ্র করে আমরা যে শোকের মাস বা সারা বছর ধরে শোক পালন করি, সেটি যথেষ্ট নয়। আমাদের অনুধাবন করতে হবে যে, বঙ্গবন্ধু কীসের জন্য বা কীসের মধ্য থেকে প্রাণ দিলেন? বঙ্গবন্ধু প্রাণ দিলেন দ্বিতীয় বিপ্লবের প্রক্রিয়ার মধ্যে। বঙ্গবন্ধু অসমাপ্ত রেখে গেলেন তাঁর প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীভবনের কর্মসূচি। তিনি অসমাপ্ত রেখে গেলেন তাঁর সমবায় কর্মসূচি ও পরিকল্পনা। তিনি অসমাপ্ত রেখে গেলেন দেশের ভেতরে রাষ্ট্রায়ত্ত খাত ও ব্যক্তি খাতের সমন্বয়ে গঠিত একটি শক্তিশালী মিশ্রখাত গড়ে তোলার প্রক্রিয়া। তিনি অসমাপ্ত রেখে গেলেন আমাদের সংবিধানের ধারা, বিশেষ করে যেখানে সরাসরি গণতান্ত্রিক কাঠামোয় সমাজতন্ত্রের কথা বলা হয়েছে, যেখানে একটি ইগালেটেরিয়ান সোসাইটির কথা বলা হয়েছে, একটা বাম ধারার সোশ্যাল ডেমোক্রেসির কথা বলা হয়েছে। যার একটা লক্ষণ সুনির্দিষ্টভাবে এখন লাতিন আমেরিকায় দেখা যাচ্ছে। কলম্বিয়াতে আজকে সেই লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। একজন প্রগতিশীল ব্যক্তি কলম্বিয়াতে নির্বাচিত হয়েছেন। চিলিতেও এই পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে যে, আয়েন্দের মৃত্যুর এতদিন পরে চিলি তার রক্তাক্ত ঐতিহ্যটাকে অস্বীকার করে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফিরে এসেছে এবং তার মধ্যে তখনকার দিনের লড়াকু ছাত্রনেতা, নব্বইয়ের দশকে পিনোচেটবিরোধী আন্দোলনের নেতা এখন চিলিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন।
এই ধারা দেখা যাচ্ছে আর্জেন্টিনায়, এই ধারা দেখা যাচ্ছে ইকুয়েডরে, বলিভিয়ায়। এমনকি ব্রাজিলেও দেখা যাবে সমাজতান্ত্রিক একটা ধারা আবার নতুন করে ফিরে আসছে লুলার পার্টির পুনরুত্থানের মাধ্যমে। পর্তুগালে গত বছর সমাজতান্ত্রিকরা ক্ষমতায় এসেছে। ইউক্রাইন-রুশ সংঘাত কার্যত পরাশক্তিদের মধ্যকার লড়াইয়ে পরিণত হয়েছে। সারা বিশ্বে মার্কিন নেতৃত্বাধীন ইউনিপোলার ওয়ার্ল্ড-এর বিপরীতে একটা মাল্টিপোলার প্রগ্রেসিভ ভবিষ্যতের সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে।
এমন পরিস্থিতিতে আমার মতে আগস্ট মাসকে শুধু শোকের মাস হিসেবে পালন না করে শাসক দল এবং গোষ্ঠীর পুনরায় চিন্তা করা উচিত যে, আমরা যেভাবে উন্নয়নকে ভাবছি শুধু গ্রোথ-প্রবৃদ্ধির টার্মস এ, শুধু অবাধ বাজারমুখী পুঁজিবাদের টার্মস এ- সেইভাবে বিষয়টাকে না দেখে একটি জনকল্যানমুখী রাষ্ট্রের দিকে দৃঢ়ভাবে এগিয়ে যেতে হবে। এবং সেটাই মূলত বঙ্গবন্ধুর সেই গণতান্ত্রিক কাঠামোয় সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন বা আজকের যুগের ভাষায় প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র। যেখানে বাজার ও রাষ্ট্রের ভূমিকার মধ্যে ভারসাম্য থাকবে।
পুঁজির বিকাশ থাকবে, কিন্তু পুঁজির অত্যাচার বা দাপট থাকবে না। সামাজিক ন্যায়বিচার সমৃদ্ধ একটি মানবিক মূল্যবোধের সমাজ প্রতিষ্ঠা পাবে। স্বাধীনতা ও সাম্য দুইই সমান ভাবে স্বীকৃতি পাবে। সেটিকে বাস্তবায়নের জন্য শপথ নেওয়া এবং এগিয়ে যাওয়ার মধ্যেই সেই স্বপ্ন নিহিত রয়েছে। এই কাজটি সহজ নয়, এই কাজটি বন্ধুর। কারণ এখানে অনেক বাম ও ডান স্ট্যাটাসকো ফোর্সের বিপরীতে আমাদের দাঁড়াতে হবে। কিন্তু এই বিতর্কটা জরুরি। সমাজের সর্বস্তরে এই বিতর্কটা জরুরি যে, কীভাবে আজকের বাংলাদেশে প্রবৃদ্ধি বাড়ার সাথে সাথে বৈষম্য বাড়ার যে প্রবণতা-সেটাকে উল্টে দেওয়া যায়। কীভাবে সকলের জন্য একই গুণ-মানের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থা আমরা চালু করতে পারি। সকলের জন্য একটা মানবীয় মর্যাদা সম্পন্ন সমাজ যেন আমরা দেখতে পাই। এটি করলেই বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর শোক নিজের মধ্যে ধারণ ও শোক দিবস পালনের দিকে আমরা যথার্থভাবে অগ্রসর হতে পারব।
লেখক, প্রাবন্ধিক, মহাপরিচালক, বিআইডিএস
মন্তব্য করুন