- জাতীয় শোক দিবস
- ত্বকী হত্যা, বিচারহীনতা এবং দুর্বৃত্তের দাপট
স্মরণ
ত্বকী হত্যা, বিচারহীনতা এবং দুর্বৃত্তের দাপট

মানুষের জীবনে এমন কিছু ঘটনা থাকে, যা তাকে এমনভাবে নাড়া দিয়ে যায়; জীবনের অংশ না হয়েও তার চিন্তা, মনন, আবেগ বা বিবেক থেকে সেই সবের ছায়া কিছুতেই সরে না । তানভীর মুহাম্মদ ত্বকীর নৃশংস হত্যাকাণ্ড আমার জন্য তেমনই এক ঘটনা। ত্বকীকে আমি কখনও দেখিনি। ত্বকীর বাবা রফিউর রাব্বি নারায়ণগঞ্জ জেলার সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনের একজন প্রথম সারির নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি। তিনি দীর্ঘদিন ধরে নারায়ণগঞ্জের নানা সামাজিক ও রাজনৈতিক অনাচার ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে আসছেন।
হঠাৎ যেদিন পত্র-পত্রিকা, বন্ধু ও সহকর্মীদের কাছে এই ভয়ংকর খবরটা পেলাম; সত্যি বলে মেনে নিতে পারিনি। জানতে পারি, ২০১৩ সালের ৬ মার্চ পাঠাগার থেকে বই আনার পথে দুর্বৃত্তরা ত্বকীকে তুলে নিয়ে যায় নারায়ণগঞ্জ শহরের পরিচিত আল্লামা ইকবাল রোডের টর্চার সেলে। সেখানেই নির্মমভাবে হত্যা করে সে রাতেই ঘাতকরা ত্বকীর লাশ ফেলে দেয় শীতলক্ষ্যা নদীর খালপাড়ে। ত্বকীর ছবিটা দেখে বুকের ভেতরটা কুঁকড়ে উঠেছিল। এই শিশুটিকে কেউ হত্যা করতে পারে! তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী ‘এ লেভেল’ প্রথম পর্বের পরীক্ষা দিয়েছিল। প্রকৌশলী হওয়ার ইচ্ছে ছিল তার। নারায়ণগঞ্জের সুধীজন পাঠাগারে যাওয়ার পথে যেদিন সে অপহৃত হয়, তার এক দিন পরই পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয় ত্বকীর। এর পর দশ দশটা বছর চলে গেছে, কিন্তু ত্বকী হত্যার বিচার হয়নি!
আমরা জাতি হিসেবে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কত গৌরব বোধ করি! তারও আগে কত আবেগ নিয়ে, কষ্ট নিয়ে গান গেয়েছি– ‘শিশুহত্যার বিক্ষোভে আজ কাঁপুক বসুন্ধরা...।’ সেই আবেগ, সেই গৌরব সৎভাবে ধরে রাখতে পারলাম কি? তাহলে আমরা আজ ১০ বছরেও ত্বকী হত্যার বিচার করতে পারলাম না কেন? ত্বকী হত্যার বিক্ষোভে বাংলাদেশ কেঁপে উঠল না কেন?
আজকে বাংলাদেশে বন্দুকের নলের জোরে কোনো অগণতান্ত্রিক শক্তি ক্ষমতা দখল করে বসে নেই। এক যুগেরও অধিক সময় ধরে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের দল দেশ শাসনের দায়িত্বে রয়েছে। তা সত্ত্বেও কেন আজও ত্বকীর বাবা আর তাঁর কিছু শুভানুধ্যায়ীকে ত্বকী হত্যার বিচার চেয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হয়? মানববন্ধন, সংবাদ সম্মেলন করতে হয়? ডাকতে হয় প্রতিবাদ সভা? বিচারের দাবিতে ১০ বছর ধরে নানা ধরনের প্রতিবাদ আমরা দেখে আসছি– মিছিল, সমাবেশ, মানববন্ধন, সংবাদ সম্মেলন, আলোক প্রজ্বালন, গোলটেবিল বৈঠক, প্রতীকী অনশনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি। গঠিত হয়েছে সন্ত্রাস নির্মূল ত্বকী মঞ্চ।
বস্তুত ত্বকী হত্যা এমন কোনো জটিল রহস্যজনক হত্যাকাণ্ড নয়, যার উদ্ঘাটন দুঃসাধ্য। ঘটনার সূত্রগুলো মোটামুটি সর্বজনবিদিত; শুধু প্রমাণের অপেক্ষা। এ কথাও সবাই জানি, এই ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরপরই রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা বাহিনী তাদের প্রতিবেদনে যথেষ্ট স্পষ্টভাবে হত্যাকারীদের চিহ্নিত করেছিল। তারপর কী এক অজ্ঞাত কারণে পুরো বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়া হলো এবং আজকে ১০ বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরও সেই অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে গেল। নানান তথ্য, ঘটনার বিশ্লেষণ, নারায়ণগঞ্জের সাধারণ মানুষের কথাবার্তা থেকে হত্যাকারীদের পরিচয় এখন আর কারও অজানা নয়।
এমন কি ত্বকী হত্যার বিচার চেয়ে যত সভা হয়েছে; প্রতিটিতে বক্তারা খোলাখুলিভাবে অভিযুক্তদের নাম পর্যন্ত উল্লেখ করতে পিছপা হননি। কিন্তু বিচারের দায়ভার যাদের, তারা একেবারেই নির্বিকার উপেক্ষায় ১০টা বছর কাটিয়ে দিল! এর চেয়ে হতাশাজনক ব্যাপার আর কী হতে পারে? এর পরও সময় গড়িয়েছে কিন্তু অগ্রগতি থেমে আছে। এবারও আমরা পুনরায় বিবৃতি দিয়ে সরকারের কাছে ত্বকী হত্যার বিচারের দাবি জানিয়েছি। স্বাভাবিকভাবেই আমরা উদ্বিগ্ন ও ক্ষুব্ধ। অথচ এ হত্যাকাণ্ডের এক বছর না যেতেই মামলার তদন্তকারী সংস্থা র্যাব কেন, কখন, কোথায়, কারা এবং কীভাবে ত্বকীকে হত্যা করেছে, তা সংবাদ সম্মেলন করে যাবতীয় তথ্য প্রকাশ করেছিলেন, যা তখন সংবাদপত্র ও বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। তদন্ত শেষ করার দীর্ঘদিন পরও এ হত্যার অভিযোগপত্র আদালতে পেশ করা হয়নি।
একটি সমাজ নিজেকে যখন সভ্য বলে দাবি করে এবং রাজনীতিকরা বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দল নিজেদের সৎ, গণতান্ত্রিক, জনগণের কল্যাণে নিয়োজিত আছে বলে দাবি করে; তখন সে দেশে শিশুহত্যার বিচার না হওয়ার কী অজুহাত থাকতে পারে? এত বড় অনাচার তারা হতে দিতে পারে কী করে? ত্বকী হত্যার বিচার না হওয়া এ দেশে বিচারহীনতার সংস্কৃত; একই সঙ্গে দুর্বৃত্তদের দাপটের এক ঐতিহাসিক দলিল হয়ে থাকল। আমাদের জন্য এ এক বিরাট দুর্ভাগ্য। আমার জীবদ্দশায় হয়তো ত্বকী হত্যাসহ অপেক্ষায় থাকা আরও অপরাধের বিচার দেখে যেতে পারব না। শুধু প্রার্থনা করতে পারি– আমার প্রিয় মাতৃভূমি এই বিচারহীনতার অনাচার থেকে মুক্ত যেন হতে পারে।
সুলতানা কামাল: মানবাধিকার কর্মী
মন্তব্য করুন