গভীর রাত। কুয়াশায় ঘেরা চারপাশ। বাগেরহাটের মোংলা বন্দর থেকে নোঙর তুলে ‘নীল কমল’ লঞ্চ যখন সুন্দরবনের দিকে রওনা দিল, তখন পশুর নদ একেবারেই নিস্তব্ধ। অন্ধকার আর কুয়াশা ভেদ করে নীল কমল ছুটছে সুন্দরবনের দিক। নৌযানটি এগিয়ে গেল ঢাংমারি ফরেস্ট অফিসের দিকে। নিরাপত্তার জন্য সেখান থেকে উঠলেন বনপ্রহরী মোহাম্মদ ইউসুফ। রাতের অন্ধকার মিলিয়ে পরদিন ভোরে জেগে উঠল সুন্দরবন। হাত দিয়ে ছোঁয়া যায় এমন দূরত্বে একপাল হরিণ অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। গত ৩০ জানুয়ারি থেকে টানা তিন দিন সুন্দরবনের বাঁকে বাঁকে বাঘ দেখা না গেলেও ঝাঁকে ঝাঁকে হরিণের দেখা মিলছে।

বনপ্রহরী মোহাম্মদ ইউসুফ ২০ বছর ধরে সুন্দরবনে চাকরি করছেন। দীর্ঘ জীবনের নানা অভিজ্ঞতা মেলে ধরলেন তিনি। মায়াবী চিত্রা হরিণ কীভাবে বনের রূপ বাড়িয়ে দিয়েছে– সেই গল্পও উঠে এলো আলাপচারিতায়। চাকরি জীবনের শুরুর দিকে হরিণের পাল দেখে নয়ন জুড়াতেন তিনি। মাঝে বেশ কয়েক বছর হরিণ কমে গেলেও এখন আবার সেই আগের রূপ ফিরে এসেছে জানিয়ে ইউসুফ বলেন, খাল বা নদীর ধারে দল বেঁধে হরিণের চলাফেরার দৃশ্য এখন হরহামেশাই চোখে পড়ে। এমনকি বন বিভাগের কার্যালয়েও বন্য হরিণের দল ঘুরে বেড়ায়। কয়েক বছর আগে কালাবগী ফরেস্ট স্টেশনের আওতাধীন হাডড্র খালে দেড়শ হরিণ থাকত, এখন সেখানে কমপক্ষে সাড়ে ৩০০ হরিণ আছে।

শুধু ইউসুফই নন, বন বিভাগ, গবেষক, বনজীবী থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট সবাই সুন্দরবনে সাম্প্রতিক সময়ে হরিণের সংখ্যা বাড়ার কথা জানিয়েছেন। তবে সঠিক সংখ্যা নির্ধারণে ২০১৮ সালের পর আর জরিপ হয়নি। যদিও গত বছরের নভেম্বর থেকে হরিণ ও শূকরের সংখ্যা নির্ধারণে গবেষণা শুরু হয়েছে। এ গবেষণার ফল পেতে অপেক্ষা করতে হবে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। ২০১৮ সালের জরিপ অনুযায়ী, সুন্দরবনে এক থেকে দেড় লাখ হরিণ আছে।

তবে হরিণের সংখ্যা বাড়লেও তা শিকার বন্ধ করা যাচ্ছে না। বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, গত জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে অন্তত ৩০ জন শিকারিকে হরিণের মাংস, চামড়াসহ আটক করা হয়েছে।  বনরক্ষীরা যে পরিমাণ হরিণের মাংস উদ্ধার ও শিকারিদের আটক করেছেন, তার চেয়ে অনেক বেশি হরিণ শিকারিদের হাতে মারা গেছে বলে জানান স্থানীয়রা।

এ অবস্থায় আজ শুক্রবার পালিত হচ্ছে বিশ্ব বন্যপ্রাণী দিবস। ২০১৩ সালের ২০ ডিসেম্বর জাতিসংঘের ৬৮তম সাধারণ অধিবেশনে ৩ মার্চকে বিশ্ব বন্যপ্রাণী দিবস ঘোষণা করা হয়।

সুন্দরবনের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে হরিণ শিকারিদের উপস্থিতি কিছুটা আঁচ করা গেছে। গহিন বনের বিভিন্ন খালে মৎস্যজীবীদের নৌকায় মাছ শিকার করতে দেখা গেছে। আবার কোথাও কোথাও হরিণ শিকারের ফাঁদ মিলেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বন বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, সাম্প্রতিক সময়ে মাছ ধরার পাস নিয়ে বনে ঢুকে হরিণ শিকারে মেতেছে এক শ্রেণির অসৎ লোক। আবার চোরা শিকারির অনেকেই অবৈধভাবে বনে অনুপ্রবেশ করছে শিকারের জন্য। আর তাদের আশ্রয় দেয় স্থানীয় প্রভাশালীরা। এ কাজে যোগসাজশ আছে বন বিভাগের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীরও। সংঘবদ্ধ চোরা শিকারিরা সুন্দরবনের গহিনে কেওড়া গাছের ফাঁকে ফাঁকে অবস্থান নিয়ে নৌকা, ট্রলার ও গাছে মাচা পেতে হরিণের গতিবিধি লক্ষ্য করে। হরিণ নদী ও খালের চরাঞ্চলে ঘাস খেতে আসে। শিকারিরা এসব স্থানে ফাঁদ পেতে হরিণ শিকার করে।
একাধিক স্থানীয় ব্যক্তি ও বনকর্মীর সঙ্গে কথা হলেও কেউ প্রভাশালীদের নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বনকর্মী বলেন, আগে বন্দুক ব্যবহার করা শিকারি বেশি ছিল। এখন সেটা আর সেভাবে সম্ভব হচ্ছে না। নাইলনের দড়ির এক ধরনের ফাঁদ ব্যবহার করে শিকারিরা। হরিণের নিয়মিত যাতায়াতের পথে এগুলো পাতা হয়। যাতায়াতের সময় হরিণগুলো আটকে যায়। এক রাতে পেতে আসা হয়, পরের রাতে গিয়ে আবার দেখা হয়।  হরিণের মাংস চলে যায় ঢাকায়ও। ১ হাজার থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা কেজি দরে হরিণের মাংস অগ্রিম অর্ডারও নেয় শিকারিরা।

ওয়াইল্ড লাইফ ট্রাস্ট অব বাংলাদেশ (বর্তমানে ওয়াইল্ড টিম) নামের একটি বেসরকারি সংস্থা ২০১১ সালে একটি জরিপ চালিয়েছিল। তখন তাদের হিসাবে দেখা গেছে, বছরে ১১ হাজারের বেশি হরিণ নিধন হচ্ছে। কিন্তু এর পর নতুন করে কোনো জরিপ হয়নি। তবে এই হিসাব মানতে রাজি নন বন অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা।

সুন্দরবন দেখভালের জন্য বন অধিদপ্তরের দুটি বিভাগ রয়েছে। একটি খুলনা ও সাতক্ষীরা নিয়ে (সুন্দরবন পশ্চিম), অন্যটি খুলনার অংশ ও বাগেরহাট নিয়ে (সুন্দরবন পূর্ব বিভাগ)। দুই বিভাগের অধীনে আছে চারটি বন অঞ্চল।

পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মুহাম্মদ বেলায়েত হোসেন বলেন, জেলে পারমিট নিয়ে বনে ঢুকে হরিণ হত্যা ও পাচারের অপরাধে বিভিন্ন সময় জেলে ও বনজীবীদের আটক করা হচ্ছে। পারমিট বাদেও সুন্দরবনে অবৈধভাবে ঢুকে হরিণ হত্যা ও পাচারের অপরাধেও আটক হয়েছে অনেকে। এই চোরা শিকারিরা অনেক শক্তিশালী। এদের বড় নেটওয়ার্ক রয়েছে। এদের ধরতে সুন্দরবন সংলগ্ন লোকজন খুব একটা সহযোগিতা করে না। এদের বিরুদ্ধে মানুষ সাক্ষ্য দিতেও ভয় পায়। তারা এই সুযোগ নিয়ে আইনের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আসে।
নানা সংকটের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, এখানে ৫১৬ জনবলের পদ থাকলেও কর্মরত আছেন ২৯০ জন। এত অল্প জনবল দিয়ে দায়িত্ব পালন করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এত বড় বনে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ একা বন বিভাগের পক্ষে সম্ভব নয়। সবাইকে সচেতন হতে হবে।

সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ড. আবু নাসের মোহসিন হোসেন বলেন, এ অঞ্চলে ৩০ শতাংশ পদ খালি পড়ে আছে। মানুষের মাঝে সচেতনতা তৈরি না হলে হরিণ শিকার বন্ধ করা সম্ভব নয়। আমরা স্বল্প জনবল নিয়েই নিয়মিত টহল দিচ্ছি। প্রায়ই হরিণ শিকারিরা ধরা পড়ছে।

তিনি বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে সুন্দরবনের বন্যপ্রাণী রক্ষায় অপরাধে জড়িতদের তথ্য প্রদানকারীকে পুরস্কার বিধিমালা-২০২০ অনুমোদনের ফলে এখন চোরা শিকারিদের ব্যাপারে সাধারণ মানুষ তথ্য প্রদানে উৎসাহিত হয়েছে। তথ্য দিলে ৮ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে।