প্রকৃতি থেকে বসন্তের বিদায়ী সুর বাজতে এখনও মাসখানেক বাকি। এর মধ্যেই গরমে হাঁসফাঁস পরিস্থিতি। চার মাস ধরে বৃষ্টির দেখা নেই। তেজি রোদে খরখরে প্রকৃতি। ফাল্গুনের আগুন ঝরা এমন দিনে ঝুঁকিও বেশ। আগুন লাগে সহজে, আর ফাল্গুনের বাতাসে সে আগুন গতি পায় নিমেষে।

এপ্রিল, মে ও জুন– শুষ্ক মৌসুমের এই তিন মাসে দেশে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে সবচেয়ে বেশি। তবে এ বছর শুষ্ক মৌসুম শুরুর আগেই রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা সতর্ক হওয়ার আগাম বার্তা দিচ্ছে। সর্বশেষ গত সপ্তাহে রাঙামাটির সাজেক ও মৌলভীবাজারের পাথারিয়া বনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শহর-গ্রামে রান্নার পর গ্যাসের চুলার আগুন পুরোপুরি না নেভালে বাতাসে উড়ে তা বড় ক্ষতির কারণ হতে পারে। সিগারেট থেকেও ঘটতে পারে অগ্নিকাণ্ড। এ ছাড়া শহর এলাকায় অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার অপ্রতুলতা, অপরিকল্পিত ভবন নির্মাণ ও জরুরি নির্গমন বিষয়ে জ্ঞান না থাকা, দাহ্য ও বিস্ফোরক পদার্থের অনুমোদনহীন গুদামজাতকরণই অগ্নিকাণ্ডের প্রধান কারণ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অগ্নিকাণ্ডের কারণগুলো গুরুত্বের সঙ্গে দেখে বুঝে মানুষকে আরও সচেতন হতে হবে। এতে ক্ষয়ক্ষতি অনেকাংশেই কমিয়ে আনা সম্ভব।

বৃষ্টি হবে কবে: চার মাসেরও বেশি সময় ধরে নেই বারিধারা। গত বছরের নভেম্বর, ডিসেম্বর এবং এ বছরের জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি ও মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত বৃষ্টির একেবারে দেখা নেই। আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক মোহাম্মদ আজিজুর রহমান বলেন, অন্য বছর শীতের সময় বৃষ্টি হলেও এবারের প্রেক্ষাপট একেবারে ভিন্ন। বৃষ্টির অভাবে খরা পরিস্থিতি চার থেকে পাঁচ মাস পর্যন্ত বিস্তৃত হতে চলেছে। অন্য সময় ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সামান্য বৃষ্টি হলেও এবার তা হয়নি। গত নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত টানা চার মাসে সার্বিকভাবে স্বাভাবিকের চেয়ে গড়ে ৯১ দশমিক ৫ শতাংশ কম বৃষ্টি হয়েছে।

আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, গত চার মাসের মতোই এই মার্চ, অর্থাৎ ফাল্গুন-চৈত্র মাসে সার্বিকভাবে দেশে বৃষ্টি স্বাভাবিকের চেয়ে কম হতে পারে। তবে এ মাসে দেশে দুই থেকে তিন দিন বজ্র ও শিলাবৃষ্টিসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের কালবৈশাখী এবং এক দিন তীব্র ধরনের কালবৈশাখীর আশঙ্কা রয়েছে। মার্চের শেষ দিকে দেশের পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ওপর দিয়ে দুই থেকে তিনটি মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের তাপ প্রবাহ বয়ে যেতে পারে। এ সময় তাপমাত্রা সর্বোচ্চ ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস হতে পারে।

কানাডার সাসকাচুয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়া ও জলবায়ুবিষয়ক পিএইচডি গবেষক মোস্তফা কামাল পলাশ জানান, বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ওপর দিয়ে আগামী ১৫ থেকে ২১ মার্চ কালবৈশাখী, বজ্র ও শিলাবৃষ্টি হতে পারে।

তবে গতকাল চট্টগ্রাম, রাঙামাটি, কক্সবাজার ও সিলেটের ওপর দিয়ে মৃদু তাপপ্রবাহ বয়ে গেছে। এ দিন দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছিল সীতাকুণ্ড ও রাঙামাটিতে।

বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদপ্তরের হিসাবে গত বর্ষায়, অর্থাৎ জুলাই ও আগস্টে চার দশকের মধ্যে সবচেয়ে কম বৃষ্টি হয়। জুলাইয়ে বাংলাদেশে সাধারণত গড়ে প্রায় ৫০০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়। সেখানে গত বছর হয়েছে মাত্র ২১১ মিলিমিটার। আর আগস্টেও বৃষ্টি ছিল স্বাভাবিকের চেয়ে ৪০ শতাংশ কম।

আগুনের ঝুঁকি: শুষ্ক মৌসুমে আগুন লাগার ঘটনা বাড়ে। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের ২০২২ সালের অগ্নিকাণ্ড ও দুর্ঘটনাসংক্রান্ত কার্যক্রমের বার্ষিক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, ২০২১ সালে অগ্নিকাণ্ডের সংখ্যা ছিল ২১ হাজার ৬০১টি, তবে ২০২২ সালে সারাদেশে ২৪ হাজার ১০২টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এক বছরের ব্যবধানে অগ্নিকাণ্ডের সংখ্যা বেড়েছে ২ হাজার ৫০১টি। সবচেয়ে বেশি ২ হাজার ৮৬১টি অগ্নিকাণ্ড হয় গত এপ্রিলে। সারাদেশে ২০২২ সালে প্রতিদিন গড়ে ৬৬টির বেশি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। চুলা (ইলেকট্রিক, গ্যাস ও মাটির চুলা ইত্যাদি) থেকে ৩ হাজার ৩৬৮টি, বৈদ্যুতিক গোলযোগ থেকে ৯ হাজার ২৭৫টি, বিড়ি-সিগারেটের জ্বলন্ত টুকরা থেকে ৩ হাজার ৮৭৮টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।

প্রতিবছর শুষ্ক মৌসুমে সুন্দরবনেও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগে গত ২০ বছরে আগুন লেগেছে ২৪ বার। এতে ৭১ একর ৬৬ শতাংশ বনভূমির ক্ষতি হয়েছে।

সর্বশেষ গত সপ্তাহে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিনের নির্বাচনী এলাকা মৌলভীবাজারের জুড়ী ও বড়লেখা উপজেলার পাথারিয়া হিলস রিজার্ভ ফরেস্টে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। গতকাল পর্যন্ত ধলছড়ি ও মাকাল জোরায় প্রায় ৪০ হেক্টর বন আগুনে পুড়ে গেছে। বিষয়টি জেনেও বন বিভাগ আগুন নেভানোর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি বলে অভযোগ স্থানীয়দের।

বন বিভাগের বিট কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) মো. নুরুল ইসলাম বলেন, কেউ হয়তো বিড়ি খেয়েছে এখানে। সেখান থেকেই আগুন লাগতে পারে।

সিলেট বন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান তৌফিকুল ইসলাম বলেন, যে কোনো অসাবধানতায় হয়তো এই আগুনের সূত্রপাত হতে পারে। বনকর্মীরা আজ সোমবার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন।

অন্যদিকে গত শুক্রবার রাত ১২টার দিকে রাঙামাটির সাজেকে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। পানি স্বল্পতার সঙ্গে বাতাস থাকায় সেনাবাহিনী ও বিজিবিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে বেগ পেতে হয়।

ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেইন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, বৃষ্টি নেই, প্রকৃতি রুক্ষ হয়ে আছে। এ সময় সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। কর্মস্থলে বা বাসায় আগুন নেভানোর সরঞ্জাম থাকলেও এসবের ব্যবহার জানে না সবাই। অনেকেরই স্বচ্ছ ধারণা নেই আগুন লাগার পর করণীয় বিষয়ে।

ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন বলেন, শুষ্ক মৌসুমে আগুন লাগে বেশি। অগ্নিকাণ্ড কমিয়ে আনতে নিয়মিত অগ্নিমহড়া ও সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করি। সচেতনতা বাড়ানোর মাধ্যমেই অগ্নিকাণ্ড কমে আসবে।’