বঙ্গবন্ধুর 'সোনার বাংলা' গড়ে তোলার অঙ্গীকার বাস্তবায়নে প্রয়োজন ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সকলের মধ্যে ঐক্য। ঐক্য গড়ে তুলতে হবে সাম্প্রদায়িকতা, অগণতান্ত্রিকতা ও সহিংসতার বিরুদ্ধে। রাজনৈতিক দলসমূহকে পরমতসহিষ্ণুতা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে।
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
জনাব স্পিকার
আসসালামু আলাইকুম
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনকালীন একাদশ জাতীয় সংসদের পঞ্চদশ অধিবেশনে উপস্থিত থাকতে পারা আমার জন্য অত্যন্ত আনন্দ ও গৌরবের বিষয়। এ জন্য আমি পরম করুণাময় আল্লাহর নিকট শুকরিয়া আদায় করছি। দেশে-বিদেশে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালনের পাশাপাশি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী 'মুজিববর্ষ' উদযাপনের এ শুভক্ষণে আমি আপনাকে এবং আপনার মাধ্যমে মাননীয় সংসদ সদস্যবৃন্দসহ প্রিয় দেশবাসী ও বিদেশে বসবাসরত সকল প্রবাসীকে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর শুভেচ্ছা ও উষ্ণ অভিনন্দন জ্ঞাপন করছি।
২. আমি গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করছি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করছি সকল বীর মুক্তিযোদ্ধা ও অমর শহীদকে, যাদের অনন্যসাধারণ বীরত্ব ও আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা অর্জন করেছি একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ। আমি কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি জাতীয় চার নেতা- সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী এবং এ এইচ এম কামারুজ্জামানকে; বাঙালির অধিকার আদায়ের সংগ্রামের তিন মহান ব্যক্তিত্ব- শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে; যাদের অবদান আমাদের ইতিহাসে অবিস্মরণীয়।
৩. ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ পৃথিবীর মানচিত্রে 'বাংলাদেশ' নামের একটি নতুন রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটে। এই দিনে বাংলার মানুষ মুক্তি পায় পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক স্বৈরশাসনের চব্বিশ বছরের গ্লানি থেকে।
৪. বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল দারিদ্র্য ও ক্ষুধামুক্ত, দুর্নীতি ও শোষণহীন এক সমৃদ্ধ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে 'বাংলার মানুষের মুক্তি', অর্থাৎ সোনার বাংলা বিনির্মাণ। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে যুদ্ধবিধ্বস্ত নবীন দেশটির প্রতিকূল পরিস্থিতিতে দেশের দায়িত্বভার গ্রহণ করে বঙ্গবন্ধু যখন মানুষের খাদ্যাভাব দূরীকরণ, সামাজিক অস্থিরতা নিরসন ও আইনশৃঙ্খলার উন্নতিতে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন এবং দেশকে পুনর্গঠন করার জন্য বিভিন্ন উন্নয়নমুখী নীতি ও আইন প্রণয়ন করে জাতিকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন, তখনই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করে ঘাতকরা তার সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন স্তব্ধ করে দেয়।
৫. বাংলাদেশ যখন স্বাধীনতা লাভ করে, তখন অনেকেই সদ্য স্বাধীন দেশটির ভবিষ্যৎ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন। প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ অস্টিন রবিনসন 'ইকোনমিক প্রসপেক্টাস অব বাংলাদেশ' গ্রন্থে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎকে 'ম্যালথাসিয়ান স্ট্যাগনেশন'-এর সাথে তুলনা করেন, যার পরিণতি দুর্ভিক্ষ ও মৃত্যু। তৎকালীন মার্কিন সেক্রেটারি অব স্টেট হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ির সাথে তুলনা করেন। কারণ, সে সময় বাংলাদেশের উন্নয়নের পথে অনেক বাধা ছিল; যা অতিক্রম করে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো ছিল খুবই কঠিন। কিন্তু আজ সকল আশঙ্কা ও নেতিবাচক ভবিষ্যদ্বাণী ভুল প্রমাণ করে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত স্বপ্ন বাস্তবায়ন করে চলেছেন তার সুযোগ্য উত্তরসূরি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার বলিষ্ঠ ও দূরদর্শী নেতৃত্বে বাংলাদেশ দ্রুতগতিতে উন্নয়নের পথে অগ্রসরমান।
৬. জাতিসংঘ কর্তৃক ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়। ১৯৭৫-এর পর মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী কর্মকাণ্ড এবং উপযুক্ত নীতি ও কার্যক্রমের অভাবে অর্থনীতিতে তেমন গতি সঞ্চার হয়নি। তবে বিগত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে জাতির পিতার আদর্শের সরকার দায়িত্বে থাকায় তার সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বের ফলে দেশ আজ উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিশ্বে রোল মডেলে পরিণত হয়েছে। জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট-এর নির্ধারিত তিনটি সূচক মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ উন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত ভঙ্গুরতা সূচকের প্রতিটিতে নির্ধারিত স্কোরের বেশি অর্জন করায় ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১ তারিখে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ হতে উত্তরণের চূড়ান্ত সুপারিশ লাভ করে, যা স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অর্জন। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর ক্ষণে দেশের এ সাফল্য জাতির জন্য বয়ে এনেছে এক অভাবনীয় গৌরব। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রাজ্ঞ, দূরদর্শী ও অদম্য নেতৃত্বের জন্য আমাদের এ অর্জন সম্ভব হয়েছে। এ জন্য আমি তাকে আন্তরিক অভিনন্দন ও ধন্যবাদ জানাই।
৭. মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যোগ্য নেতৃত্বে বাংলাদেশ আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নয়ন সাধন করেছে। এখন পৃথিবীর যে ১১টি দেশকে ভবিষ্যৎ উন্নয়নের জন্য 'উদীয়মান এগারো' বলে অভিহিত করা হয়, তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। গত এক দশকে গড়ে ৬ দশমিক ৬ শতাংশ এবং পর পর তিন বছর ৭ শতাংশের ওপর প্রবৃদ্ধি অর্জনের পর বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৮ দশমিক ১৫ শতাংশে উন্নীত হয়। করোনার প্রভাব সত্ত্বেও যে কয়েকটি দেশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে, তাদের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। দেশের অর্থনীতির উল্লেখযোগ্য কাঠামোগত পরিবর্তনের মাধ্যমে কৃষিপ্রধান দেশ এখন আধুনিক অর্থনীতির বৈশিষ্ট্য ধারণ করেছে। অর্থনৈতিক উন্নতির এ ধারাবাহিকতায় বর্তমানে জিডিপিতে কৃষির অবদান মাত্র ১৩ শতাংশ, অন্যদিকে শিল্প ও সেবা খাতের অবদান জিডিপিতে যথাক্রমে ৩৫ ও ৫২ শতাংশ, যা অত্যন্ত আশাপ্রদ। বাংলাদেশ আজ বিশ্বের ৪১তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। ২০৩৫ সাল নাগাদ বাংলাদেশ বিশ্বের ২৫তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশে পরিণত হওয়ার বিষয়ে মন্তব্য করেছে ব্রিটেনের অর্থনৈতিক গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর ইকোনমিক অ্যান্ড বিজনেস রিসার্চ।
৮. বিগত দেড় দশকে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ৫৪৩ মার্কিন ডলার হতে বৃদ্ধি পেয়ে ২ হাজার ৫৫৪ মার্কিন ডলারে এবং জিডিপির আকার ৬ গুণ বৃদ্ধি পেয়ে ৪ লক্ষ ৮২ হাজার কোটি টাকা হতে ২৭ লক্ষ ৯৬ হাজার ৩৭৮ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। রপ্তানি প্রায় ৪ গুণ বৃদ্ধি পেয়ে ১০.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হতে প্রায় ৩৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৭৪৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার হতে আজ ৪৮ হাজার মিলিয়ন মার্কিন ডলারে দাঁড়িয়েছে, যা এযাবৎকালের মধ্যে সর্বোচ্চ। বাজেটের আকার ১০ গুণ বৃদ্ধি পেয়ে ৬১ হাজার ৫৭ কোটি টাকা থেকে ৬ লক্ষ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা হয়েছে। দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ ২ হাজার ৫০৫ কোটি টাকা থেকে ১ লক্ষ ৭ হাজার ৬১৪ কোটি টাকায় বৃদ্ধি করা হয়েছে। এডিপির আকার প্রায় ৯ গুণ বৃদ্ধি পেয়ে ২৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা হতে ২ লক্ষ ২৫ হাজার ৩২৪ কোটি টাকা হয়েছে।
৯. অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশ অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছে এবং কিছু কিছু সূচকে বাংলাদেশ প্রতিবেশী দেশসমূহের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে। এমডিজি অর্জনে ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন বিশেষভাবে শিশুমৃত্যু হ্রাসের কারণে বাংলাদেশ জাতিসংঘ কর্তৃক এমডিজি পুরস্কারে ভূষিত হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার সময় আমাদের গড় আয়ু ছিল ৪৭, এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭২ বছরের ওপরে। প্রাথমিক স্কুলে যাওয়া ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা প্রায় শতভাগ। সাক্ষরতার হার ৭৫ দশমিক ৬ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। শিশু ও মাতৃমৃত্যু হার হ্রাস পেয়েছে। আমাদের উৎপাদিত পোশাক, সিমেন্ট, ওষুধ, ফুল, সবজি, মাছসহ অসংখ্য পণ্য বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। পোশাক রপ্তানিতে এবং ইন্টারনেটভিত্তিক কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বাংলাদেশ আজ বিশ্বে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। কৃষিজমির পরিমাণ ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাওয়া সত্ত্বেও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পাওয়ায় খাদ্য উৎপাদনে আজ আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বের ফলে ২০০৫ সালে যেখানে দারিদ্র্যের হার ছিল ৪০ শতাংশ, সেখানে ২০১৯ সালে দারিদ্র্যের হার ২০.৫ শতাংশে নেমে এসেছে।
১০. জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সোনার বাংলার আধুনিক রূপ ডিজিটাল বাংলাদেশ আজ কোনো স্বপ্ন নয়, বরং বাস্তবতা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্ব এবং ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপকার মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা জনাব সজীব আহমেদ ওয়াজেদের পরামর্শ ও দিকনির্দেশনায় ডিজিটাল বাংলাদেশের বাস্তবায়ন শুধু দেশে নয়, বিশ্বে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। কভিড-১৯ পরিস্থিতিতে যখন গোটা বিশ্ব বিপর্যস্ত, তখন সরকারের বিভিন্ন ডিজিটাল উদ্যোগ মানুষকে দেখিয়েছে নতুন পথ, জুগিয়েছে প্রেরণা। ডিজিটাল বাংলাদেশ কর্মসূচি প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়নে নেতৃত্বদান ও তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষের জীবনমান উন্নয়নে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী 'উইটসা এমিনেন্ট পার্সনস অ্যাওয়ার্ড'-এ ভূষিত হয়েছেন। পাশাপাশি তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ও অবদানের জন্য 'অ্যাসোসিও লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড' অর্জন করেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব আহমেদ ওয়াজেদ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং তার সুযোগ্য পুত্রের এ অর্জন বিশ্বে বাংলাদেশের মর্যাদা আরও বৃদ্ধি করেছে।
১১. দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশন, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন এবং তথ্য কমিশন সক্রিয়ভাবে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারসহ চাঞ্চল্যকর অন্যান্য মামলার রায় দ্রুত নিষ্পত্তি করে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। দুর্নীতি, মাদক, জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস ও উগ্রবাদ এবং সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধে সরকারের 'জিরো টলারেন্স' নীতির কারণে দেশে স্বস্তি বিরাজ করছে, যা বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হচ্ছে। সুশাসনের উদ্দেশ্যে প্রতিটি সরকারি প্রতিষ্ঠানকে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির আওতায় আনার লক্ষ্যে বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি, অভিযোগ প্রতিকার ব্যবস্থাপনা, সিটিজেনস চার্টার এবং শুদ্ধাচার কৌশল বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। সুশাসন প্রতিষ্ঠায় দল-মত নির্বিশেষে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, সুশীল সমাজ এবং অংশীজনদের সমন্বিতভাবে কাজ করে যেতে হবে।
১২. পরিবেশ সুরক্ষা, দূষণ নিয়ন্ত্রণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাংলাদেশের বলিষ্ঠ ভূমিকা আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও স্বীকৃত। সদ্যসমাপ্ত জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলন কপ২৬-এ ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরাম ও ভি২০-এর সভাপতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মতামত, বক্তব্য ও অবস্থানসহ সার্বিক ভূমিকা আন্তর্জাতিক মহলে বহুল আলোচিত ও প্রশংসিত হয়েছে। পরিবেশ সুরক্ষা, দূষণ নিয়ন্ত্রণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা-সংক্রান্ত মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সুনির্দিষ্ট চারটি প্রস্তাব সম্মেলনে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছে। জলবায়ু পরিবর্তনরোধে 'জলবায়ু দুর্বলতাসমূহকে' 'জলবায়ু সমৃদ্ধি'তে রূপান্তর করতে 'মুজিব ক্লাইমেট প্রসপারিটি প্ল্যান' গ্রহণ করা হয়েছে।
১৩. জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে বলেছিলেন, 'সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না।' কভিড-১৯ মহামারি আমাদের উন্নয়ন ও অগ্রগতির ধারাকে সাময়িকভাবে বাধাগ্রস্ত করলেও থামিয়ে দিতে পারেনি। সরকারের সময়োচিত ও দূরদর্শী পদক্ষেপের কারণে অনেক উন্নত দেশের তুলনায় বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণ এবং সংক্রমণজনিত মৃত্যুর হার অপেক্ষাকৃত কম। ইতোমধ্যে ৪ কোটি ৫৫ লক্ষ ৯১ হাজার ৫৭৮ জনকে টিকার আওতায় আনা হয়েছে। করোনার সংকট মোকাবিলায় অর্থনীতিকে দ্রুত পুনর্গঠন এবং এর গতি পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে সরকার ২৮টি প্যাকেজের আওতায় ১ লক্ষ ৮৭ হাজার ৬৭৯ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন করছে। এসব প্রণোদনা প্যাকেজের বাস্তবায়ন কর্মসৃজন ও কর্মসুরক্ষা, অভ্যন্তরীণ চাহিদা সৃষ্টি এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সচল রাখায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। রপ্তানিমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠানসমূহের শ্রমিক-কর্মচারীর বেতন-ভাতা প্রদান সহায়তাসহ স্বল্প সুদে বিভিন্ন প্রকার সুবিধা প্রদান করায় বৃহৎ এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পপ্রতিষ্ঠানসমূহ দ্রুত উৎপাদনে ফিরতে সক্ষম হয়েছে। ফলে দেশের রপ্তানি পূর্বের গতি ফিরে পেয়েছে। করোনাকালীন বিনামূল্যে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ, ওএমএস কার্যক্রম এবং নগদ অর্থ বিতরণ ইত্যাদি নানামুখী জনকল্যাণকর কার্যক্রমের মাধ্যমে দেশের একটি মানুষও না খেয়ে থাকেনি।
১৪. জাতি হিসেবে আমরা এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত অতিক্রম করছি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীর সোপান বেয়ে আমরা পৌঁছে গিয়েছি স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর স্বর্ণতোরণে। সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে স্বপ্নের পদ্মা সেতুর নির্মাণ এখন সমাপ্তির পথে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃঢ় মনোবল, বলিষ্ঠ নেতৃত্বের কারণে 'পদ্মা সেতু' বাস্তবায়ন হয়েছে। এ সেতুর বাস্তবায়ন জাতি হিসেবে আমাদের স্বকীয়তা, সম্পদ ব্যবস্থাপনা, স্বচ্ছতা, সক্ষমতা, জবাবদিহি, দক্ষতা এবং আত্মবিশ্বাসের প্রতীকস্বরূপ মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর সাহস দিয়েছে। পদ্মা সেতুর নেগোসিয়েশনের পর অন্যান্য মেগা প্রকল্পে নেগোসিয়েশন দক্ষতার সাথে সম্পন্ন হয়েছে। চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বহু লেন টানেলের দ্বিতীয় টানেলের নির্মাণকাজ সমাপ্ত হয়েছে। সমগ্র দেশে রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। ডিসেম্বর ২০২২ সালে বিজয় দিবসের উপহার হিসেবে দেশের জনগণ প্রথম মেট্রো রেলে চলাচল করতে পারবে। ৫৭তম দেশ হিসেবে বাংলাদেশ মহাকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট সফলভাবে উৎক্ষেপণ করেছে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে। বাংলাদেশের প্রতিটি ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। এমডিজির সাফল্যের ধারাবাহিকতায় ২০১৫ হতে ২০২০ সাল পর্যন্ত এসডিজির বিভিন্ন সূচকে অনন্য অগ্রগতির স্বীকৃতিস্বরূপ সম্প্রতি বাংলাদেশ 'এসডিজি প্রোগ্রেস অ্যাওয়ার্ড'-এ ভূষিত হয়। এ সম্মান বাংলাদেশের, এ সম্মান সমগ্র জাতির।
১৫. আমাদের জাতীয় জীবনের সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল ঘটনা রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন। ২৬ মার্চ ২০২১ থেকে ২৫ মার্চ ২০২২ পর্যন্ত স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী যথাযোগ্য মর্যাদায় উদযাপনে সকল মন্ত্রণালয় ও বিভাগ এবং এর আওতাধীন দপ্তর ও সংস্থাসহ বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা ব্যাপক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে চলেছে। ১৭ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর ২০২১ পর্যন্ত চলমান মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর সম্মিলিত অনুষ্ঠানে যোগ দিতে বাংলাদেশ সফর করেন মালদ্বীপের রাষ্ট্রপতি ইব্রাহিম মোহামেদ সোলিহ, শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দ রাজাপক্ষ, নেপালের রাষ্ট্রপতি বিদ্যা দেবী ভাণ্ডারী, ভুটানের প্রধানমন্ত্রী ড. লোটে শেরিং এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে যুক্তরাজ্যের রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ, যুক্তরাষ্ট্র, চীন এবং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট, কানাডা, যুক্তরাজ্য ও জাপানের প্রধানমন্ত্রী, পোপ ফ্রান্সিস, জাতিসংঘের মহাসচিবসহ বৈশ্বিক নেতারা অভিনন্দন বার্তা পাঠান এবং বাংলাদেশের অগ্রগতির প্রশংসা করেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ইউনেস্কো কর্তৃক প্রবর্তিত 'ইউনেস্কো-বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ইন্টারন্যাশনাল প্রাইজ ফর দ্য ক্রিয়েটিভ ইকোনমি'র আওতায় প্রথমবারের মতো উগান্ডার মোটিভ ক্রিয়েশন নামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে পুরস্কৃত করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর নামে এ আন্তর্জাতিক পুরস্কার প্রবর্তন জাতি হিসেবে আমাদের আরেকটি অসাধারণ প্রাপ্তি।
১৬. জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন 'উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ' গড়ার প্রত্যয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার 'রূপকল্প ২০২১'-এর সার্থক বাস্তবায়ন শেষে 'রূপকল্প ২০৪১' বাস্তবায়ন করছে। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার সফল সমাপ্তিতে গৃহীত হয়েছে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ২০২১-২০২৫। দেশের পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা, জলবায়ু পরিবর্তন এবং পরিবেশগত বিবর্তনাধীন বিষয়সমূহ বিবেচনা করে প্রণীত হয়েছে দীর্ঘমেয়াদি 'বাংলাদেশ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০'। এর প্রেক্ষাপটে ২০৩১ সালের মধ্যে চরম দারিদ্র্যের অবসান ও উচ্চ-মধ্য আয়ের দেশ হিসেবে উত্তরণ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে দারিদ্র্যের অবলুপ্তিসহ উচ্চ আয়ের দেশের মর্যাদায় আসীন হওয়ার লক্ষ্যে সরকার নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। এ লক্ষ্য বাস্তবায়নে ২০২১-২০৪১ মেয়াদে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৯ শতাংশে উন্নীত করা প্রয়োজন। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে উত্তরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য আমাদের প্রয়োজন চতুর্থ শিল্পবিপ্লবকে কাজে লাগিয়ে দেশের উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখা। সেই সাথে নিশ্চিত করতে হবে পুষ্টি ও খাদ্য নিরাপত্তা, ব্যাপক শিল্পায়ন, অর্থনীতি সুসংহতকরণ, সুষ্ঠু অবকাঠামো এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলাসহ মেধাভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণ। এ লক্ষ্যে সকলকে নিরলসভাবে কাজ করে যেতে হবে।
জনাব স্পিকার
১৭. বঙ্গবন্ধুর 'সোনার বাংলা' গড়ে তোলার অঙ্গীকার বাস্তবায়নে প্রয়োজন ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সকলের মধ্যে ঐক্য। ঐক্য গড়ে তুলতে হবে সাম্প্রদায়িকতা, অগণতান্ত্রিকতা ও সহিংসতার বিরুদ্ধে। রাজনৈতিক দলসমূহকে পরমতসহিষ্ণুতা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। আসুন, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে আমরা দল-মত-পথের পার্থক্য ভুলে, ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে জাতির গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা ও দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার মধ্য দিয়ে লাখো শহীদের রক্তের ঋণ পরিশোধ করি।
আপনাদের সবাইকে আমি আবারও আন্তরিক ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা জানাই। আল্লাহ হাফেজ
জয় বাংলা
বাংলাদেশ চিরজীবী হোক।
ঈষৎ সংক্ষেপিত