জাতীয় সংসদের কার্যক্রমে সংরক্ষিত আসনের সদস্যরা ব্যাপক সক্রিয়। সংসদ অধিবেশনেও থাকে তাদের সরব উপস্থিতি। প্রশ্নোত্তর ও বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনায় নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের (এমপি) মতোই সুযোগ পান তারা। কিন্তু সংসদের বাইরে তারা একেবারেই নিষ্প্রভ। তাদের কোনো ক্ষমতা নেই। কাজ করার সুযোগ নেই। নির্বাচনী এলাকায় সাধারণ আসনের এমপি এবং একই দলের সংরক্ষিত আসনের এমপিদের মধ্যে রয়েছে বৈরী সম্পর্ক। এলাকায় নির্বাচিত এমপিদের প্রভাব বেশি থাকায় সংরক্ষিত আসনের এমপিরা কোণঠাসা থাকেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারা এলাকার কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে গিয়ে সরাসরি নির্বাচিত এমপিদের অসহযোগিতার মুখোমুখি হন। সাধারণ আসনের নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নে থোক বরাদ্দ পেলেও সংরক্ষিত আসনের সদস্যরা তা পান না। এলাকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষা কমিটিতেও সংরক্ষিত এমপিদের অবদান রাখার সুযোগ নেই বললেই চলে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গভর্নিং কমিটির প্রধানের দায়িত্বও তারা পান না। ফলে তারা জনগণের জন্যে তেমন কিছুই করতে পারছেন না।

তবে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের মতো সংরক্ষিত আসনের সদস্যরাও এলাকার উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে চান। সামাজিক, অর্থনৈতিক ও উন্নয়নমূলক কাজে নিজেদের সম্পৃক্ত রাখতে চান। বেশি বেশি বরাদ্দ পেতে চান। এ জন্য সম্প্রতি সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভায় প্রস্তাব করেছেন তারা। তবে এতে বাদ সেধেছেন ওই মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তারা। তারা বলেছেন, নারী এমপিদের সরাসরি কোনো উন্নয়নমূলক কাজে অন্তর্ভুক্ত করার বিধান নেই। নারী এমপিরা যুক্তি দিয়ে বলেছেন, সংবিধানে এমন কোনো কথা উল্লেখ নেই।

সভায় দু'পক্ষই নিজ নিজ অবস্থানে অনড় থেকে যুক্তি তুলে ধরে বক্তব্য রাখেন। এতে সভাপতিত্ব করেন কমিটির সভাপতি ও সাবেক মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন। দায়িত্বশীল সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

সংসদীয় কমিটির কার্যবিবরণী সূত্রে জানা যায়, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির ১০ সদস্যের মধ্যে ৫ জন নারী এমপি রয়েছেন। তারা হলেন- বেগম সাগুফতা ইয়াসমীন, বেগম নাসরিন জাহান রত্না, আরোমা দত্ত, শবনম জাহান ও কাজী কানিজ সুলতানা। নির্বাচিত নারী এমপি ছাড়া বাকিরা বিভিন্ন সংসদীয় আসনের জন্য মনোনীত আছেন। সবাই তার অধীন নিজ নির্বাচনী এলাকায় সরকারের যত ধরনের উন্নয়নমূলক কাজ পরিচালিত হয়-সেখানে সম্পৃক্ত হয়ে ভূমিকা রাখতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। তাদের যুক্তি, নির্বাচিত একজন এমপি সম্পৃক্ত হলে তাদের বাধা কোথায়?

সংরক্ষিত নারী এমপিদের উন্নয়নমূলক কাজে সম্পৃক্তের সুযোগ আছে কি নেই, সে সম্পর্কিত তথ্য উপস্থাপনের জন্য গত ২২ মার্চ অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের নীতিমালা সংগ্রহ এবং জাতীয় সংসদ থেকে দায়িত্ব কর্মবণ্টন বিষয়ে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিবকে (প্রশাসন-৩) দায়িত্ব দেওয়া হয়। এ কমিটির সভায় এ-সংক্রান্ত তথ্য উপস্থাপন করে বলা হয়, সরকারের স্থানীয় উন্নয়নমূলক কাজে সংরক্ষিত নারী এমপিদের অন্তর্ভুক্তির সুযোগ নেই।

সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি রাশেদ খান মেনন সভায় বলেন, মন্ত্রণালয়ের সচিবের বক্তব্যে প্রতীয়মান হচ্ছে সংরক্ষিত নারী আসনের এমপিদের মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম বাস্তবায়নের সঙ্গে পৃথকভাবে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে আপাতত কোনো অবকাশ নেই। বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ বিধায় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ বা যেখানেই এ নীতিমালা নিয়ে কাজ হচ্ছে, সেখানে স্থায়ী কমিটির সুপারিশ পাঠিয়ে নীতিমালার মধ্যে কোনো পরিবর্তনের প্রয়োজন হলে তারা সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বা এই স্থায়ী কমিটিতে এসে আলোচনা করবেন।

কমিটির সদস্য ও সংরক্ষিত নারী এমপি বেগম শবনম জাহান বলেন, সংরক্ষিত নারী আসনের সদস্যদের কাজের জন্যই মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে এবং তাদের আসনে সমাজকল্যাণমূলক কাজের অনেক চাহিদা আছে। তাই মন্ত্রণালয়ের সমাজকল্যাণমূলক কাজের সঙ্গে তারা সম্পৃক্ত থাকলে কাজের অনেক অগ্রগতি হবে।

সংরক্ষিত নারী এমপি আরোমা দত্ত বলেন, সমাজকল্যাণের কাজে তাদের অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না সংবিধানে কোথাও তা উল্লেখ নেই।

সংরক্ষিত নারী এমপি কাজী কানিজ সুলতানা বলেন, এই কমিটির ১০ জন সদস্যের অর্ধেক নারী সদস্য রাখার পেছনে নিশ্চয়ই প্রধানমন্ত্রীর কোনো ভাবনা নিহীত আছে। তাই উন্নয়নমূলক কাজে সংরক্ষিত নারী এমপিদের অন্তর্ভুক্তির নিয়ম না থাকলেও অন্তর্ভুক্তি করে নিয়মে পরিণত করা উচিত।

সংরক্ষিত নারী এমপিদের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে নির্বাচিত এমপি বদরুদ্দোজা মো. ফরহাদ হোসেন বলেন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা তৈরি করতে হলে উন্নয়নমূলক কাজের সঙ্গে নারী এমপিকে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন।

এ দাবি শুধু সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সদস্য ও সংরক্ষিত নারী এমপিদের নয়, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটিতে অন্য যারা সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তারাও ওই সব সংসদীয় কমিটিতে এ ইস্যুতে অভিন্ন বক্তব্য রাখছেন বলে সূত্র জানিয়েছে।

সাড়ে তিনশ সদস্যবিশিষ্ট বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত নারী সদস্যের সংখ্যা ৫০ জন। সংবিধান বিশেষজ্ঞ শাহ্‌দীন মালিক বলেন, সংরক্ষিত আসনের সাংসদদের কার্যপরিধির ব্যাপ্তি বা দায়িত্বের বিষয়ে বাংলাদেশের সংবিধানে আলাদাভাবে উল্লেখ নেই। সংবিধানে শুধু বলা আছে সংরক্ষিত আসন থাকতে হবে, সেটির সংখ্যা বিভিন্ন সময়ে পরিবর্তন করা হয়েছে। তবে সংরক্ষিত আসনের সাংসদদের বিষয়ে আলাদা করে কিছু বলা নেই।

নিজেরা করির সভানেত্রী খুশী কবির বলেন, স্থানীয় সরকারের নারী জনপ্রতিনিধিরা যদি সরাসরি নির্বাচিত হতে পারেন, তাহলে জাতীয় সংসদেও নারীরা পারবেন। নারীর নির্বাচনী এলাকা নেই বলেই তারা পরনির্ভরশীল শক্তি হিসেবে রাজনীতিতে তৈরি হচ্ছে। অথচ শাসনতন্ত্র সংশোধন করে যদি নির্বাচনী এলাকা ঢেলে সাজানো যেত তাহলে এতদিনে নারীর জন্য নির্বাচনী এলাকা তৈরি হতো।

তিনি বলেন, প্রতিটি নির্বাচনে অন্ততপক্ষে ৩৩ শতাংশ নারীকে মনোনয়ন দিতে হবে। এ মনোনয়ন যদি কমপক্ষে ৩৩ শতাংশ দেওয়া হতো তাহলে কিন্তু সংরক্ষিত আসনের আলাদাভাবে দরকার হতো না। সংরক্ষিত আসন যদি রাখতেই হয় অবশ্যই নির্বাচন হতে হবে। আমি মনে করি সরাসরি আসনগুলো থেকে ৫০ ভাগ নারীকে মনোনয়ন দেওয়া উচিত। যদি তা না হয় তাহলে ওই ৩৩ শতাংশ অন্তত দেওয়া উচিত।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, সংসদে সংরক্ষিত আসন পদ্ধতি ত্রুটিপূর্ণ। সেখানে যোগ্য নারীরা সুযোগ পান না। আর সংরক্ষিত আসনের এমপিদের অলংকার হিসেবে দেখা হয়। তাদের দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহি কম। কারণ তাদের ভোটারদের মুখোমুখি হতে হয় না। যদি সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে তারা সংসদে যেতেন তাহলে গুণগত মানের পরিবর্তন হতো। উন্নয়ন কর্মকাণ্ডেও তারা অংশ নিতে পারতেন।