- অন্যান্য
- সাঁতার প্রকল্প ডুবুডুবু
সাঁতার প্রকল্প ডুবুডুবু

আঁচল শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্রে সাঁতার প্রশিক্ষণ- সমকাল
দেশে প্রতিদিন পানিতে ডুবে মারা যায় কমপক্ষে ৪০ শিশু। এমন প্রেক্ষাপটে শিশুর সুরক্ষায় ‘সমাজভিত্তিক সমন্বিত শিশু যত্ন কেন্দ্রের মাধ্যমে শিশুদের প্রারম্ভিক বিকাশ ও সুরক্ষা এবং শিশুর সাঁতার সুবিধা প্রদান’ শীর্ষক একটি প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। ২৭১ কোটি ৮২ লাখ টাকার প্রকল্পটি গত বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি একনেকে অনুমোদন হয়। তিন বছরমেয়াদি প্রকল্পের এক বছর পেরিয়ে গেলেও অগ্রগতি শূন্যের কোঠায়। প্রকল্প সহযোগী এনজিও নির্বাচন করা, জনবল নিয়োগসহ প্রস্তুতিমূলক কোনো কাজই শেষ হয়নি। নিয়োগ হয়নি প্রকল্প পরিচালকও। ফলে শিশুর সুরক্ষায় চালু হওয়া প্রকল্পটি নিয়ে তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা। আর এ জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের অবহেলা ও প্রশাসনিক দুর্বলতাকেই দায়ী করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
যা হওয়ার কথা ছিল: মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সার্বিক দিকনির্দেশনায় বাংলাদেশ শিশু একাডেমির কেন্দ্রীয় ও জেলা শাখার তত্ত্বাবধানে দেশের ১৬টি জেলার ৪৫টি উপজেলায় ৮ হাজার শিশু যত্ন কেন্দ্রে অভিজ্ঞ স্থানীয় এবং আঞ্চলিক পর্যায়ের এনজিওদের মাধ্যমে প্রকল্পের কার্যক্রম বাস্তবায়ন করার কথা। ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ডিসেম্বরের মধ্য প্রকল্পের কাজ শেষ হবে। প্রকল্পের ৮০ শতাংশ অর্থায়ন করছে বাংলাদেশ সরকার এবং উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা বহন করবে ২০ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ব্লুমবার্গ ফিলানথ্রপিস এবং যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রতিষ্ঠান রয়্যাল ন্যাশনাল লাইফ বোট ইনস্টিটিউশন কারিগরি ও আর্থিক সহায়তা দেবে।
বেসরকারি সংগঠন সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চের (সিআইপিআরবি) ‘আঁচল দিবাযত্ন কেন্দ্রে’র আদলে প্রকল্পটি পরিচালিত হবে। সরকারের ‘সমাজভিত্তিক সমন্বিত শিশু যত্ন কেন্দ্রের মাধ্যমে শিশুদের প্রারম্ভিক বিকাশ ও সুরক্ষা এবং শিশুর সাঁতার সুবিধা প্রদান’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় এক থেকে পাঁচ বছর বয়সী ২ লাখ শিশুর জন্য প্রকল্প এলাকায় ৮ হাজার সমাজভিত্তিক শিশু যত্ন কেন্দ্র স্থাপন করার কথা। প্রতিটি কেন্দ্রে ২৫ জন শিশুকে ভর্তি করা হবে। সকাল ৯টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত শিশুরা ওই কেন্দ্রে থাকবে। কর্মসংস্থানের সুযোগ পাবেন ১৬ হাজার গ্রামীণ নারী। ১ হাজার ৬০০ স্থানে ৬ থেকে ১০ বছর বয়সী তিন লাখ ৬০ হাজার শিশুকে সাঁতার শেখানোর কথা উল্লেখ রয়েছে প্রকল্পে।
যা হয়েছে: প্রকল্প শুরুর এক বছরেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও ১৬ জেলায় ১৬ জন কর্মকর্তা নিয়োগ ছাড়া আর কিছুই হয়নি। থমকে আছে পুরো কার্যক্রম। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই অর্থবছরের মধ্যে এনজিও নির্বাচন করা কঠিন হবে। কেন্দ্রগুলোতে ১৬ হাজার তত্ত্বাবধায়ক ও সহকারী পরিচর্যাকারী নিয়োগ এবং প্রশিক্ষণেও অনেক সময় চলে যাবে। এতে শিশু সুরক্ষার মূল্য উদ্দেশ্যই বাস্তবায়ন হবে না।
গণমাধ্যম উন্নয়ন ও যোগাযোগবিষয়ক প্রতিষ্ঠান ‘সমষ্টি’ প্রিন্ট মিডিয়া এবং অনলাইন নিউজ পোর্টালে প্রকাশিত পানিতে ডুবে মৃত্যুর তথ্য-উপাত্ত নিয়মিত বিশ্লেষণ করে। সংস্থাটির পরিচালক মীর মাসরুর জামান বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা অসম্ভব বলে মনে হচ্ছে। প্রকল্পের বিলম্বের কারণে অর্থায়ন ও কারিগরি সহায়তা দেওয়া উন্নয়ন সহযোগীরা তাদের সহায়তা প্রত্যাহার করতে পারে। তিনি বলেন, সামনে বর্ষা। এ সময় পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর ঘটনা বেশি ঘটে। ফলে বর্ষার আগে পানিতে ডুবে শিশুর মৃত্যুর বিষয়ে সচেতনতামূলক প্রচারণা চালানোর সুপারিশ করেন তিনি।
২০১২ সাল থেকে ব্লুমবার্গ ফিলানথ্রপিসের আর্থিক সহায়তায় দি সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ (সিআইপিআরবি) কাজ করছে। তাদের ভাসা প্রকল্পের অধীনে সাত উপজেলার ৫১টি ইউনিয়নে ৫৫ হাজার ৭৯০টি শিশু বেষ্টনী (প্লে-পেন) এবং তিন হাজার ২০৫টি ডে-কেয়ার সেন্টার (আঁচল) স্থাপন করা হয়েছে। সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত একজন আঁচল মা (প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নারী) এবং আঁচল সহকারী শিশুদের দেখভাল করেন। সরকারি প্রকল্পটি চালুর পর থেকে ব্লুমবার্গ ভাসা প্রকল্পে অর্থায়ন বন্ধ করে দেয়। পরে সরকারের অনুরোধে ব্লুমবার্গ আগামী মে মাস পর্যন্ত এ প্রকল্পে অর্থায়ন চালু রেখেছে।
কেন থমকে আছে: প্রকল্পটির এখনও স্থায়ী পরিচালক নিয়োগ হয়নি। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব ফেরদৌসী বেগম পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন। প্রকল্পের বিষয়ে বাংলাদেশ শিশু একাডেমির শিশু ও প্রারম্ভিক বিকাশ (ইসিডি) বিষয়ক বিশেষজ্ঞ ও প্রকল্পের পরামর্শক মো. তারিকুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকল্পটি অনুমোদন পাওয়ার পরও মে মাসে মন্ত্রণালয় থেকে আদেশ পাওয়া যায়। ফলে জুলাই থেকে কাজ শুরু করেছি। প্রকল্প সহযোগী এনজিও নির্বাচন করার পর পুরোদমে কাজ শুরু হবে। এখন প্রকল্পটি কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ১৮ মাস সময় পাবে।
তিনি বলেন, গত ফেব্রুয়ারিতে এনজিও নির্বাচনে শর্তাবলির খসড়া তৈরির জন্য একজন ক্রয় বিশেষজ্ঞ নিয়োগ হয়েছে। এনজিও সিলেকশনের জন্য চলতি মাসেই বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হবে। এর পর আগামী জুলাই মাস থেকে এই প্রকল্পের মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়ন ব্যাপকভাবে শুরু করা যাবে। জেলায় নিয়োগ পাওয়া ১৬ কর্মকর্তাকে প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়েছে। এই অর্থবছরের জন্য ১০ কোটি টাকা বরাদ্দ মিলেছে এবং চলতি অর্থবছরে ১ কোটি ৮৭ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। বেশিরভাগ তহবিল চলতি বছরের জুনের মধ্যে নির্বাচিত এনজিওগুলোর মাঝে বিতরণ করা হবে।
গ্লোবাল হেলথ অ্যাডভোকেসি ইনকিউবেটরের বাংলাদেশের সমন্বয়কারী মোহাম্মদ রুহুল কুদ্দুস বলেন, শিশুদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পটির এখন পর্যন্ত প্রত্যাশিত অগ্রগতি হয়নি। প্রকল্পের কাজটি কিছুটা দেরি হলেও আমরা চাই কাজটি সুষ্ঠুভাবে হোক।
বাংলাদেশ শিশু একাডেমির মহাপরিচালক আনজীর লিটন বলেন, আমি নতুন যোগদান করেছি। প্রকল্পটির অগ্রগতি বিষয়ে আমার তেমন কিছু জানা নেই।
মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. হাসানুজ্জামান কল্লোল সমকালকে বলেন, প্রকল্পটির অগ্রগতি একটু কম। কার্যক্রম এগিয়ে নিয়ে যেতে আমরা কিছু পরামর্শ দিয়েছি। বাংলাদেশ শিশু একাডেমি সেই অনুযায়ী কাজ করছে।
মন্তব্য করুন