আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি; জেনারেল নিয়াজি হিসেবে যিনি বেশি পরিচিত– স্বাধীনতাবিরোধী কতিপয় ব্যক্তি বাদ দিলে এ দেশের সবার কাছে একটি ঘৃণিত নাম। পাকিস্তানের মিয়ানওয়ালির এ নিয়াজি গোত্রেরই মানুষ ইমরান খান। পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট আসিফ আলি জারদারি ইমরানের নামকরণ করেছেন ‘ইমরান খান নিয়াজি’। ১৯৭১ সালে নিয়াজির নেতৃত্বে বাঙালির ওপর যে নৃশংসতা চালানো হয়েছে, জারদারি ইমরান খানের নামের শেষে নিয়াজি জুড়ে দিয়ে মূলত তারই প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। বোঝাতে চেয়েছেন, ইমরানের মধ্যেও নৃশংস প্রবণতা থাকতে পারে। ইমরানকে উদ্দেশ করে জারদারির বক্তব্য নিছক রাজনৈতিক। কারণ জারদারি প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন বা আগে-পরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁদের সেনাবাহিনীর বর্বরতা নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেছেন বলে জানা নেই।

সম্প্রতি পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান জামিনে মুক্ত হওয়ার পরদিনই জাতির উদ্দেশে এক ভাষণে দেশটির সেনাবাহিনী তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ১৯৭১ সালে নৃশংসতা চালিয়েছিল বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, ‘পাকিস্তানের এই সংকটময় সময়ে সংবাদমাধ্যম নিয়ন্ত্রিত। পূর্ব পাকিস্তানেও একই ঘটনা ঘটেছিল; মিডিয়া নিয়ন্ত্রিত ছিল। শুধু পার্থক্য হলো, আজ আমাদের সোশ্যাল মিডিয়া আছে। কিন্তু এমনকি তাও ব্লক করা হয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ যে নৃশংসতার শিকার হয়েছিল, তা আজ আমাদের বুঝতে হবে।’

মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশের মানুষ নৃশংসতার শিকার হয়েছিল বলে পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) চেয়ারম্যান ইমরান খান স্বীকার করে নেওয়ার পাশাপাশি এর মর্মার্থ বোঝার জন্য তাঁর দেশের জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। বর্তমানে ইমরান খান রাজনৈতিকভাবে সংকটকাল পার করছেন। দক্ষিণ এশীয় প্রতিবেশী হিসেবে আমাদের প্রত্যাশা– পাকিস্তানে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পাশাপাশি রাজনৈতিক দমনপীড়ন বন্ধ হোক। কিন্তু ’৭১-এর নৃশংসতার জন্য ইমরানের মধ্যে আপাত যে অনুশোচনা দেখা যাচ্ছে, তা কি তাঁর রাষ্ট্রক্ষমতা ফিরে পাওয়ার পরও অব্যাহত থাকবে? ২০১৮ সালের ১৮ আগস্ট ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে ২০২২ সালের ১০ এপ্রিল পাকিস্তান পার্লামেন্টে বিরোধীদের অনাস্থা ভোটে প্রধানমন্ত্রিত্ব হারানোর আগ পর্যন্ত ইমরান কিন্তু ’৭১-এ আমাদের ওপর তাঁদের সেনাবাহিনীর বর্বরতা নিয়ে টুঁ শব্দও করেননি। অন্যদের সমর্থন না পাক, অন্তত একটা নিন্দা প্রস্তাব তো সংসদে আনতে পারতেন এ নিয়ে।

আমরা দেখেছি, ৭১-এর মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে কাদের মোল্লা, নিজামী, মুজাহিদ ও সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের বিরুদ্ধে পাকিস্তান পার্লামেন্টে নিন্দা প্রস্তাব পাস হয়েছিল। জানি, সে সময় ইমরান ক্ষমতায় ছিলেন না। তবে সংসদে প্রভাবশালী একটা দলের নেতৃত্বে ছিলেন; চাইলে ওই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভোট দিতে পারতেন । তখন এমনকি সে দেশে থাকা আমাদের রাষ্ট্রদূতকে তলব পর্যন্ত করা হয়েছিল, যার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশও পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূতকে তলব করে পাল্টা প্রতিবাদ জানিয়েছিল।

যুদ্ধাপরাধীদের অকৃত্রিম বন্ধু বলে আখ্যায়িত করে তৎকালীন নওয়াজ শরীফের নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান সরকার মন্তব্য করেছিল– তারা (যুদ্ধাপরাধী) আইন ও সংবিধান ভঙ্গ করেনি। অথচ এখন ইমরান খান স্বীকার করে নিয়েছেন, ’৭১-এ এ দেশের মানুষ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নৃশংসতার শিকার হয়েছিল। সেই নৃশংসতায় আমাদের দেশের যেসব মানুষ সহায়তা করেছিল, তাদের বিচারের রায় কার্যকরের পর নিন্দা প্রস্তাব পাস করে পাকিস্তান পার্লামেন্ট একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের আইন ও সংবিধানের প্রতি অসম্মান দেখিয়েছিল।

দেরিতে হলেও ইমরান খানের আত্মোপলব্ধি হয়েছে। এখন তিনি প্রতিশ্রুতি দিতে পারেন– তাঁর দল আবার রাষ্ট্রক্ষমতায় গেলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর যেসব সদস্য ’৭১ সালে নৃশংসতা চালিয়েছে, তাদের বিচারের ব্যবস্থা করবেন। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর নিয়াজির নেতৃত্বে আত্মসমর্পণ করা ৯৩ হাজার সেনা সদস্যের যারা জীবিত এবং নৃশংসতার সঙ্গে জড়িত ছিল, তাদের বিচার করতে পারলে জাতি হিসেবে পাকিস্তানের কলঙ্ক কিছুটা হলেও হালকা হবে।

মিজান শাজাহান: সহ-সম্পাদক, সমকাল
mizanshajahan@gmail.com