ঢাকা বুধবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৫

রেলে অর্থ খরচের স্বচ্ছতায় কোপ

রেলে অর্থ খরচের স্বচ্ছতায় কোপ

ছবি: ফাইল

রাজীব আহাম্মদ

প্রকাশ: ২৯ জুলাই ২০২২ | ১২:০০

টাকা খরচের স্বচ্ছতায় কোপ দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে রেলওয়ে। দেড়শ বছরের বেশি সময় ধরে চলা রীতির ব্যত্যয় ঘটিয়ে স্বাধীন হিসাব বিভাগকে রেলের অধীন করা হয়েছে। এতে টাকা খরচ ও হিসাব দুই-ই রেলের নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে। রেল যেভাবে চাইবে, সেভাবেই হিসাব হবে।

সংশ্নিষ্টরা বলছেন, কোনো সরকারি দপ্তরে এমন নজির নেই। হিসাব বিভাগ রেলের অধীন হলে দুর্নীতি ও অপব্যয় বাড়বে। এর আগে এটা মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের (সিএজি) অধীন ছিল। হিসাব বিভাগকে রেলের অধীন করার চেষ্টাকে 'আর্থিক শৃঙ্খলার পরিপন্থি' বলে মন্তব্য করেছে সিএজির কার্যালয়। যেমন, চলতি অর্থবছরে রেলওয়ের বাজেট ১৭ হাজার ৫৪২ কোটি টাকা। সরকারি এ বরাদ্দ সরাসরি খরচ করতে পারবে না রেলওয়ে। রেলের অর্থ ও হিসাবকে জানাতে হয় কেন, কীভাবে, কত টাকা খরচ হবে। হিসাব বিভাগ প্রাক-নিরীক্ষা (প্রি-অডিট) করে রেলের আর্থিক দাবি (বিল) মেটাতে টাকা দেবে। অসংগতি থাকলে বিল কাটছাঁট করবে। অনিয়ম ঠেকাতে এ 'চেক অ্যান্ড ব্যালেন্সেস' বা ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষার ব্যবস্থা সেই ১৮৫৮ সাল থেকেই সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো মেনে চলছে।

হিসাব বিভাগ রেলেরই অংশ; কিন্তু তাদের অধীন নয়। ফলে হিসাব বিভাগের ওপর রেলের খবরদারি চলে না। হিসাব বিভাগের কর্মকর্তারা অডিট ক্যাডারের। তাঁরা সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান সিএজির অধীন। সরকারি নিয়ম মেনে আর্থিক স্বচ্ছতা রক্ষায় ব্যয়কারী বা প্রশাসনিক নির্বাহীর কাছে টাকা রাখা হয় না। যে বিভাগের কাছে টাকা থাকে, তাদের খরচের এখতিয়ার নেই। এ কারণে সরকারের কোনো প্রতিষ্ঠান নিজের হিসাব নিজে করে না। তা সিএজির অধীন অডিট ক্যাডারের কাজ।

কিন্তু নতুন জনবল কাঠামোতে হিসাব বিভাগকে নিজেদের অধীনে নিয়েছে রেলওয়ে। সিএজি থেকে বদলির পরিবর্তে প্রেষণে অডিট কর্মকর্তাদের হিসাব বিভাগে চায় রেল। সংশোধিত জনবল কাঠামোতে রেল ক্যাডারের কর্মকর্তাদেরও হিসাব বিভাগে বদলির সুযোগ রাখা হয়েছে। হিসাব বিভাগের অফিসের সংখ্যা কমেছে। এতে পে-পয়েন্ট বন্ধ হওয়ায়, আগামী মাসে রেলকর্মীদের বেতন নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে।

হিসাব বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, রেলে সরকারি টাকার ব্যয় ঠিকভাবে হচ্ছে কিনা- তা দেখা তাঁদের কাজ। রেলের অধীনে যাওয়া মানে, 'চেক অ্যান্ড ব্যালেন্সেস' থাকবে না। বদলি, পদায়ন ও বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদন (এসিআর) লেখার ক্ষমতা রেলের কাছে গেলে হিসাব বিভাগের কর্মকর্তারা তাদের মুখাপেক্ষী হয়ে পড়বেন। এ অবস্থায় চাকরি 'ঠিক রাখতে' রেলের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের ইচ্ছায় টাকা ছাড় ও বিল-ভাউচার অনুমোদনে বাধ্য হবেন তাঁরা।

১৯৮০ সালে সিভিল, সশস্ত্র ও রেলওয়ে অডিটকে একীভূত করে অডিট অ্যান্ড অ্যাকাউন্টস ক্যাডার গঠিত হয়। অন্য সব ক্যাডার সংশ্নিষ্ট মন্ত্রণালয়ের অধীন হলেও অডিট ক্যাডার সিএজির নিয়ন্ত্রণে। অর্থ মন্ত্রণালয়ও তাদের কাছে জবাবদিহি করে। সংবিধানের ১২৮ (৪) অনুচ্ছেদ সরকারি হিসাব ও সম্পদ নিরীক্ষা স্বচ্ছতার স্বার্থে সিএজিকে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণমুক্ত করে স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে।

রেলের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অর্থ) পদটি অডিট ক্যাডার দ্বারা পূরণযোগ্য। তিনি হিসাব বিভাগের প্রধান। তাঁর দপ্তরের যুগ্ম মহাপরিচালক, পরিচালকসহ নবম গ্রেড পর্যন্ত সব পদ অডিট ক্যাডারের জন্য সংরক্ষিত। রেলের দুই অঞ্চলের অর্থ উপদেষ্টা ও প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা এবং তাঁদের কার্যালয়ের নবম গ্রেড পর্যন্ত কর্মকর্তাদের পদও অডিট ক্যাডারের জন্য সংরক্ষিত। সিএজি কার্যালয় তাদের বদলি করে রেলের হিসাব বিভাগে পদায়ন করে। এতে রেলের হাত ছিল না এতদিন।

গত বছরের ১৩ সেপ্টেম্বর কার্যকর সংশোধিত জনবল কাঠামোতে এ পরিবর্তন এনেছে রেল। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদিত এ কাঠামোতে দ্বিতীয় থেকে ২০ গ্রেড পর্যন্ত সব কর্মকর্তা-কর্মচারীকে রেলের মহাপরিচালকের (ডিজি) অধীনে আনা হয়েছে। গত ২৫ মে ডিজির দপ্তরের আদেশে আরও বলা হয়, হিসাব বিভাগের ১০ থেকে ২০তম গ্রেডের কর্মচারীদের পদোন্নতি, বদলি ডিজির অনুমোদনে রেলের পার্সোনেল শাখার মাধ্যমে হবে।

গত ১৩ জুন রেলের পরিচালক (অর্থ) সোহেল আহমেদ স্বাক্ষরিত চিঠি যায় রেলের ডিজি ধীরেন্দ্রনাথ মজুমদারের কার্যালয়ে। এতে বলা হয়, হিসাব বিভাগের দ্বিতীয় থেকে নবম গ্রেডের কর্মকর্তারা রেল নয়, সিএজির অধীন। এ বিভাগের ২০ গ্রেড পর্যন্ত কর্মচারীদের প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ অর্থ উপদেষ্টা ও প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তার কাছে। টাকা পরিশোধ ও হিসাবের জনবল যদি ব্যয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত নির্বাহীর অধীন হয়, তাহলে স্বার্থের সংঘাত সৃষ্টির শঙ্কা রয়েছে।

গত ২৯ জুন রেলের পরিচালক (পার্সোনেল) আবিদুর রহমান স্বাক্ষরিত চিঠিতে অতিরিক্ত মহাপরিচালককে (অর্থ) বলা হয়, হিসাব শাখা রেলেরই একটি বিভাগ। রেল তাদের বেতন-ভাতা দেয়। অর্থ মন্ত্রণালয়ের ২০১১ সালের ১৯ জানুয়ারির চিঠির বরাতে বলা হয়েছে, হিসাব বিভাগ রেলেরই আওতাধীন স্বতন্ত্র বিভাগ।

এ চিঠিতে বলা হয়, নতুন জনবল কাঠামো হয়নি। পুরোনো কাঠামো সংস্কার হয়েছে। জনবল ৮২ হাজার ৮৯২ থেকে কমিয়ে ৪৭ হাজার ৬৩৭ করা হয়েছে। এতে অডিট ক্যাডারের পৃথক জনবল কাঠামো রাখা হয়েছে। এর সঙ্গে রেলের সম্পৃক্ততার সুযোগ নেই এবং এই জনবলের নিয়ন্ত্রণ সংস্থা প্রধান হিসেবে রেলের মহাপরিচালকের। অর্থ মন্ত্রণালয় ভেটিং করে হিসাব বিভাগের পদসহ ৪৭ হাজার ৬৩৭টি পদ অনুমোদন করেছে। কোনোভাবেই হিসাব বিভাগের পদ অডিট ক্যাডারের পদ বলে দাবির সুযোগ নেই।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের ২০১২ সালের ৭ মের চিঠির বরাতে গত ৬ জুলাই রেল ডিজিকে চিঠিতে হিসাব বিভাগ জানায়, লাইন অব বিজনেস অনুযায়ী অতিরিক্ত মহাপরিচালকসহ (অর্থ) অডিট ক্যাডারের কর্মকর্তাদের নিয়ন্ত্রণ, বদলি, পদায়ন ও এসিআর লেখা রেলের মহাপরিচালকের অধীন করার সুযোগ নেই। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতে ব্রিটিশ আমল থেকে রেলের প্রশাসন থেকে হিসাব বিভাগকে পৃথক রেখে স্বকীয় ও স্বাধীন রাখা হয়েছে। ১৯৮০ সালের ক্যাডার কম্পোজিশন তপশিল অনুযায়ী, রেলের হিসাব বিভাগের পদ অডিট ক্যাডারে অন্তর্ভুক্ত। এটি সিএজির সাংগঠনিক কাঠামোতে অন্তর্ভুক্ত।

নতুন জনবল কাঠামোতে, হিসাব বিভাগে দ্বিতীয় গ্রেডের অতিরিক্ত মহাপরিচালক থেকে নবম গ্রেডের সহকারী পরিচালক পদ পর্যন্ত প্রেষণে পদায়নের কথা বলা হয়েছে। তৃতীয় গ্রেডের অর্থ উপদেষ্টা থেকে নবম গ্রেডের হিসাব কর্মকর্তা পর্যন্ত নির্দিষ্টভাবে অডিট ক্যাডার থেকে প্রেষণের পদায়নের নিয়ম রাখা হয়েছে। তবে রেলের নিয়োগবিধিতে অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অর্থ) পদ অডিট ক্যাডার থেকে প্রেষণ এবং রেল ক্যাডার থেকে বদলির মাধ্যমে পূরণের সুযোগ রাখা হয়েছে। যুগ্ম মহাপরিচালকসহ পদ একই পদ্ধতিতে পূরণের কথা বলা হয়েছে।

হিসাব বিভাগের একজন উপ-অর্থ উপদেষ্টা (ডিএফএ) সমকালকে বলেছেন, এটিই সবচেয়ে বিপজ্জনক প্রস্তাব। রেল ক্যাডারের দ্বিতীয় গ্রেডের কর্মকর্তাকে বদলির মাধ্যমে দায়িত্ব দিলে হিসাব বিভাগের স্বাধীনতাই থাকবে না। রেলের দাবি মেনে গোঁজামিলের হিসাব হবে। প্রেষণে অডিটের কেউ এলে তাঁকে রেল কর্তৃপক্ষের নির্দেশে চলতে হবে।

এই কর্মকর্তা জানান, অনেক সময় রেলে বিল-ভাউচার পাঠিয়ে প্রি-অডিট ছাড়াই টাকা ছাড়ের চাপ থাকে। রেলের অধীন না হওয়ায় অডিট ক্যাডার তা এড়াতে পারে। কিন্তু প্রেষণে বা রেল কর্মকর্তারা বদলি হয়ে হিসাব বিভাগে এলে, চাকরির স্বার্থে চাপ এড়াতে পারবেন না। নয়তো ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এসিআর খারাপ করে দেবে।

অর্থ মন্ত্রণালয় ২০১২ সালেই প্রেষণে নিয়োগ প্রস্তাব নাকচ করেছিল। ওই বছরের ৭ মের চিঠিতে বলা হয়েছে, অডিট ক্যাডার কর্মকর্তাদের রেলওয়ে মহাপরিচালকের অধীনে প্রেষণে নিয়োগ সার্ভিস রুল ও মৌলিক নীতির পরিপন্থি। তাছাড়া প্রেষণ ভাতার কারণে ব্যয়ও বাড়বে।

গত ২৯ জুন রেলের পার্সোনেল বিভাগের চিঠিতে বলা হয়েছে, ভূসম্পত্তি বিভাগে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা পদায়িত হন। তাঁরা মহাপরিচালক, বিভাগীয় রেল ব্যবস্থাপকের (ডিআরএম) অধীনে কাজ করেন। পরিচালক (অর্থ) সোহেল আহমেদ বলেছেন, হিসাব বিভাগের কাজের ধরনই আলাদা। কারও অধীনে থাকলে আর্থিক স্বচ্ছতা থাকবে না।

হিসাব বিভাগের একজন উপ-অর্থ উপদেষ্টা সমকালকে বলেছেন, তাঁর কাজ ডিআরএমের দপ্তরের আর্থিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা। তাঁকে যদি ডিআরএমের অধীন করা হয়, তাহলে তা সম্ভব হবে না। এসব অভিযোগের বিষয়ে রেল ডিজির বক্তব্য নেওয়ার চেষ্টা করেও জানতে পারেনি সমকাল।

নতুন জনবল কাঠামোতে অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অর্থ) এবং দুই প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তার কার্যালয় থাকলেও হিসাব বিভাগের বাকি অফিস (পে-পয়েন্ট) বিলুপ্ত হয়েছে। পে-পয়েন্ট থেকে বেতন হয় রেলের কর্মকর্তা, কর্মচারীদের। ওই ডিএফএ সমকালকে জানান, তাঁর অফিসই নেই। বেতন দেবেন কী করে?

সিএজির কার্যালয়কে না জানিয়ে নতুন জনবল কাঠামো রয়েছে। এ বিষয়ে মহাহিসাব নিরীক্ষক মুসলিম চৌধুরী কোনো মন্তব্য করতে চাননি। মঙ্গলবার তাঁর সঙ্গে বৈঠক করেছেন রেল সচিব ড. হুমায়ুন কবীর। একই দিন অর্থ সচিবের সঙ্গেও বৈঠক করেন তিনি।

এদিকে হিসাব বিভাগকে অধীন করার চেষ্টাকে আর্থিক শৃঙ্খলা পরিপন্থি বলে আখ্যা দিয়েছে সিএজির কার্যালয়। ২৪ জুলাই ডেপুটি সিএজি মাহবুবুল হক চিঠিতে রেল সচিবকে বলেছেন, চলতি বছরে রেল পরিচালনায় ৩ হাজার ৮৬৬ এবং উন্নয়নে ১৪ হাজার ৯২৮ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে। রেলে বরাদ্দ বৃদ্ধির সঙ্গে আর্থিক ব্যবস্থাপনার ঝুঁকিও বাড়ছে। এত টাকা জনগণের সেবায় লাগছে কিনা তার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা জরুরি।

চিঠিতে বলা হয়েছে, স্বার্থের সংঘাত পরিহারে ঐতিহাসিকভাবেই রেলসহ সব নির্বাহী বিভাগ থেকে হিসাব বিভাগকে স্বতন্ত্র রাখা হয়েছে। প্রতিরক্ষা বিভাগের জন্যও একই নিয়ম অনুসরণ করা হয়। আর্থিক দাবির বৈধতা যাচাই করে পরিশোধ করে হিসাব বিভাগ। কিন্তু হিসাব বিভাগকে রেলের অধীন করার উদ্যোগ ১৯৯৬ সালের রুল অব বিজনেসের ব্যত্যয়। বিধিগত ব্যবস্থা উপেক্ষা করে রেল মহাপরিচালকের এ ধরনের উদ্যোগ অনাকাঙ্ক্ষিত, অপ্রত্যাশিত, আর্থিক ব্যবস্থাপনার জন্য ক্ষতিকর ও ঝুঁকিপূর্ণ। হিসাব বিভাগকে এ বিষয়ে আর চিঠি না পাঠাতে রেল ডিজির দপ্তর যে অনুরোধ করেছে, তা শিষ্টাচারবহির্ভূত। এটা হিসাব বিভাগের নিরপেক্ষতায় বিরূপ প্রভাব ফেলবে। ফলে তা সরকারকে বিব্রত করতে পারে।

রেল সচিব সমকালকে বলেছেন, হিসাব শাখা সমস্যা জানিয়েছে। সমাধানে কাজ করছেন। সবার ওপরে সংবিধান। সেভাবেই সমস্যার সমাধান হবে। একজন আরেকজনকে অধীনে নেওয়ার চেষ্টা সমাধান নয়। যার যা কাজ, তাই করা উচিত। আগামী মাসে রেলে বেতন না হওয়ার আশঙ্কার বিষয়ে হুমায়ুন কবীর বলেন, এর আগেই সমাধান হবে।

আরও পড়ুন

×