আইন পাসের আগে অংশীজনের মতামত নেওয়ার তাগিদ

রাজধানীর তেজগাঁওয়ের সমকাল কার্যালয়ে বুধবার 'সমতলের আদিবাসী ও দলিত জনগোষ্ঠীর অধিকারভিত্তিক উন্নয়নে করণীয়' শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে আয়োজকদের সঙ্গে অতিথিরা সমকাল
সমকাল প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২৪ আগস্ট ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ২৫ আগস্ট ২০২২ | ০১:০২
রাজধানীতে এক গোলটেবিল বৈঠকে অবিলম্বে সমতলের আদিবাসী ও দলিত জনগোষ্ঠীর অধিকার আদায়ে বৈষম্য বিলোপ আইন প্রণয়নের দাবি জানিয়েছেন আলোচকরা। একই সঙ্গে সংসদে পাসের আগে আইনটি পুনর্মূল্যায়ন ও সংশ্নিষ্ট অংশীজনের মতামত গ্রহণেরও আহ্বান জানিয়েছেন তাঁরা। পার্বত্য অঞ্চলের মতো সমতলের আদিবাসীদের জন্য একটি পৃথক ভূমি কমিশন গঠন, রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী ইশতেহারে অঙ্গীকার ও বাস্তবায়ন, বৈষম্য দূরে সামাজিক মন-মানসিকতার পরিবর্তনের ওপর জোর দিয়েছেন তাঁরা। বক্তারা শিক্ষা ও ধর্ম-সংক্রান্ত বিশেষ উদ্যোগ, আত্মপরিচয়ের স্বীকৃতি, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাসহ দাবি আদায়ে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রস্তাব করেছেন।
গতকাল বুধবার সমকালের আয়োজনে সর্বদলীয় সংসদীয় গ্রুপ এবং হেকস/ইপার বাংলাদেশের সহযোগিতায় এ গোলটেবিল বৈঠক হয়। সমকালের তেজগাঁও কার্যালয়ে 'সমতলের আদিবাসী ও দলিত জনগোষ্ঠীর অধিকারভিত্তিক উন্নয়ন সুনিশ্চিতে করণীয়' শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা আরও বলেন, আদিবাসীদের অধিকার আদায়ে একটি অ্যাকশন প্ল্যান তৈরি করতে হবে। সংবিধানে তাদের অধিকার ও আত্মপরিচয়ের স্বীকৃতি দিতে হবে। বৈঠকে একাধিক এমপি, মানবাধিকার কর্মী, এনজিও ব্যক্তিত্ব, বিভিন্ন আদিবাসী সংগঠনের নেতা ও সিনিয়র সাংবাদিকরা বক্তব্য দেন।
বৈঠকে পাহাড় ও সমতলের আদিবাসীদের দীর্ঘদিনের বঞ্চনা, অন্যায় ও তাদের ওপর অবিচারের নানা চিত্র তুলে ধরা হয়। সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় বৈষম্য থেকে পরিত্রাণের উপায় নিয়েও বৈঠকে আলোচনা করা হয়। অনেকে এ নিয়ে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব তুলে ধরেছেন। তাঁরা বলেছেন, আদিবাসীদের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠা, তাঁদের উন্নয়ন ও নিজস্ব পরিচয়ের স্বীকৃতি দিতে সরকারকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। সংবিধানে তাঁদের অধিকার ও আত্মপরিচয়ের স্বীকৃতি দিতে হবে।
বৈঠকে স্বাগত বক্তব্য দেন সমকালের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মোজাম্মেল হোসেন। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সমকালের চিফ রিপোর্টার লোটন একরাম। সভার শুরুতে ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সপরিবারে নৃশংস হত্যার ঘটনা ও সাবেক নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারের মৃত্যুতে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।
অংশগ্রহণকারীদের স্বাগত জানিয়ে মোজাম্মেল হেসেন বলেন, মানুষে মানুষে পার্থক্য স্বাভাবিক হলেও বৈষম্য স্বাভাবিক নয়। অধিকার, সুযোগ-সুবিধা ও ধনসম্পদের বৈষম্য দূর করে মানুষ সাম্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আমাদের সংবিধান, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদ প্রভৃতি সকল মানুষের সমান সুযোগের কথা বলে। নানারকম বৈষম্যের মধ্যে আমাদের দেশে যে দলিত সম্প্রদায়, উপজাতীয় ও ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বাগুলি বেশি পিছিয়ে আছে, তীব্র বঞ্চনার শিকার, সে-বিষয়ে হাল পরিস্থিতি ও আইনগত বিষয় নিয়ে এখানে আলোচনা হবে।
দলিত ও সমতলের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সম্পর্কিত সর্বদলীয় সংসদীয় গ্রুপের সদস্য বদরুদ্দোজা মো. ফরহাদ এমপি তাঁর আলোচনায় বলেন, একটি দেশে উন্নয়ন হলে বৈষম্যও হয়। এ ক্ষেত্রে বৈষম্য কতটুকু কম হবে, সেদিকে লক্ষ্য রাখা জরুরি। তিনি বলেন, দেশে আদিবাসীর সংখ্যা কমেনি, বরং আগের তুলনায় কিছুটা বেড়েছে। সংবিধানে সব নাগরিকের সমান অধিকারের কথা বলা হয়েছে। আদিবাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় বর্ণবৈষম্যহীন আইনটি প্রণয়ন হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
সর্বদলীয় সংসদীয় গ্রুপের সদস্য আহমেদ ফিরোজ কবির এমপি বলেন, সমতাভিত্তিক সমাজ গড়ে তুলতে হলে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আনতে হবে। দলিত শ্রেণির ভূমি রক্ষায় প্রয়োজনে নতুন আইন করা যেতে পারে। দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টানো গেলে আদিবাসীদের নিয়ে উন্নত সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব।
সংসদীয় গ্রুপের সদস্য গ্লোরিয়া ঝর্ণা এমপি বলেন, আদিবাসীদের আগে নিজের ঘর ঠিক করতে হবে। তাদের মধ্যে ঐক্য ও সহনশীলতা থাকতে হবে। ঐক্যবদ্ধ হয়ে বলিষ্ঠভাবে তাদের দাবি তুলে ধরতে হবে। নিজেদের মধ্যে ভেদাভেদ ভুলে যেতে হবে।
নিজেরা করির সমন্বয়ক খুশী কবির বলেন, সমতলের আদিবাসীদের ভূমি রক্ষার জন্য কার্যকর ভূমি কমিশন গঠন করতে হবে। সমাজে দলিত আদিবাসীদের মানুষ হিসেবে শ্রদ্ধা করার ক্ষেত্রে সবার মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে। আদিবাসীদের অধিকার আদায়ে শুধু আইন নয়, প্রয়োজনে নীতিমালা ও একটি অ্যাকশন প্ল্যান তৈরি করতে হবে। আদিবাসীদের অধিকার আদায়ে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার আহ্বান জানান তিনি।
বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং বলেন, কাউকে পেছনে ফেলে উন্নয়ন নয়- সরকারের এসডিজির এ লক্ষ্য তখনই সফল হবে, যখন দেশের আদিবাসীদের উন্নয়ন হবে। একটি দেশ কতটুকু মানবিক, সেটা নির্ভর করে সে দেশের দলিত আদিবাসীরা কতটুকু সুখে আছেন- তার ওপর। আদিবাসীদের সার্বিক উন্নয়নে একটি কার্যকর কৌশল তৈরির ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন তিনি।
অ্যাডভোকেসি অ্যান্ড রাইট বেজড ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামের ম্যানেজার সাইবুন নেছা বলেন, সমতলের আদিবাসীদের জন্য ভূমি কমিশন দ্রুত হওয়া দরকার। আইপি নিউজ বিডির ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক অ্যান্তনি রেমা বলেন, আদিবাসীদের নিজস্ব সত্তার পরিচয়ের বদলে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর পরিচয় অপমানজনক। আদিবাসীরা এই পরিচয় থেকে মুক্তি চায়। চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের সিনিয়র রিপোর্টার শামীমা সুলতানা লাবু বলেন, আদিবাসীদের শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন জরুরি।
এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা বলেন, দলিত-হরিজনরা ঐতিহাসিকভাবেই বঞ্চিত। আর রাষ্ট্র সেটা নির্লজ্জভাবে মেনে নিচ্ছে। তাদের রাষ্ট্রীয় সেবার আওতায় আনতে হবে। হেকস/ইপার বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ডোরা চৌধুরী বলেন, আদিবাসীদের উন্নয়নে সরকারের সদিচ্ছা আছে বলে মনে হয়। তাদের জন্য ছোট ছোট করে কিছু করতে হবে। সিনিয়র সাংবাদিক নজরুল কবীর বলেন, দলিত-হরিজনদের রক্ষায় একটি আইন হওয়া দরকার। অন্যথায় বাংলাদেশ একসময়ে আন্তর্জাতিক চাপে পড়তে পারে। তিনি আরও বলেন, আদিবাসীদের স্বার্থে এ মুহূর্তে একটি মন্ত্রণালয় সম্ভব না হলেও অধিদপ্তর করা যেতে পারে।
সর্বদলীয় সংসদীয় গ্রুপ এপিপিজিসের সেক্রেটারি জেনারেল শিশির শীল বলেন, আদিবাসীদের স্বার্থ রক্ষায় বর্ণবৈষম্য বিলোপ আইনটি সংসদীয় কমিটির ভেটিং পর্যায়ে আছে। আইনটি চূড়ান্ত করার কাজ প্রক্রিয়াধীন। ইএসডিওর নির্বাহী পরিচালক ড. মো. শহীদ উজ জামান বলেন, সমতলের আদিবাসীদের জন্য ভূমি কমিশন করতে খুব বেশি দেরি করা হলে একসময় তাদের ভূমি আর থাকবে না। অনেকের ভূমি দখল হয়ে গেছে।
বাংলাদেশ হরিজন ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক নির্মল দাস বলেন, দেশে যখন অনেক উন্নয়ন হচ্ছে, তখন আমাদের পেট ভরে ভাত খাওয়ার আন্দোলন করতে হচ্ছে। আমরা কোনো কালেই এগোতে পারিনি। আমরা দেশের মানুষের পরিচ্ছন্নতার কাজ করি। অথচ আমরা মানবেতর জীবনযাপন করছি। সারাদেশে ১৫ লাখ হরিজন আছে। আমাদের রক্ষা করা না হলে একসময় আমরা বিলীন হয়ে যাব।
গোলটেবিল বৈঠকে বাংলাদেশ দলিত পরিষদের সমন্বয়কারী নির্মল দাস বলেন, আমরা মানুষ, আমরা বাঁচতে চাই। দেশে আমরা অযাচিত বস্তুর মতো। কুকুর-বিড়ালের চেয়েও নীচু স্তরের আমরা। আমাদের কোথাও যাওয়ার, বসার, খাওয়ার, লেখাপড়া করার স্থান নেই। সবাই আমাদের ঘৃণা করে, তাড়িয়ে দেয়। আমাদের সন্তানদের নিজ এলাকার বাইরে গিয়ে পরিচয় গোপন রেখে লেখাপড়া করতে হয়। আমাদের এই সমাজ মানুষ হিসেবে গণ্য করে না। আমরা এই বৈষম্য থেকে মুক্তি চাই।