ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০১ মে ২০২৫

প্রত্যাবাসন

ভয়ে বাইরে কাটে রাত

ভয়ে বাইরে কাটে রাত

ইব্রাহিম খলিল মামুন, কক্সবাজার

প্রকাশ: ২৪ আগস্ট ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ২৪ আগস্ট ২০২২ | ১৪:০৭

মাওলানা মোহাম্মদ আবদুল্লাহ। জীবন বাঁচাতে অন্য রোহিঙ্গাদের মতো পালিয়ে এসে ২০১৭ সালে সপরিবারে উখিয়া আশ্রয় শিবিরের জামতলী এলাকার ১৫ নম্বর ক্যাম্পে থিতু হন। মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার আন্দোলনের পাশাপাশি মাদক কারবার, অপহরণ, চুরি-ছিনতাইসহ নানা অপরাধের প্রতিবাদ এবং ক্যাম্পে সামাজিক আন্দোলন করতে রোহিঙ্গাদের ঐক্যবদ্ধ করার কাজ শুরু করেন। ২০১৮ সালের ২৮ আগস্ট মাওলানা আবদুল্লাহকে নিজ বাসা থেকে অপহরণ করা হয়। চার বছর হয়ে গেল খোঁজ নেই তাঁর। এখন আবদুল্লাহর পরিবারের ১০ সদস্য নিরাপত্তার জন্য বাসা ছেড়ে ট্রানজিট ক্যাম্পে রয়েছেন। আবদুল্লাহর পরিবারের সদস্যদের আশঙ্কা, মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার আন্দোলনের পাশাপাশি নানা অন্যায়ের প্রতিবাদ করায় আরসা (মিয়ানমারভিত্তিক উগ্রপন্থি সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি) সদস্যরা মাওলানা আবদুল্লাহকে অপহরণ করে হত্যা করেছে। নিরাপত্তাজনিত কারণে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তাঁর পরিবারের এক সদস্য জানান, আবদুল্লাহ মিয়ানমারের বলিবাজার এলাকার মিজামপুর মাদ্রাসার অধ্যক্ষ ছিলেন। বাংলাদেশে আসার পর ক্যাম্পের সবাইকে ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে রোহিঙ্গাদের উৎসাহ জোগাতেন। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে আরসার সদস্যরা তাঁকে অপহরণ করে।

একই পরিণতি মাওলানা হাশিমেরও। মাওলানা মোহাম্মদ হাশিম মিয়ানমার থেকে পালিয়ে ২ নম্বর ক্যাম্পে থাকতেন। তিনিও মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার আন্দোলনের পাশাপাশি অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে নামলে ২০১৯ সালের আগস্টের শেষের দিকে তাঁকেও অপহরণ করা হয়। এখনও হদিস নেই তাঁর।

হাশিমের পরিবারের অভিযোগ, তাঁকে আরসার সদস্যরা অপহরণ করে হত্যা করেছে। হাশিমের ৫ সদস্যের পরিবার নিরাপত্তার জন্য বর্তমানে ট্রানজিট ক্যাম্পে রয়েছে। আবার তাঁর কিছু স্বজন দিনের বেলায় ক্যাম্পে থাকলেও রাতে নিরাপত্তার অভাবে ক্যাম্পের বাইরে কুতুপালং এলাকায় একটি বাসায় থাকেন।

মাস্টার আরিফুল্লাহ ১০ নম্বর ক্যাম্পের মাঝি (রোহিঙ্গা নেতা) ছিলেন। তাঁর ইচ্ছা ছিল অন্য রোহিঙ্গাদের নিয়ে মিয়ানমারে ফিরে যাবেন। সে জন্য কাজও শুরু করেছিলেন। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে বালুখালী ঢালার মুখে সন্ত্রাসীরা প্রকাশ্যে তাঁকে হত্যা করে। তাঁর পরিবারের দাবি, মিয়ানমারে ফিরে যেতে কাজ করায় আরসা সদস্যরা তাঁকে হত্যা করেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তাঁর পরিবারের এক সদস্য জানান, পরিবারের তিন সদস্য নিরাপত্তার অভাবে এখন ক্যাম্পের বাইরে থাকেন। তবে কোথায় থাকেন তা তিনি জানাতে চাননি।

শুধু আবদুল্লাহ, হাশিম কিংবা আরিফুল্লাহ নন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্যমতে, গত পাঁচ বছরে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ১০০ জন খুন হলেও কতজন রোহিঙ্গা অপহরণ হয়েছে, সে তথ্য তাদের কাছে নেই।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অন্তত ৫০ জন রোহিঙ্গা সমকালকে জানান, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দৃশ্যমান তৎপরতার মধ্যেও দিন দিন বেড়েই চলছে আরসার সদস্যদের অপরাধ কর্মকাণ্ড। তাঁদের হাতে অপহরণের শিকার হয়েছেন অন্তত দুই শতাধিক রোহিঙ্গা। যাঁদের এখনও খুঁজে পাননি পরিবারের সদস্যরা। তাই নিরাপত্তার কারণে বর্তমানে অন্তত এক হাজার রোহিঙ্গা দিনে ক্যাম্পে থাকলেও রাতে উখিয়া-টেকনাফের বিভিন্ন এলাকায় অবস্থান করেন।

তারা জানান, উখিয়া-টেকনাফের ৩৪টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বর্তমানে আরসা বাহিনীর নেতৃত্ব দিচ্ছে হাফেজ সোলাইমান ওরফে হাফেজ এহেসান ও ছমিউদ্দিন ওরফে নুর কামাল।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উখিয়া-টেকনাফে ৩৪টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মধ্যে অনিরাপদ জোন হয়ে উঠেছে ক্যাম্প-৫, ক্যাম্প-৬, ক্যাম্প-৭, ক্যাম্প-৮,ক্যাম্প-১৫ ও ক্যাম্প-১৭। এসব ক্যাম্পে কথিত আরসা সদস্যরা মাদক, অপহরণ, ধর্ষণ ও খুনের মতো অপরাধে জড়িয়েছে। আগে প্রতিদিনই তারা দুস্কর্ম করে বেড়ালেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় এখন দু-একদিন পরপর অপরাধ সংঘটিত করছে।

কক্সবাজারের এক পুলিশ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, '৩৪টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ১২ লাখ রোহিঙ্গার মধ্যে অন্তত ১৫ হাজার আরসা সদস্য রয়েছে। তারাই মূলত ক্যাম্পে বিভিন্ন অপরাধ করছে। তবে নানা কারণে আমরা আরসার বিষয়টি প্রকাশ করতে পারছি না।'

উখিয়া থানার ওসি শেখ মোহাম্মদ আলী বলেন, 'রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কোনো অপরাধ সংঘটিত হলে সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ অভিযান চালিয়ে অপরাধীকে আটক করছে। তবে নিরাপত্তাহীনতার কারণে ক্যাম্পের বাইরে রাত কাটানোর বিষয়টি আমার জানা নেই।' তিনি বলেন, 'শুধু উখিয়া থানা পুলিশ গত পাঁচ বছরে ৯২টি অস্ত্র মামলায় ১৭২ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। এ সময় তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে রাইফেল ও শুটার গানের মতো অত্যাধুনিক অস্ত্রও।

কক্সবাজারের পুলিশ সুপার হাসানুজ্জামান বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অপরাধ নিয়ন্ত্রণে পুলিশ আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে। এর পরও বিচ্ছিন্ন কিছু দুর্ঘটনা ঘটছে।

আরও পড়ুন

×