দেশের ২৪ শতাংশ মানুষ এখনও অক্ষরজ্ঞানহীন

ফাইল ফটো
সাব্বির নেওয়াজ
প্রকাশ: ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২২ | ২২:৫৮
সুবল চন্দ্র দাসের বয়স ৪৪ বছর। রাজধানীর কারওয়ান বাজারে কাঁচামালের আড়তে কাজ করেন। বর্তমানে প্রতিদিন তাঁর কাজ হচ্ছে ট্রাক থেকে আড়তে নামানো কতবেলের হিসাব রাখা। কাঁচামাল ব্যবসায়ীরা আড়ত থেকে কতবেল কিনলে চালানমতো সেই মালপত্র বুঝিয়ে দেওয়া। এই কাজে তাঁর কতবেল গণনা করা লাগে। সিজনভেদে কখনও বাতাবিলেবু, কলা অথবা ডাব। অথচ তিনি অক্ষরজ্ঞানহীন। মুখে মুখে 'কুড়ি' হিসাবে গুনে তিনি কাঁচামাল বুঝিয়ে দেন ক্রেতাদের। নিজে কোনো কিছু লিখতে বা পড়তে পারেন না।
কথা বলে জানা গেল, ঝিনাইদহ জেলার শৈলকূপা উপজেলার রতনপুর গ্রামে সুবলের বাড়ি। ১১ ভাইবোনের মধ্যে তিনি অষ্টম। দরিদ্র কৃষক বাবার নুন আনতে পান্তা ফুরোনোর অবস্থা ছিল। তাই সুবলের পড়াশোনার ভাগ্য হয়নি। ১৪ বছর বয়সে গ্রামের এক কাকাতো ভাইয়ের সঙ্গে কাজের সন্ধানে কারওয়ান বাজারে চলে আসেন। সেই থেকে এখানে আছেন। এত দিনে তাঁর নিজেরও সংসার হয়েছে। পাঁচ সন্তানের সবাইকে পড়াশোনা করানোর জন্য সাধ্যমতো চেষ্টা করেছেন। তাঁর বড় মেয়ে বর্তমানে দশম শ্রেণিতে পড়ছে।
সুবলের মতো দেশের ২৪ দশমিক ৪ শতাংশ মানুষ এখনও নিরক্ষর। বিপুলসংখ্যক অক্ষরজ্ঞানহীন এই মানুষ নিয়েই সারাদেশে আজ বৃহস্পতিবার পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস। বিশ্বজুড়ে ৮ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও আজ যথাযোগ্য মর্যাদায় আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস পালিত হচ্ছে। এ বছর সাক্ষরতা দিবসের প্রতিপাদ্য 'সাক্ষরতা শিখন ক্ষেত্রের প্রসার'।
সাক্ষরতার শিখন ক্ষেত্রগুলোর প্রসার বাংলাদেশের জন্য খুবই প্রাসঙ্গিক। সরকারি হিসাবে, ১৫ থেকে ৪৫ বছর বয়সী জনসংখ্যা এ দেশে ৩ কোটি ২০ লাখের মতো। যাদের মধ্যে নিরক্ষর মানুষের সংখ্যা কম নয়। পরিসংখ্যান বলছে, দেশের মোট জনসংখ্যার প্রতি চারজনের একজন নিরক্ষর।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে সাক্ষরতা অর্জনের কাজ চলছে ঢিমেতালে। এই শামুকগতিতে এগোলে শতভাগ সাক্ষরতা অর্জনের জন্য আরও ২৭ বছর লাগবে। অথচ ২০১৪ সালের মধ্যে শতভাগ সাক্ষরতা অর্জনের জন্য সরকারিভাবে লক্ষ্য ধরা হয়েছিল। সেই সময়ও আমরা পেরিয়ে এসেছি আরও আট বছর আগে। এখন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে, ২০৩০ সালের মধ্যে শতভাগ সাক্ষরতা অর্জনের লক্ষ্য ধরা হয়েছে নতুন করে।
গতকাল বুধবার মন্ত্রণালয় এক সংবাদ সম্মেলন করে দাবি করেছে, বর্তমানে দেশে সাক্ষরতার হার ৭৫ দশমিক ৬ শতাংশ। গত বছরও সাক্ষরতার এই একই হারের কথা বলেছিল এ মন্ত্রণালয়। তবে গত ২৭ জুলাই বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২ এর প্রাথমিক ফলাফল প্রকাশ করা হয়। সেখানে বলা হয়, ২০২২ সালে বাংলাদেশে মোট (পুরুষ ও মহিলা) সাক্ষরতার হার (৭ বছর ও তদূর্ধ্ব) ৭৪ দশমিক ৬৬ শতাংশ।
উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর মহাপরিচালক মু. নুরুজ্জামান শরীফ জানান, বর্তমানে একটি প্রকল্প চলমান, যা আগামী বছরের জুন মাসে শেষ হবে। এরপর আর কোনো প্রকল্প নেই। তবে এতদিন আমাদের কাজগুলো ছিল মূলত এনজিওনির্ভর। এখন আমরা নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় কাজ করতে চাই। এ জন্য প্রত্যেক উপজেলায় আমাদের তিনজন নিজস্ব জনবল নিয়োগের পরিকল্পনা প্রায় চূড়ান্ত। তারা নিয়োগ পেলে আমরা ভিন্নভাবে এগোব। তবে ২০৩০ সালের মধ্যে দেশকে শতভাগ নিরক্ষরমুক্ত করতে হলে আনও বড় ধরনের পরিকল্পনা হাতে নিতে হবে।
মন্ত্রণালয়ের সংবাদ সম্মেলন
আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস পালন উপলক্ষে বুধবার দুপুরে সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। সেখানে বক্তব্য রাখেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন ও সিনিয়র সচিব মো. আমিনুল ইসলাম খান। সেখানে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে কোনো নিরক্ষর মানুষ থাকবে না। এ জন্য উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর ক্ষমতা বৃদ্ধি করা হচ্ছে। নানা কার্যক্রমের মাধ্যমে দেশে নিরক্ষর মানুষ রাখা হবে না। সাক্ষরতার কোনো বিকল্প নেই। জাকির হোসেন বলেন, বর্তমানে সাক্ষরতার হার ৭৫ দশমিক ৬ শতাংশ। এখানও ২৪ দশমিক ৪ শতাংশ মানুষ সাক্ষরতার বাইরে। তাদের সাক্ষরতার আওতায় আনতে নানা ধরনের কর্মসূচি হাতে নেওয়া হচ্ছে। দিবসটি উপলক্ষেও নেওয়া হয়েছে বিভিন্ন কর্মসূচি। সারাদেশে একযোগে তা পালন করা হবে।
তিনি বলেন, গত কয়েক বছরে দেশের ৬৪ জেলার নির্বাচিত ২৪৮টি উপজেলার ১৫ থেকে ৪৫ বয়সী ৪৪ লাখ ৬০ হাজার নিরক্ষরকে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর মাধ্যমে মৌলিক সাক্ষরতা জ্ঞান দেওয়া হয়েছে। গত ৩০ জুলাই এ কার্যক্রম শেষ হয়েছে। এর বাইরে পিইডিবি-৪ প্রকল্পের আওতায় স্কুল থেকে ঝরে পড়া ও স্কুলে যায়নি এমন ৬ লাখ শিক্ষার্থীদের মৌখিক শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। এরপর তাদের হাতেকলমে কাজের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. আমিনুল ইসলাম খান বলেন, দেশে এখনও সাক্ষরতার কোনো রূপরেখা তৈরি করা হয়নি। কতটুকু শিখলে সাক্ষরতা জ্ঞান অর্জন হবে তার একটি রূপরেখা করা হবে। দেশে চার কোটি মানুষের বেশি যারা এখারও সাক্ষরতার বাইরে রয়েছে। তাদের এর আওতায় আনা হবে।
কর্মসূচি
আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস উপলক্ষে সরকারিভাবে আজ রাজধানীর মহাখালীতে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোতে এক আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। এ ছাড়া প্রতিটি জেলায় জেলা প্রশাসকদের মন্ত্রণালয়ের কর্মসূচির সঙ্গে সংগতি রেখে দিবসটি উদযাপন করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।