ঢাকা রবিবার, ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

ধর্ষণ মামলায় আদালতের বাইরে সমঝোতা বাড়ছে

ধর্ষণ মামলায় আদালতের বাইরে সমঝোতা বাড়ছে

প্রতীকী ছবি

ওয়াকিল আহমেদ হিরন

প্রকাশ: ০৭ অক্টোবর ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ০৭ অক্টোবর ২০২২ | ১৪:২০

আদালতের বাইরে দুই পক্ষের মধ্যে সমঝোতা হচ্ছে বিচারাধীন ধর্ষণ মামলায়। বিচারের মাঝপথেই থেমে যাচ্ছে অনেক মামলার কার্যক্রম। এতে অপরাধী রেহাই পেয়ে যাচ্ছে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে বলা আছে- এ ধরনের মামলায় আপস-মীমাংসার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু আদালতকে না জানিয়ে অনেক ক্ষেত্রে পারিবারিকভাবে সমঝোতা ঘটেই চলেছে।

মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, ধর্ষণের পর সমঝোতা করে স্বামী হওয়া সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। আইনের দৃষ্টিতে তাদের অপরাধ মওকুফ হতে পারে না। মামলা দায়েরের পর ধর্ষণের শিকার নারী ধর্ষককে বিয়ে করছেন। এমন প্রবণতা বন্ধ করতে হবে, তা না হলে সমাজে অপরাধ বাড়বে।

অপহরণ, ধর্ষণ, নারী ও শিশু নির্যাতন-সংক্রান্ত মামলা বিচারের জন্য সারাদেশে ৯৯টি ট্রাইব্যুনাল রয়েছে। বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী গত জুলাই পর্যন্ত এসব ট্রাইব্যুনালে মামলার সংখ্যা ১ লাখ ৮১ হাজার ৩০০। এসব মামলা নিষ্পত্তিতে অগ্রগতি কম। বছরে নিষ্পত্তি হচ্ছে মাত্র ৩ দশমিক ৮৭ শতাংশ মামলা। সাজা পাচ্ছে কম আসামি। চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে সারাদেশে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা হয়েছে প্রায় ১ হাজার ১০০। এর মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ ধর্ষণের মামলা।

আইনজীবীরা বলছেন, আইন সংশোধন করে ২০২০ সালে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করার পরও ধর্ষণের ঘটনা কমেনি। ধর্ষণ মামলায় অপরাধীদের প্রভাব, তদন্তে দীর্ঘসূত্রতা, দুর্বল চার্জশিট, মেডিকেল রিপোর্টে ধর্ষণের আলামত না পাওয়া, সাক্ষী হাজির না করা, বাসা পরিবর্তন, সাক্ষ্য গ্রহণের সময় বাদীকে হয়রানির কারণে অধিকাংশ মামলার বিচার ঝুলে যায়। ধর্ষণ মামলার আসামিদের শাস্তি নিশ্চিত না হওয়ার পেছনে বড় কারণ চাপ প্রয়োগ করে বাদীপক্ষের সঙ্গে আসামিপক্ষের সমঝোতা। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায়, ধর্ষণের শিকার নারী-শিশু দরিদ্র পরিবারের হওয়ায় আর্থিক সুবিধাসহ নানা প্রলোভনে বাধ্য হয়ে আসামির সঙ্গে সমঝোতা করে তাঁরা। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ড।

মামলার পর আপসের মাধ্যমে বিয়ে: ধর্ষণের অভিযোগে এক তরুণী ২০১৮ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর কলাবাগান থানায় ফরিদের (ছদ্মনাম) বিরুদ্ধে মামলা করেন। মেডিকেল রিপোর্টে ধর্ষণের সত্যতা পাওয়া যায়। ঘটনার দেড় মাস পর সাভারে গিয়ে পারিবারিকভাবে আপসের মাধ্যমে তাঁদের বিয়ে হয়। দু'জনেরই বাড়ি রাজবাড়ীর কালুখালীর পাচুড়িয়া গ্রামে। তাঁরা ঢাকায় গ্রিন রোড এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকেন। পুলিশ একই বছরের ২৬ নভেম্বর আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে। সম্প্রতি মামলার বাদী ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্যে বলেন, পারিবারিকভাবে আপস করে তাঁরা বিয়ে করেছেন। তাঁদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক ছিল। তাঁদের এক সন্তান আছে। তাঁরা সুখে-শান্তিতে আছেন। আদালতে হলফনামা দিয়ে মামলাটি প্রত্যাহার করতে চান তিনি।

অভিযুক্তকে মামলা থেকে খালাসের দাবি: অপহরণের পর ধর্ষণের অভিযোগে ২০২১ সালের ২৫ জানুয়ারি রাজধানীর মুগদা থানায় সবুজ (ছদ্মনাম) এবং অজ্ঞাতনামা দু'জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন এক নারী। তিনি অভিযোগ করেন, ২৪ জানুয়ারি বিকেলে তাঁর সপ্তম শ্রেণি পড়ূয়া মেয়েকে দক্ষিণ মান্ডার পিয়ার আলীর গলির সামনে থেকে অপহরণ করে নিয়ে ধর্ষণ করে সবুজ। তদন্ত শেষে সবুজকে অভিযুক্ত করে আদালতে প্রতিবেদন দেয় পুলিশ। কিন্তু সম্প্রতি ওই মেয়ে আদালতে এসে জানিয়েছে,  সবুজের সঙ্গে তার প্রেমের সম্পর্ক ছিল। ২৬ জানুয়ারি তারা বাসাবো গিয়ে উভয়ের সম্মতিতে বিয়ে করেছে। তাকে কেউ অপহরণ করেনি। সম্প্রতি আদালতে বিয়ে-সংক্রান্ত কাবিননামা ও কাগজপত্র আদালতে দাখিল করে ওই মেয়ে। গত ২৮ সেপ্টেম্বর ওই মেয়ে এবং তার মা সবুজকে জামাই হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে ঢাকার ৫ নম্বর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দেন। পাশাপাশি হলফনামা দিয়ে মূল কাবিননামা ও দু'পক্ষের মধ্যে আপসনামা দাখিল করেন। তাঁরা মামলা থেকে সবুজের খালাস চান। বিচারক তাঁদের সাক্ষ্যগ্রহণ করে ১ নভেম্বর পরবর্তী দিন ধার্য করেন।

'আপস হলে আদালতের কিছু করার থাকে না': ধর্ষণের অভিযোগে মামলার পর মামলা তুলে নেওয়ার আবেদন ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে অনেক সময়ই হচ্ছে। বিচারপ্রার্থীরা বিচার না চাওয়ায় এক সময় আসামিকে খালাস দিতে হয়। দেখা যায়, আদালতের বাইরে আপস করে বাদী-বিবাদী নির্বিঘ্নে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তাঁরা আর আদালতে আসেন না। ঝুলে থাকে মামলা, এভাবেই বাড়তে থাকে আদালতে মামলাজট। এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর আদালতের পিপি আবদুল্লাহ আবু সমকালকে বলেন, ধর্ষণ মামলায় আপস-মীমাংসার কোনো সুযোগ নেই। আদালতের বাইরে সমঝোতাসহ নানা গল্প সাজানো হচ্ছে। দু'পক্ষের মধ্যে আপস হলে আদালতেরও কিছু করার থাকে না। আবার কখনও কখনও দেখা যায়, কাউকে সামাজিকভাবে হেয় করতে ধর্ষণের অভিযোগ তুলে মিথ্যা মামলা করা হচ্ছে।

জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট সালমা আলী সমকালকে বলেন, ধর্ষণ মামলা আদালতের বাইরে আপস-মীমাংসা মোটেই কাম্য নয়। আইনেও এর সুযোগ নেই। কিন্তু বাদী যখন আদালতে এসে বলেন, তাঁদের বিয়ে হয়ে গেছে, সন্তান হয়েছে তখন আদালতেরও কিছু করার থাকে না। ওই বিয়েও বেশিদিন টেকে না। এ ধরনের প্রবণতা বন্ধ না হলে অপরাধ বাড়তেই থাকবে।

আরও পড়ুন

×