ঢাকা মঙ্গলবার, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

আন্তর্জাতিক কন্যাশিশু দিবস আজ

বিচারহীনতায় বাড়ছে শিশু পাচার

বিচারহীনতায় বাড়ছে শিশু পাচার

সাজিদা ইসলাম পারুল

প্রকাশ: ১০ অক্টোবর ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ১০ অক্টোবর ২০২২ | ২২:৫৩

বাবা-মায়ের সঙ্গে অভিমান করে ঘর থেকে বের হয়েছিল ১২ বছর বয়সী সুমি (ছদ্মনাম)। ঢাকায় পৌঁছুনোর পর গাবতলীতে পরিচয় হয় জয়নাল নামে এক মধ্যবয়সী ব্যক্তির সঙ্গে। 'মা' সম্বোধন করলেও কাজ দেওয়ার কথা বলে সুমিকে টাঙ্গাইলের যৌনপল্লিতে নিয়ে বিক্রি করে দেয় জয়নাল।

এভাবে কন্যাশিশুরা প্রতিনিয়ত পাচারের শিকার হচ্ছে। বিচারহীনতার সংস্কৃতিতে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে অপরাধীরা। আইনি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একদিকে দারিদ্র্য, শিক্ষার অভাব ও নৈতিক অবক্ষয়; অন্যদিকে বিচারহীনতা। যারা পাচার হয়েছে, তারা কোনোভাবেই ভালো নেই। দেশে কিংবা দেশের বাইরে দুর্বিষহ জীবন যাপন করছে তারা। তাদের পরিবারের সদস্যরাও হতাশায় দিন কাটাচ্ছে।

১৫ বছর বয়সী শায়লা (ছদ্ম নাম)। পাশের বাড়ির লতিফ চাচা এনার্জি ড্রিঙ্কের সঙ্গে কিছু মিশিয়ে তা পান করায় শায়লাকে। তা খেয়েই অচেতন হয়ে পড়ে সে। জ্ঞান ফেরার পর নিজেকে আবিস্কার করে টাঙ্গাইলের যৌনপল্লিতে। তাকে যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করতে বাধ্য করা হতো। তিন মাস পর নিজেই মুক্তির পথ পায়। একজন খদ্দের জাতীয় জরুরি সেবাদানকারী নম্বরে ফোন করলে পুলিশ তাকে উদ্ধার করে।

সুমি, শায়লার মতো প্রতিনিয়ত দেশে ও দেশের বাইরে যৌনকর্মের জন্য কন্যাশিশুদের পাচার করা হচ্ছে। শিশু অধিকার সংগঠনের নেতারা বলছেন, যৌন কাজের উদ্দেশ্যে পাচার করা ৪০ শতাংশই শিশু। দেশের এমন পরিস্থিতে গত ৩০ সেপ্টেম্বর দেশব্যাপী জাতীয় কন্যাশিশু দিবস পালিত হয়। আজ বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও পালিত হবে 'আন্তর্জাতিক কন্যাশিশু দিবস'। এবারের প্রতিপাদ্য 'সময়ের অঙ্গীকার, কন্যাশিশুর অধিকার'। পৃথিবীজুড়ে লিঙ্গ বৈষম্য দূর করতে ২০১২ সালের ১১ অক্টোবর প্রথম দিবসটি পালিত হয়। জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলো প্রতিবছর দিবসটি পালন করে থাকে। দিবসটি উপলক্ষে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্যমতে, চলতি বছরের প্রথম আট মাসে ১৩ শিশু পাচার হয়। ২০১২ থেকে '২০ সাল পর্যন্ত ৯ বছরে পাচার হয়েছে ৩৩২ জন। এদের মধ্যে যৌনপল্লিতে বিক্রি করা হয়েছে ১৩৩ জনকে। অধিকারকর্মীরা বলছেন, চাকরি কিংবা বিয়ের প্রলোভন দিয়ে দালালরা নারী-শিশুদের পাচার করছে। অনেক কন্যাশিশুকে বিক্রি করে দিচ্ছে যৌনপল্লিতে। তাদের দাবি, ভারতের সঙ্গে উন্মুক্ত সীমান্ত নজরদারি বাড়ানো, আইন ও বিধিমালা বাস্তবায়ন, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী বৃদ্ধি, সাক্ষী সুরক্ষার ব্যবস্থা এবং এ সংক্রান্ত অপরাধীকে শাস্তি দেওয়া জরুরি।

বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির তথ্যমতে, গত জানুয়ারি থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত ৪০ জনের অধিক পাচার হওয়া নারী ভারত থেকে দেশে আসে। তাদের মধ্যে ৩০ শতাংশই শিশু। জানা যায়, পাচার হওয়া শিশুদের মধ্যে ৩০ শতাংশ শিশু যৌনর্কমে যুক্ত হওয়ার পর ধরা পড়ে। আর ২০ শতাংশ আগেই ধরা পড়ে দেশে ফিরে আসে। এ ছাড়া ১০ থেকে ১৫ শতাংশ শিশু প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর দেশে ফিরতে পারে।

জাস্টিস অ্যান্ড কেয়ারের কান্ট্রি ডিরেক্টর মো. তারিকুল ইসলাম বলেন, গত পাঁচ বছরে আমরা পাঁচ শতাধিক নারী-শিশুকে পুনর্বাসন করেছি। মোবাইল ফোনে উত্ত্যক্ত কিংবা প্রেমের ফাঁদে ফেলে মেয়েদের পাচার করা হয়। আবার কেউ কাজের খোঁজে গিয়ে পাচার হয়। কন্যাশিশুদের যৌনকর্মে বাধ্য করা হয়।
আইনজীবী ওয়ালিউর রহমান দোলন বলেন, মানব পাচার রোধ করতে হলে আইনের প্রয়োগ করতে হবে। অপরাধীকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। এ বিষয়ে সরকারকে আরও কার্যকর ও টেকসই পদক্ষেপ নিতে হবে।

শিশুদের সহায়তায় হেল্পলাইন :শিশুদের সহায়তায় কাজ করছে সমাজসেবা অধিদপ্তরের চাইল্ড সেনসিটিভ সোশ্যাল প্রটেকশন ইন বাংলাদেশ প্রকল্প। দেশের যে কোনো প্রান্তে শিশুরা সহিংসতা, নির্যাতন ও শোষণের শিকার হলে বিনামূল্যে ১০৯৮ হেল্পলাইনে ফোন করে সহায়তা চাইতে পারে। গত সাড়ে পাঁচ বছরে (জানুয়ারি ২০১৬ থেকে সেপ্টেম্বর ২০২১) এই হেল্পলাইনে কল এসেছে ৫ লাখ ৮৬ হাজার ৩০৭টি। এর মধ্যে ৫ হাজার ৮৭২টি ছিল শিশু নির্যাতন, ৫ হাজার ৩৪৭টি পারিবারিক সমস্যা এবং ৯ হাজার ২১৩টি কল ছিল গৃহিণী ও হারিয়ে যাওয়া শিশু সম্পর্কিত। এ ছাড়া আইনি সহায়তা চেয়ে কল আসে ১৯ হাজার ১৩৮টি। স্বাস্থ্যবিষয়ক তথ্য ও পরামর্শ দেওয়া হয়েছে ৪৭ হাজার ৪৫৩ জন শিশুকে।

আরও পড়ুন

×