নালিশে শাস্তিতে অনড় নাসির

সমকাল প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১০ অক্টোবর ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ১১ অক্টোবর ২০২২ | ০৪:২৫
মো. নাসির উদ্দিন; ছিলেন দারোয়ান। পদোন্নতি পেয়ে হয়েছেন উচ্চমান সহকারী। এখন তাঁর চালচলনও বেশ 'উঁচু'। যেন খামারবাড়ির বড় কর্তা! মূল ফটক পেরুতেই বাঁ পাশে এক্স করোল্লা মডেলের সাদা প্রাইভেটকার (ঢাকা মেট্রো গ-২৫-৪৯৬৫), সেটাই তাঁর। গাড়ির সামনে লেপ্টে দেওয়া সরকারি লোগো আর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের স্টিকার। সাভারের বাড়ি থেকে নিত্যদিন নিজেই হাঁকিয়ে আসেন কর্মস্থল খামারবাড়িতে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, নিজ জেলা চাঁদপুরের কোটা না থাকায় মিথ্যা তথ্য দিয়ে রাজশাহীর স্থায়ী ঠিকানা দেখিয়ে নিয়েছিলেন দারোয়ানের চাকরি। নারী কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে দেখেছেন কারাগারের চার দেয়াল। আড়াই বছর ছিলেন শাস্তিমূলক চাকরির বাইরে। ছোট পদে চাকরি করলেও জ্যামিতিক হারে বাড়িয়েছেন সম্পদ। সাভারে নিজের, স্ত্রীসহ নামে-বেনামে রয়েছে একাধিক বাড়ি ও ফ্ল্যাট। অনিয়মের মাধ্যমে অঢেল সম্পদের মালিক বনে যাওয়া নাসিরের বিরুদ্ধে নালিশ গেছে দুর্নীতি দমন কমিশনেও (দুদক)। এ ব্যাপারে কৃষি মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছে দুদক। গত ১১ আগস্ট কৃষি মন্ত্রণালয়ের সম্প্রসারণ উইংয়ের উপসচিব (সম্প্রসারণ-৪ শাখা) জাহিদ হোসেন ছিদ্দিক স্বাক্ষরিত চিঠিতে নাসিরের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে মন্ত্রণালয়কে জানানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ডিএই তদন্ত কমিটি গঠন করলেও মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন জমা দেয়নি।
এ ব্যাপারে উপসচিব জাহিদ হোসেন ছিদ্দিক বলেন, নাসিরের বিষয়ে ডিএইর তদন্ত প্রতিবেদন এখনও মন্ত্রণালয়ে আসেনি। প্রতিবেদন এলেই মন্ত্রণালয় পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে জানাবে।
এর আগে নাসিরের বিরুদ্ধে নিয়োগ বাণিজ্য, উৎকোচ গ্রহণসহ নানা অভিযোগ তদন্তের জন্য কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে গত ১১ এপ্রিল ডিএই মহাপরিচালক মো. বেনজীর আলমকে চিঠি দিয়েছিলেন কৃষি মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (সম্প্রসারণ-৪ অধিশাখা) মো. জসিম উদ্দিন। তখন একটি তদন্ত কমিটি গঠন হলেও প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখেনি। উল্টো যে চারজন কর্মচারী মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ করেছেন; তাঁদের নানাভাবে হয়রানি করা হচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নাসির উদ্দিনের নিজ বাড়ি চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলার সুজাতপুর গ্রামে। তাঁর ফেসবুক আইডিতেও নিজ জেলা চাঁদপুর উল্লেখ আছে। তবে ১৯৯৬ সালে নিজ জেলার কোটা না থাকায় তিনি রাজশাহীকে (ঘোড়ামারা রেলগেট, পোস্ট :বোয়ালিয়া, থানা :বোয়ালিয়া) স্থায়ী ঠিকানা দেখিয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরে দারোয়ানের চাকরি নেন। নাসির তাঁর আত্মীয় ডিএইর তৎকালীন এক পরিচালকের সহায়তায় মিথ্যা তথ্য দিয়ে সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলা কৃষি অফিসে 'গার্ড' পদে চাকরি শুরু করেন। সেখানে এক নারীকে অপহরণ ও নির্যাতনের ঘটনায় গ্রেপ্তার হয়ে চার মাস জেল খাটেন নাসির। এ সময় বরখাস্ত হয়ে ২ বছর ৬ মাস পর আবার গার্ড পদেই তিনি যোগ দেন খামারবাড়িতে। পদোন্নতি পেতে পেতে ২০১৫ সালে হন উচ্চমান সহকারী। নিয়োগ পান ডিএইর গুরুত্বপূর্ণ উইং উদ্ভিদ সংগনিরোধে (কোয়ারেন্টাইন) পণ্য আমদানি শাখায়। মূলত এখান থেকেই তাঁর উত্থান। কর্মকর্তাদের সঙ্গে সখ্য থাকায় আমদানি অনুমতিপত্র পাইয়ে দিতে উৎকোচ নিতেন। এক সময় তিনি কোয়ারেন্টাইন শাখার নিয়ন্ত্রকে পরিণত হন। ২০১৬ সালে অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে একাধিক গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হলে তাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত কমিটি করে ডিএই। কমিটি অনিয়মের প্রমাণ পেয়ে তাঁকে ঢাকার বাইরে বদলিসহ শাস্তির সুপারিশ করলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। বরং কোয়ারেন্টাইন শাখা থেকে তাঁকে প্রশাসন ও অর্থ উইংয়ে পদায়ন করা হয়। প্রায় ৫ বছর ধরে তিনি এ শাখাতেই আছেন। প্রশাসন শাখার একাধিক কর্মকর্তার সহায়তায় তিনি হয়ে ওঠেন আরও ক্ষমতাধর। ভালো জায়গায় পদায়ন, বদলি ও পদোন্নতিতে নাসির উদ্দিনই অনেকের ভরসা।
দুদক ও কৃষি মন্ত্রণালয়ে দেওয়া অভিযোগসূত্রে জানা যায়, সাভারের রেডিও কলোনিতে নাসির উদ্দিনের ১৬০০ বর্গফুটের দুটি ফ্ল্যাট রয়েছে। আছে দুটি বাড়ি করার উপযুক্ত কয়েক কোটি টাকা মূল্যের ১২ কাঠা জমি। এর মধ্যে ৫ কাঠার জমিতে ৯ তলা বাড়ি নির্মাণের কাজ চলমান। রয়েছে প্রায় ৪০ লাখ টাকার একটি মাটি কাটার ভেকু। এ ছাড়া নিজের ও তাঁর স্ত্রীর নামে একাধিক ব্যাংক হিসাবে কোটি কোটি টাকা রয়েছে বলেও অভিযোগসূত্রে জানা গেছে।
এ ব্যাপারে নাসির উদ্দিন বলেন, 'আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ বিষয়ে একটি তদন্ত হচ্ছে। প্রতিবেদন জমা দিয়েছে কিনা, জানি না। রাজনীতির কারণে একটি পক্ষ আমাকে হয়রানি করছে। খামারবাড়ি নন গেজেটেড সরকারি কর্মচারী কল্যাণ সমিতির নির্বাচন ঘিরে বিভিন্ন দিক থেকে আমাকে ফাঁসানোর চেষ্টা চলছে। আমার বিরুদ্ধে অভিযোগের অধিকাংশই মিথ্যা।' প্রতিটি অভিযোগ আলাদা তুলে ধরে তাঁর বক্তব্য জানতে চাইলে তিনি বারবার সরাসরি দেখা করে কথা বলার অনুরোধ জানান। এসব বিষয়ে কোনোভাবেই তিনি ফোনে কথা বলতে রাজি হননি।
- বিষয় :
- খামার বাড়ি
- কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর
- নাসির