বিআরটি প্রকল্প
মহাদুর্ভোগ ভুলেরই খেসারত
অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ হাদীউজ্জামান
প্রকাশ: ২৭ অক্টোবর ২০২২ | ১২:০০
বাসের জন্য বিশেষায়িত লেন বা বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পটিই ভুলে ভরা। কর্তৃপক্ষের করা ভুলের খেসারত সাধারণ মানুষকে দিতে হচ্ছে। বিআরটির নির্মাণকাজ শুরুর পর থেকেই জয়দেবপুর-উত্তরা সড়কে ভোগান্তি কিংবা গত কয়েক দিনের মহাদুর্ভোগ সেই ভুলেরই কুফল।
ঢাকা-ময়মনসিংহের মতো মহাব্যস্ত মহাসড়কে বিআরটি প্রকল্প নেওয়াই উচিত হয়নি। ওই সড়কে পণ্যবাহী যানের চলাচল বেশি। বিআরটি নির্মাণ করতে হয় যেখানে প্রাইভেটকারের চলাচল বেশি, অর্থাৎ শহরের কেন্দ্রে। যানজট ঠেকাতে প্রাইভেটকারের যাত্রীদের বাসে স্থানান্তরই বিআরটির মূল উদ্দেশ্য। কিন্তু যেখানে নির্মাণ করা হচ্ছে, সেখানে প্রাইভেটকারের চেয়ে বহু গুণ চলে বাস ও পণ্যবাহী যানবাহন। ফলে গাজীপুর করিডোরে বিআরটি নির্মাণের সিদ্ধান্তই ছিল ভুল। এই সড়কের দু'পাশে শিল্প এলাকা। এগুলোর কর্মীরা হেঁটে কর্মক্ষেত্রে আসেন। তাঁরা বিআরটির যাত্রী নন। তাহলে কার জন্য গাজীপুরে বিআরটি হচ্ছে?
বিআরটিতে 'জোয়ার-ভাটা' থাকতে পারবে না। করিডোরের দু'দিক থেকেই যাত্রী প্রবাহ থাকতে হবে। নইলে বিআরটি লাভজনক হবে না। কিন্তু ঢাকার বিআরটিতে 'জোয়ার-ভাটা' থাকবেই। সকালে দেখা যাবে ঢাকামুখী যাত্রীর চাপ। তখন গাজীপুরমুখী যাত্রীর ভাটা চলবে। বিকেলে থাকবে গাজীপুরমুখী যাত্রীর চাপ। এই 'জোয়ার-ভাটা'র কারণে ঢাকার বিআরটি লাভজনক হবে না।
এমন তাত্ত্বিক ভুলের মতো অবকাঠামোর কাজও ভুলে ভরা। ২০১২ সালের বিআরটি প্রকল্পের কাজ ২০১৭ সালে শুরু হলেও পরিকল্পনা ২০০৫ সালের। ১৭ বছর চলে গেছে। একটি প্রকল্প থেকে ২০-২৫ বছর সুফল পাওয়া যায়। তাই খণ্ডিত বিআরটি আগামী বছরে চালু হলেও কতদিন সুফল পাওয়া যাবে, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। ২০০৫ সালে গাজীপুর করিডোরে দিনে যে পরিমাণ গাড়ি চলত, এখন তার দ্বিগুণ বা তিন গুণ গাড়ি চলে। ২০০৫ সালে যে অবস্থা দেখে প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল, সেই বাস্তবতাই নেই। এমন মহাব্যস্ত মহাসড়কে নির্মাণকাজের জন্য যে পূর্বপ্রস্তুতি প্রয়োজন, তা বিআরটি প্রকল্পে ছিল না। নির্মাণকাজের করিডোরকে আলাদা না করে কাজ শুরু হয়। এর ফল ভুগতে হচ্ছে যাত্রীদের। বিআরটি লেন জয়দেবপুর থেকে কেরানীগঞ্জের ঝিলমিল পর্যন্ত নেওয়ার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু ভোগান্তির ভয়ে বিমানবন্দরে এসে থেমে যাচ্ছে। সোয়া ৪ হাজার কোটি টাকার খণ্ডিত বিআরটি আদৌ কাজে নাকি বোঝায় পরিণত হবে- এ প্রশ্ন আছে।
সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে একমত, বিআরটি গলার কাঁটায় পরিণত হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, অন্যান্য দেশে যানজট নিরসনে দারুণ ভূমিকা রাখা বিআরটি বাংলাদেশে কেন গলার কাঁটা হলো? এর কারণ, যাঁরা এই প্রকল্প বাস্তবায়নে ছিলেন বা এখনও আছেন, তাঁরা বিআরটির মতো আধুনিক পরিবহন ব্যবস্থার বিষয়ে অভিজ্ঞ নন। বিআরটি সেতু বা ফ্লাইওভারের মতো শুধু অবকাঠামো নয়। বিআরটি একটি পদ্ধতি।
বিআরটি প্রকল্পের ঠিকাদাররা অস্বাভাবিক কম দর দিয়ে কাজ পেয়েছেন। নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের তখনই দেখা উচিত ছিল, কম টাকায় ঠিকাদাররা কাজ করতে পারবেন কিনা? না পারলে তখনই বাদ দেওয়া উচিত ছিল। বাদ যখন দেওয়া যায়নি, তখন স্টিয়ারিং কমিটি, বাস্তবায়নকারী ইউনিটের দায়িত্ব ছিল ঠিকাদারের কাছ থেকে সময়সূচি মেনে কাজ আদায় করা। এই ব্যর্থতা কাদের, তা দেখা উচিত। ঠিকাদার যত কম টাকায়ই কাজ নিক, বাস্তবায়নের দায়িত্ব তাঁর। দেশি ও আন্তর্জাতিক আইনে ঠিকাদারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ ছিল।
বিআরটির কাজের কারণে গাজীপুর, টঙ্গী, উত্তরার সড়কের বেহাল দশা নতুন কিছু নয়। রাস্তায় আগেই পুকুরের মতো বিশাল খানাখন্দ ছিল। বৃষ্টি হলে তা পানিতে ডুবে ভোগান্তি যে হবে, তা জানাই ছিল। কিন্তু জেনেও খানাখন্দ ভরাট করা, পানি নিস্কাশনের ব্যবস্থা যাঁরা করেননি বা ঠিকাদারকে দিয়ে করাননি, তাঁদের কি কোনো জবাব দিতে হবে? কিংবা অতীতে দিতে হয়েছে? জবাবদিহিতা না থাকাই সবচেয়ে সমস্যা। ট্রাফিক ব্যবস্থা, নিরাপত্তা নিশ্চিত না করলে ঠিকাদারকে কাজ থেকে বাদ দেওয়ারও সুযোগ রয়েছে।
এখন আর সেই সুযোগ নেই। সে কারণেই গার্ডার দুর্ঘটনায় পাঁচজনের মৃত্যুর পরও ঠিকাদারকে কিছু করা যায়নি। প্রকল্পের ৮০ শতাংশ কাজ শেষ। এখন ঠিকাদারকে বাদ দিলে কাজ তিন-চার বছর পিছিয়ে যাবে। ঠিকাদাররা বিল পেতে সাধারণত সহজ কাজ আগে করেন। যে ২০ শতাংশ কাজ বাকি রয়েছে, এটাই সবচেয়ে কঠিন। জয়দেবপুর মোড়ে দুই লেয়ারের ইন্টারচেঞ্জ নির্মাণ করতে হবে।
তবে আসল চ্যালেঞ্জ এখনও শুরুই হয়নি। রাস্তার মাঝ বরাবর নির্ধারিত লেনে শুধু বিশেষায়িত বাস চলবে- বিআরটি পদ্ধতি শুনতে যতটা সহজ শোনায়, ততটা সহজ নয়। বাস চালুর পরেই আসল চ্যালেঞ্জ। ঢাকা-গাজীপুরে ৪২টি রুটের বাস চলে। এত লাভজনক রুটে বেসরকারি বাস বন্ধ করা বিরাট চ্যালেঞ্জ। জয়দেবপুর ও বিমানবন্দরে বেসরকারি বাসের সঙ্গে সমন্বয় খুবই কঠিন কাজ। বিআরটি করতে গিয়ে গাজীপুরে ফুটপাত সরু করা হয়েছে। হেঁটে চলা লাখ লাখ শ্রমিকের সঙ্গে বিআরটির সমন্বয় কীভাবে হবে, বিআরটি লেন কীভাবে বাধাহীন রাখা হবে- এসব প্রশ্নেরও উত্তর বের করতে হবে অতীতে ব্যর্থতার পরিচয় দেওয়া কর্তৃপক্ষকে।
লেখক : অধ্যাপক, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়
শ্রুতিলিখন :রাজীব আহাম্মদ
- বিষয় :
- বিআরটি