বিদেশি দূতদের কড়া বার্তা দিল সরকার

রাজধানীতে রোববার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আয়োজিত মানবাধিকারবিষয়ক সেমিনারে উপস্থিত ছিলেন বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত ও বিদেশি মিশনের প্রতিনিধিরা-সংগৃহীত
কূটনৈতিক প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১১ ডিসেম্বর ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ১২ ডিসেম্বর ২০২২ | ০১:৫৯
ঢাকার বিদেশি দূতদের কড়া বার্তা দিয়েছে সরকার। বাংলাদেশে বিদেশি কূটনীতিকদের শিষ্টাচার মেনে চলার হুঁশিয়ারির পাশাপাশি বিদেশি শক্তির কাছে মাথানত করবে না বলে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে বাইরের কোনো শক্তি বা অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্র এ দেশের ভাগ্য নির্ধারণ করবে না। বাংলাদেশে আগামী সংসদ নির্বাচন সংবিধান অনুযায়ী হবে, যা সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করবে নির্বাচন কমিশন। বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার অবাধ, স্বচ্ছ এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে দেশে গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহতের বিষয়ে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ বলেও কূটনীতিকদের জানানো হয়। ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে মানবাধিকার দিবসে সরকারের অবস্থান তুলে ধরেন আইনমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী।
গতকাল রোববার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস পালন করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। 'বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট :মানবাধিকার উন্নয়ন ও সুরক্ষা' শীর্ষক সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের সভাপতিত্বে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম, ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস, ঢাকায় যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার রবার্ট সি ডিকসন, ঢাকায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের ডেলিগেশন প্রধান চার্লস হোয়াটলিসহ বিভিন্ন বিদেশি মিশনের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়া জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ, সাবেক মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান, সাবেক রাষ্ট্রদূত আবদুল হান্নান, বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘের নির্বাহী পরিচালক রোকেয়া কবির প্রমুখ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, গণতান্ত্রিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ৩০ লাখ প্রাণের বিনিময়ে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। এর মধ্যে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হারিয়েছে জাতি। এর পর নানা প্রতিবন্ধকতায় পেরিয়েছে দেশ। আমরা এসব বিষয় থেকে শিক্ষা নিয়েছি এবং সেই শিক্ষার ওপর বাংলাদেশ তার মানবাধিকারের ভিত্তি তৈরি করেছে। তখন থেকে বাংলাদেশ মানবাধিকারের ভালো প্রয়োগগুলো অনুসরণ করেছে, মানবিক মর্যাদা বিবেচনায় নিয়ে আইন প্রণয়ন করেছে।
তিনি বলেন, আমরা জনগণের সরকার। সুতরাং সরকারের পদ্ধতি হচ্ছে, আমরা প্রথমে শুনি, অবস্থা বোঝার চেষ্টা করি এবং সমাধানে পদক্ষেপ নিই। এটা জনগণের প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতা, তবে এটাকে আমাদের দুর্বলতা ভেবে যেন ভুল বোঝা না হয়।
গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্যে মানুষের ইচ্ছার ওপরই সরকার নির্ভর করছে- মন্তব্য করে আইনমন্ত্রী বলেন, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলনে আগামীর বাংলাদেশের পথচলা নির্ধারিত হবে। আর এই পথেই মানবাধিকারের সুরক্ষা দেব আমরা।
বাংলাদেশ বিশ্বের একমাত্র দেশ, যা গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও ন্যায়বিচারের জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে জানিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে মানবাধিকার, গণতন্ত্র এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য। এটি কোনো বিস্ময় নয় যে, বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ ন্যায়বিচার, স্বচ্ছতা ও মানবাধিকারের বিষয়ে বিশ্বাসী। আমি তখনই অবাক হই, যখন অন্যরা আমাদের মানবাধিকারের মূল্যবোধের শিক্ষা দেয়।
দীর্ঘ সময় ধরে বাংলাদেশে বিচারহীনতার সংস্কৃতি ছিল জানিয়ে তিনি বলেন, ২১ বছর পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে এ দেশের মানুষকে মানবাধিকার, ন্যায়বিচার ও সম্মান ফিরিয়ে দিয়েছেন। এর পর থেকে বাংলাদেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হয়।
বাংলাদেশের চোখে মানবাধিকার জানাতে গিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, উন্নয়ন, খাদ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্যের অধিকার হচ্ছে মানবাধিকার। বঙ্গবন্ধু একটি আন্দোলন চালু করেছিলেন, যেখানে খাদ্যের অধিকার, ভোটের অধিকার, শিক্ষার অধিকার, স্বাস্থ্যের অধিকার হচ্ছে মানবাধিকার। তিনি বাংলাদেশকে একটি সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন, যেখানে এসব অধিকার নিশ্চিত হবে। এগুলো বাংলাদেশের অগ্রাধিকার।
শেখ হাসিনার অর্জনগুলো বলতে গিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশে এখন আর কেউ না খেয়ে মারা যায় না। আমরা খাদ্যের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছি। সেই সঙ্গে শেখ হাসিনা সরকারের আমলে ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তিনি নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন ও প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করেছেন, যাতে বাংলাদেশে স্বচ্ছ ভোট ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা হয়। দুর্ভাগ্যবশত এ ক্ষেত্রে কিছু দুর্বলতা রয়েছে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রেও ৭৭ শতাংশ রিপাবলিক সমর্থক বিশ্বাস করেন যে, তাঁদের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোটে চুরি হয়েছে। ৭৭ শতাংশ মার্কিন নাগরিক বিশ্বাস করেন, মার্কিন গণতন্ত্রে সংশোধন প্রয়োজন। আমি খুশি, বাংলাদেশ অনেক ভালো করছে। তবে আমরা আরও ভালো করতে চাই। আমরা যুক্তরাষ্ট্রের মতো হতে চাই না। বাংলাদেশ সত্যিকারের জনপ্রতিনিধি চায়।
বাংলাদেশ মানবাধিকারে বিশ্বাস করে দাবি করে ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, শেখ হাসিনার সরকার বাংলাদেশে আগামী জাতীয় নির্বাচন অবাধ, স্বচ্ছ এবং অংশগ্রহণমূলকভাবে অনুষ্ঠানের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখার বিষয়ে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। আর সংবিধান অনুযায়ী যার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকবে স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের হাতে। সম্প্রতি নির্বাচন কমিশন স্থানীয় সরকার নির্বাচন সফলভাবে অনুষ্ঠান করেছে, যাতে সব দল ও মানুষের অংশগ্রহণ ছিল। আওয়ামী লীগ জনগণের মতামতে বিশ্বাস করে। বাইরের কোনো শক্তির হস্তক্ষেপ কিংবা অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্র আমাদের এ পথ থেকে বিচ্যুত করতে পারবে না। সব ধরনের মানবাধিকার উন্নয়ন ও সুরক্ষা আমাদের সাংবিধানিক ও আদর্শগত বাধ্যবাধকতা।
ঢাকার ১৫ বিদেশি মিশনের বিবৃতি নিয়ে অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম বলেন, ১৫টি মিশনের বিবৃতি আমাদের নজরে এসেছে। আগেও বলেছি, বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা ও নীতির মূলে রয়েছে গণতান্ত্রিক নীতি ও মূল্যবোধ। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে এ দেশের জন্ম হয়েছে। আর এতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং অন্য মহান নেতাদের পাকিস্তানের স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে সারাজীবনের সংগ্রামের গৌরবময় ইতিহাস রয়েছে। এ সংগ্রাম চলবে এবং দেশকে গণতান্ত্রিক ও মৌলিক স্বাধীনতার ধারা থেকে বিচ্যুত করতে শেখ হাসিনা কোনো বাইরের চাপের কাছে মাথানত করবেন না।
শেখ হাসিনার শক্তির উৎস হচ্ছে সাধারণ জনগণ দাবি করে তিনি বলেন, এ দেশের মানুষ ঠিক করবে কে এই দেশ শাসন করবে। কোনো বাইরের শক্তি বা অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্র এটি ঠিক করে দিতে পারবে না। এ মাটিতে গণতন্ত্র, মানুষের সম্মান এবং মৌলিক স্বাধীনতা সুরক্ষায় আমরা কখনোই সংগ্রাম ছাড়ব না।
ঢাকার বিদেশি মিশনগুলোতে দায়িত্বরত দূতদের কূটনৈতিক শিষ্টাচার লঙ্ঘন না করার পাশাপাশি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন মো. শাহরিয়ার আলম। তিনি বলেন, তারা নিজ দেশে বিদেশি মিশনগুলোকে যেভাবে দেখতে চায়, বাংলাদেশেও যাতে তারা সেইভাবে কূটনৈতিক শিষ্টাচার মেনে চলে। বাংলাদেশ সরকার ধৈর্য ধরে রয়েছে। সেই সঙ্গে বিদেশি অতিথিদের বিষয়ে আমরা আন্তরিক। সবার সঙ্গে আমরা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে আন্তরিক। তবে আমাদের ধৈর্যের একটা সীমা রয়েছে।
- বিষয় :
- বিদেশি দূত
- পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়
- সেমিনার