বেহাল পর্যটনকেন্দ্র
পর্যটকের চাপ বাড়লেই বাড়ে অব্যবস্থাপনা

মহাকালের যাত্রায় বিদায় নিল ২০২২। বছরের শেষ সূর্যাস্ত দেখতে শনিবার রাজশাহীতে পদ্মার পাড়ে মানুষের ভিড় - শরীফুল ইসলাম তোতা
সমকাল প্রতিবেদক
প্রকাশ: ৩১ ডিসেম্বর ২০২২ | ১৮:০০ | আপডেট: ৩১ ডিসেম্বর ২০২২ | ২০:৫৫
বিদায় ২০২২। নতুন বছরকে বরণ করতে প্রস্তুত দেশের পর্যটনকেন্দ্রগুলো। বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত কক্সবাজার, কুয়াকাটা ও রাঙামাটির সাজেকে বছরের শেষ সময়ে ভ্রমণে এসেছেন হাজারো মানুষ। তাঁদের বেশিরভাগই এসেছেন খ্রিষ্টীয় ক্যালেন্ডারে বছরের শেষ রাত ও নতুন বছরের প্রথম প্রহর উদযাপন করতে। কিন্তু ঘুরতে এসে পর্যটকরা পড়েছেন না বিড়ম্বনায়। অব্যবস্থাপনা, বিশৃঙ্খলা, বাড়তি ভাড়া আদায়, প্রতারণা, নিম্নমানের খাবার পরিবেশনসহ নানা হয়রানিতে আনন্দ ম্লান হয়ে যাচ্ছে। এতে পর্যটক আকর্ষণে পিছিয়ে যাচ্ছে দেশ। অভ্যন্তরীণ পর্যটনকেন্দ্র থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন ভ্রমণপ্রেমীরা। ঈদুল আজহা, ঈদুল ফিতর, বড়দিন ও নববর্ষের মতো দিবসে পর্যটক সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে প্রশাসন। এমন হতাশাজনক চিত্র গণমাধ্যমে এলেও কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে দিনে দিনে অব্যবস্থাপনা আরও প্রকট হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের পর্যটন কর্তৃপক্ষ এ জন্য দায়ী। পর্যটকদের সুরক্ষায় কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যায় না। দৈন্যদশার কারণে বিদেশি পর্যটককে তো আকৃষ্টই করা যাচ্ছে না, বরং দেশীয় পর্যটকরাই বিদেশমুখী হচ্ছেন। পর্যটন খাতের টেকসই উন্নয়নের দিকে নজর দেওয়া দরকার বলে মনে করেন তাঁরা।
পর্যটক বাড়লেই অতিরিক্ত অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার প্রতিযোগিতা: তিন দিনের অবকাশ যাপনে গত ২৫ ডিসেম্বর কক্সবাজারে এসেছেন ব্যবসায়ী আসিফ কামাল। মা-বাবা, স্ত্রী, দুই সন্তানসহ সপরিবারে নারায়ণগঞ্জ থেকে এসে কক্সবাজার শহরের সুগন্ধা পয়েন্টে হোটেল সি-কক্সে ওঠেন। এসি রুম ভাড়া নিয়েছেন সাড়ে ৫ হাজার টাকা করে। আসিফ কামাল সমকালকে বলেন, গত তিন মাস আগে যখন জরুরি কাজে কক্সবাজার আসি, তখন একই হোটেলে ২৫০০ টাকা দিয়ে এসি রুম নিয়েছিলাম। আগের নিয়মে পাঁচ দিনের বাজেট করে আমরা চার দিনের জন্য কক্সবাজার এসেছিলাম। কিন্তু হোটেল রুম থেকে শুরু করে সবকিছুর দাম বেড়ে যাওয়ায় বাজেটও কমে গেছে, তাই বাধ্য হয়ে তিন দিনের মধ্যে নারায়ণগঞ্জ ফিরতে হচ্ছে। একইভাবে এর পাশের হোটেল সি-আলিফে ঢাকা থেকে এসেছেন নবদম্পতি আরিফ হাসান। তাঁরা দুই দিনের অবকাশ যাপনে এসে ওঠেন এ হোটেলে। তাঁরা এসি রুমপ্রতি ভাড়া নিয়েছেন ৪ হাজার টাকা করে। অথচ এ রুমগুলো দুই মাস আগেও ভাড়া হতো ২ হাজার টাকায়।
কক্সবাজারে এভাবে পর্যটক বাড়লে অতিরিক্ত অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার প্রতিযোগিতা চলে। ভিড়কে পুঁজি করে হোটেল ভাড়া, গাড়ি ভাড়া, রেস্তোরাঁয় অতিরিক্ত টাকা আদায় করছেন ব্যবসায়ীরা। সেবা আর খাবারের মান নিয়েও সন্তুষ্ট নন পর্যটকরা।
ঢাকা থেকে আসা চাকরিজীবী আবছার কামালের অভিযোগ, ওয়াশ রুম ব্যবহার অনুপযোগী, রুমের লাইটও জ্বলে না। অভিযোগ দেওয়ার পর হোটেল কর্তৃপক্ষ বলেছেন, থাকলে থাকেন, না থাকলে বের হয়ে যান। পর্যটক জান্নাতুল ফেরদৌসের অভিযোগ, গত দু'দিন ধরে যেসব রেস্তোরাঁয় তিনি খেয়েছেন সব ক'টিতে দাম অতিরিক্ত নিয়েছে।
কক্সবাজার হোটেল-মোটেল-গেস্ট হাউস মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কাশেম সিকদার বলেন, কক্সবাজারের আবাসিক হোটেলগুলোতে ধারণক্ষমতা ১ লাখ ২০ থেকে ৩০ হাজার মানুষের। তার অতিরিক্ত পর্যটক কক্সবাজার এসেছেন। প্রতিবারই ছুটিকে কেন্দ্র করে এক শ্রেণির মৌসুমি ব্যবসায়ী ও মধ্যস্বত্বভোগী তৈরি হয়। এরা কৌশলে হোটেলের কিছু রুম অগ্রিম বুকিং দিয়ে রাখেন। পর্যটকরা এলে অতিরিক্ত দামে তা বিক্রি করেন। ফলে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অভিযোগটি বারবার আলোচনায় আসে।
কক্সবাজার জেলা রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির সভাপতি নঈমুল হক চৌধুরী টুটুল বলেন, কক্সবাজারে তাঁদের সমিতিভুক্ত রেস্তোরাঁর সংখ্যা ১৩৪টি। প্রতিটি রেস্তোরাঁ জেলা প্রশাসন ও পৌরসভা থেকে নিবন্ধন করা হয়েছে। মূল্য তালিকা টানানো আছে। অতিরিক্ত টাকা নিলে জেলা প্রশাসনকে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানান তিনি। তাঁর দাবি, নিবন্ধনের বাইরে কলাতলীসহ আশপাশের এলাকায় ২ শতাধিক রেস্তোরাঁ রয়েছে, যাদের বৈধতা নেই। তারা হয়রানি করে। এসব রেস্তোরাঁর তালিকা জেলা প্রশাসন ও রাজস্ব বিভাগে তিনি নিজেই জমা দিয়েছেন।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের পর্যটন বিভাগের দ্বায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মাসুম বিল্লাহ বলেন, কলাতলী ও ডলফিন মোড়ে অভিযোগকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। যদি কোনোভাবে কেউ হয়রানির শিকার হন তাঁরা অভিযোগ জানাতে পারবেন। অভিযোগ পেলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আগাম বুকিং না দেওয়ায় দুর্ভোগ: রাঙামাটির সাজেকে ১১২টি কটেজ-রিসোর্ট আছে। ধারণ ক্ষমতা চার হাজার। বিশেষ দিনগুলোতে দ্বিগুণ হারে পর্যটক আসেন। আগেই রিসোর্ট বুকিং না দেওয়ায় পর্যটকরা পড়েন বিপাকে। বড়দিনের ছুটিতে হাজার হাজার পর্যটক উন্মুক্ত স্থানে রাত কাটিয়েছেন। রাঙামাটি জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, সাজেকে আসার আগে পর্যটকদের আগেই হোটেল বা রিসোর্ট বুকিং দিতে হবে।
চাপ বাড়লেই বাড়ে হেনস্তা: পটুয়াখালীর কুয়াকাটায় চাপ বাড়লেই পদে পদে হেনস্তার শিকার হতে হচ্ছে পর্যটকদের। আবাসিক হোটেলে বাড়তি ভাড়া আদায় ও অগ্রিম বুকিং না নেওয়া ও পচা-বাসি খাবার সরবরাহসহ নানা প্রতারণায় পড়তে হচ্ছে।
যশোরের মো. রাশেদুল কবির বলেন, 'আমি গত বছর কুয়াকাটায় এসেছিলাম পরিবারের সদস্যদের নিয়ে। তখন যে রুমে ১ হাজার টাকা ভাড়া দিয়েছিলাম, এবার এসে সেই রুমে ২৫০০ টাকা ভাড়া গুনতে হয়েছে।' ঢাকার খিলক্ষেত থেকে আসা গৃহবধূ রাবেয়া আক্তার বলেন, 'বেশিরভাগ রেস্তোরাঁয় বাসি খাবার ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। ২৫০ টাকার নিচে কোনো মাছ পাওয়া যায় না।'
কুয়াকাটা খাবার হোটেল মালিক সমিতির সভাপতি মো. সেলিম মুন্সী বলেন, বেশিরভাগ হোটেলই উচ্ছেদ অভিযানে পড়েছে। ভাঙচুরের কারণে হোটেলগুলো অগোছালো। ফলে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ দেখা যাচ্ছে। বাসি-পচা এবং অতিরিক্ত দাম নেওয়ার অভিযোগ সত্য নয়।
কুয়াকাটা হোটেল-মোটেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক এম.এ মোতালেব শরীফ বলেন, কিছু কিছু ঘটনায় কুয়াকাটার ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কুয়াকাটা জোনের ট্যুরিস্ট পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আব্দুল খালেক জানান, কুয়াকাটায় চাপ বাড়লেই পর্যটকরা নানাভাবে হেনস্তা ও হয়রানির শিকার হচ্ছেন। এখানে নিয়ম-কানুনের কোনো বালাই নেই। যে যেভাবে পারছে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন।
বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের (বিটিবি) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আবু তাহের মো. জাবের বলেন, পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে সেবার মান বাড়াতে আমরা সব সময়ই কাজ করছি। কিন্তু বিশেষ দিনগুলোতে পর্যটকের ঢল নামায় কিছু অব্যবস্থাপনা দেখা দিচ্ছে। এ অবস্থায় সরকারের সংশ্নিষ্ট কর্তৃপক্ষও হিমশিম খাচ্ছে জনবল সংকটের কারণে। আমরা নিয়মিত হোটেল মালিকসহ এ খাতের উদ্যোক্তাদের সঙ্গে বৈঠক করি। আবার পর্যটকদের মাঝেও সচেনতা বাড়াতে নানা প্রচারণা চালাচ্ছি। কিন্তু বিশেষ দিবসে উভয় পক্ষই তাদের করণীয় ভুলে যায়। পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে পর্যটকের সুরক্ষায় আমরা বেশকিছু উদ্যোগ নেব।
- বিষয় :
- পর্যটনকেন্দ্র