সংলাপের সুপারিশ ফাইলে, পুরোনোদের পথেই ইসি

মসিউর রহমান খান
প্রকাশ: ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ | ২১:০১
দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই ঢাকঢোল পিটিয়ে সংলাপে বসেছিল কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন (ইসি)। সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার ঘোষণা দিয়েছিল তারা। সুষ্ঠু ভোটের স্বার্থে রাজনৈতিক দলগুলোকে ঐকমত্যে আসা এবং প্রয়োজনে সংবিধান সংশোধনের কথাও বলেছেন স্বয়ং প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। পাশাপাশি ভোটকেন্দ্রের গোপন কক্ষের 'ভূত তাড়ানো' এবং ব্যালট বাক্স ছিনতাই রোধে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ও ভোটকেন্দ্রে সিসি ক্যামেরা মোতায়েনের পক্ষে জোরেশোরে সাফাই গাইতে শুরু করেন। কিন্তু সরকারের আর্থিক টানাপোড়েনে ভেস্তে গেছে তাদের এসব পরিকল্পনা। বড় পরিসরে ইভিএম ব্যবহারের পরিকল্পনা থেকে ইসি ইতোমধ্যে সরে আসতে বাধ্য হয়েছে। সারাদেশে একযোগে ৩০০ আসনে সিসি ক্যামেরা স্থাপনের বিষয়টি এখনও নিশ্চিত করা যায়নি। এমনকি ফাইলবিন্দ হয়ে পড়ে আছে ইসির সংলাপে অংশীজনের সুপারিশও।
একই সঙ্গে নিজেদের কাজের মাধ্যমে জনগণ ও রাজনৈতিক দলের আস্থা অর্জনের ঘোষণা দিয়েছিলেন তাঁরা। কিন্তু সংসদের বাইরে থাকা রাজপথের বিরোধী দল বিএনপির আস্থা অর্জনের কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। উল্টো এক বছরে তাদের নেওয়া সিদ্ধান্তে জনমনে আস্থার সংকট বেড়েছে বলেই মনে করছেন বিশ্নেষকরা।
চলতি বছরের ডিসেম্বরের শেষে বা আগামী বছরের শুরুতে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা রয়েছে ইসির। সেই হিসাবে সংসদ নির্বাচনের বাকি আছে মাত্র ১০ মাস। এ সময়ের মধ্যে দেশের দুই রাজনৈতিক প্রধান প্রতিপক্ষের মধ্যে দূরত্ব কমার কোনো লক্ষণ নেই। বিশ্নেষকদের মতে, মুখে যাই বলুক- নূরুল হুদা ও কাজী রকিব কমিশনের মতোই বর্তমান কমিশন আরও একটি একতরফা নির্বাচনের পথে হাঁটছে। সংলাপের সুপারিশ বাস্তবায়নে ইসির পদক্ষেপ বা আন্তরিকতার প্রমাণও পাওয়া যায়নি। এই এক বছরে তাদের নেওয়া সিদ্ধান্তে সুদৃঢ় অবস্থানের ঘাটতি ছিল।
যদিও ইসির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, রাজনৈতিক বিরোধ রাজনৈতিকভাবে সমাধান করতে হবে। রাজনৈতিক বিরোধের দায় ইসির ঘাড়ে চাপানোর সুযোগ নেই। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছেন, 'নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা প্রশ্নে বড় দু'দলের অনড় অবস্থান দেশের জন্য বিপজ্জনক। এই অনড় অবস্থানের মধ্যে নির্বাচন হলে ফলাফলের ওপর ঝুঁকি থাকতে পারে। আইনশৃঙ্খলাজনিত সমস্যা হতে পারে, মানুষ বিপদগ্রস্ত হতে পারে।' কমিশনের সীমাবদ্ধতা তুলে ধরে সিইসি আরও বলেছেন, ইসিকে সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন করতে হবে। সংবিধানে বর্তমানে নির্বাচন ব্যবস্থা যেভাবে বহাল আছে, সেভাবে নির্বাচন করতে হবে। যদিও তিনি শেষ মুহূর্তে সমঝোতার বিষয়ে আশাবাদও ব্যক্ত করেছেন।
তবে ইসির এ অবস্থানকে দায় এড়ানোর চেষ্টা বলে মনে করছেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। তাঁর মতে, সংলাপে অংশীজনদের প্রস্তাবগুলো নিয়ে ইসির আন্তরিকতা লক্ষ্য করা যায়নি। সেখানে অনেক প্রস্তাব ছিল। কিছু সংবিধানের সঙ্গে সম্পর্কিত আবার অনেক বিষয় ছিল সংবিধানের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়।
তিনি বলেন, তপশিল ঘোষণার আগে সবার জন্য সমান সুযোগ বা নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি ইসির প্রধান দায়িত্ব। ডিসিদের রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব না দেওয়ার দাবি সংলাপে বেশ জোরালোভাবে উঠেছিল। রাজনৈতিক দলের এসব প্রস্তাবকে যৌক্তিক আখ্যায়িত করে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, সংবিধানের দোহাই দিলে চলবে না। সংবিধান তো আর পাথর নয়। পরিবর্তন হতে হতেই বর্তমান সংবিধান এই স্থানে এসেছে। ইসিও জানে, এসব প্রস্তাব বাস্তবায়ন করতে না পারলে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না। ইসির উচিত ছিল এসব বিষয়ে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব সরকারের কাছে সুপারিশ আকারে তুলে ধরা। এতদিন না করলেও সুষ্ঠু নির্বাচন করতে চাইলে এসব কাজ তাদের করতেই হবে। দ্রুত এ বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া উচিত।
ইসি আয়োজিত রাজনৈতিক দলের সংলাপে নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থায় কোনো না কোনো পরিবর্তনের পক্ষে ছিল অধিকাংশ দল। ১০টি দল নির্বাচনের সময় নিরপেক্ষ বা সর্বদলীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব করে। আর ১২টি দল নির্বাচনকালে সরকারের ক্ষমতা সীমিত করে ইসির ক্ষমতা বাড়ানোর প্রস্তাব দেয়। বিএনপিসহ যে ৯টি দল সংলাপ বর্জন করেছে, তাদের কাছেও মূল বিবেচ্য বিষয় নির্বাচনকালীন সরকার। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ এবং সাম্যবাদী দলও নির্বাচনকালে একাধিক মন্ত্রণালয় সরকারের কাছ থেকে ইসির অধীনে নেওয়ার প্রস্তাব করে। ইসির নিবন্ধিত ৩৯ দলের মধ্যে ৩০টি দল সংলাপে অংশ নেয়। আর বিএনপি, সিপিবি, বাসদসহ ৯টি দল সংলাপ বর্জন করে।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ অবশ্য নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে তাদের প্রস্তাবে বলেছিল, নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা 'পাস্ট অ্যান্ড ক্লোজড চ্যাপ্টার'। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় ইসির অধীনে নির্বাচন হবে।
সংলাপ শেষে আগামী নির্বাচনের জন্য ইসির ঘোষিত রোডম্যাপ বা কর্মপরিকল্পনা ঘোষণা করে। কিন্তু সেখানে নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে নিজেদের কোনো অবস্থান প্রকাশ করেনি ইসি। ওই রোডম্যাপে নির্বাচনের পথে ১৪টি চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে কমিশনের প্রতি নির্বাচনে অংশহগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা সৃষ্টি, নির্বাচনের দায়িত্বে মাঠ পর্যায়ে কর্মকর্তা বিশেষ করে পুলিশ ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন এবং ইভিএমের প্রতি রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা সৃষ্টি।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, এক বছরের দায়িত্ব পালনে কমিশনের প্রতি জনআস্থার সংকট মোটেই কাটেনি বরং অনেক ক্ষেত্রেই বেড়েছে। সংলাপের প্রস্তাবগুলো তারা ফাইলবন্দি করে রেখেছে। ইভিএম প্রসঙ্গে তাদের বক্তব্য বিভ্রান্তিমূলক। অনিয়মের কারণে গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচনে বন্ধ করলেও রাঘববোয়ালদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বগুড়ায় উপনির্বাচন নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিরো আলমের অভিযোগ খণ্ডাতে ব্যর্থ হয়েছে ইসি। ব্রাহ্মণবাড়িয়া উপনির্বাচনে একজন প্রার্থী উধাও হলেও তাদের কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ ছিল না।
যদিও নির্বাচন কমিশনার আহসান হাবীব এই প্রতিবেদককে হোয়াটসঅ্যাপে পাঠানো এক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, 'আমরা কঠোর বার্তা দিতে পেরেছি নির্বাচন ব্যবস্থাপনায়; গাইবান্ধা উপনির্বাচন অনিয়মের কারণে বন্ধ করে দিয়েছিলাম। সিটি নির্বাচনগুলো সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়েছে। ভোটারদের আস্থা ফিরছে। সংসদ নির্বাচনেও আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকবে সুন্দর নির্বাচনের।'
তিনি বলেন, 'সর্বোচ্চ দেড়শ আসনে ইভিএমে ভোট করার পরিকল্পনায় ইসির কোনো সময় নষ্ট হয়নি বরং জনসচেতনতা বেড়েছে। সারাদেশেই ইভিএম নিয়ে ভোটারদের আগ্রহ ও সচেতনতা তৈরি করতে পেরেছি। অর্থনৈতিক বাস্তবতা ও সবার প্রত্যাশা বিবেচনা করে বড় পরিসরে ইভিএমে ভোট হচ্ছে না। তবে বিদ্যমান সচল ও কার্যক্ষম ইভিএমগুলোর সর্বোচ্চ ব্যবহার করা হবে।'
- বিষয় :
- সংলাপের সুপারিশ
- ইসি