ঢাকা মঙ্গলবার, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

২০ ওষুধ কোম্পানির লাইসেন্স বাতিল চায় সংসদীয় কমিটি

২০ ওষুধ কোম্পানির লাইসেন্স বাতিল চায় সংসদীয় কমিটি

মসিউর রহমান খান

প্রকাশ: ২০ এপ্রিল ২০১৬ | ১৩:৪৬

কারখানার অস্তিত্ব নেই, কিন্তু বাজারে কোম্পানির ওষুধ রয়েছে। আবার একই কারখানায় তৈরি হচ্ছে একাধিক কোম্পানির ওষুধ! কোনো কোনো কোম্পানি প্রকাশ্যে কারখানা বন্ধের ঘোষণা দিলেও বছরের পর বছর তাদের নিম্নমানের ওষুধ বাজারে পাওয়া যাচ্ছে। কিছু ক্ষেত্রে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের যোগসাজশের প্রমাণও মিলেছে।

স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি গঠিত একটি উচ্চ পর্যায়ের বিশেষজ্ঞ দলের প্রতিবেদনে ভয়ঙ্কর এমন চিত্র ফুটে উঠেছে। জীবন রক্ষাকারী ওষুধ তৈরির নামে জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক এসব কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে বিশেষজ্ঞদের সুপারিশ আমলে নিয়ে সংসদীয় কমিটি ২০টি কোম্পানির লাইসেন্স ও সব ধরনের ওষুধ তৈরির অনুমতি বাতিলের সুপারিশ করেছে। এ ছাড়া ১৪টি কোম্পানির বিরুদ্ধে সব ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক উৎপাদনের অনুমতি বাতিল এবং ২২টি কোম্পানির বিরুদ্ধে পেনিসিলিন ও সেফালোস্পোরিন গ্রুপের অ্যান্টিবায়োটিক উৎপাদনের অনুমতি বাতিলের সুপারিশ করা হয়েছে।

.গতকাল বুধবার সংসদ ভবনে কমিটির বৈঠকে এ প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন বিশেষজ্ঞ দলের প্রধান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক আ ব ম ফারুক। কমিটির সভাপতি শেখ ফজুলল করিম সেলিমের সভাপতিত্বে বৈঠকে আরও অংশ নেন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, প্রতিমন্ত্রী জাহেদ মালেক, আ ফ ম রুহুল হক, মো. ইউনুস আলী সরকার ও সেলিনা বেগম। এ ছাড়া বিশেষ আমন্ত্রণে উপস্থিত ছিলেন ঔষধ শিল্প সমিতির সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন।

আ ব ম ফারুকের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের বিশেষজ্ঞ দল দেশের ৮৪টি ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সরেজমিন পরিদর্শন শেষে এ প্রতিবেদন তৈরি করে। এতে তারা ২০টি ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিলের সুপারিশ করা ছাড়াও ১৪টি কোম্পানির সব ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক (নন-পেনিসিলিন, পেনিসিলিন ও সেফালোস্পোরিন গ্রুপ) ওষুধ উৎপাদনের অনুমতি বাতিল এবং ২২টি কোম্পানির পেনিসিলিন ও সেফালোস্পোরিন গ্রুপের অ্যান্টিবায়োটিক উৎপাদনের অনুমতি বাতিল করার সুপারিশও করে। দ্রুত এই সুপারিশ বাস্তবায়িত না হলে এবং অভিযুক্ত কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া না হলে দেশের স্বাস্থ্য খাতে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসবে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।

কমিটির সদস্য সেলিনা বেগম সমকালকে বলেন, সংসদীয় কমিটির পক্ষ থেকে বিশেষজ্ঞ তদন্ত কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে মন্ত্রণালয়কে বলা হয়েছে। বিশেষ করে জীবনহানিকর ভেজাল ওষুধ উৎপাদনের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। ভেজাল ওষুধ উৎপাদনের পাশাপাশি যারা বিক্রি করবে, তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।

বৈঠক সূত্রে জানা যায়, নবম সংসদেও এই বিশেষজ্ঞ দল কারখানা পরিদর্শনের কাজ করেছিল। তারই ধারাবাহিকতায় দশম সংসদেও তারা কারখানা পরিদর্শনের কাজ শুরু করে। অধ্যাপক আ ব ম ফারুকের নেতৃত্বে গঠিত বিশেষজ্ঞ দলের অন্য সদস্যরা হলেন_ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের অধ্যাপক মো. সাহাবুদ্দিন কবীর চৌধুরী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ারুল ইসলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক ড. সীতেশ চন্দ্র বাছার এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল ফার্মেসি অ্যান্ড ফার্মাকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. শওকত আলী।

কমিটির বৈঠকে উপস্থাপিত বিশেষজ্ঞ দলের ১৭১ পৃষ্ঠার দীর্ঘ প্রতিবেদন সমকালের হাতে রয়েছে। এতে ময়মনসিংহের বিসিকে অবস্থিত এক্সিম ফার্মাসিউটিক্যালস সম্পর্কে বলা হয়েছে, কারখানাটি আগের মতোই জিএমপি নীতিমালা অনুসরণ করে ওষুধ উৎপাদনে ব্যর্থ। পাঁচ বছর ধরে কারখানার সংস্কার ও উন্নয়নের সুযোগ থাকলেও তা করা হয়নি; বরং কারখানা সাসপেন্ডেড ঘোষণা করে গোপনে ওষুধ তৈরি করছে। জনস্বাস্থ্য রক্ষায় তাদের লাইসেন্স বাতিলের সুপারিশ করা হলো। সাভারের ব্যাংক কলোনি এলাকায় অবস্থিত এভার্ট ফার্মা সংস্কারের নামে ওষুধ তৈরি বন্ধ রাখার ঘোষণা দিলেও গোপনে তাদের বিপুল পরিমাণ ওষুধ তৈরির আলামত স্পষ্ট। এদের ওষুধ জনস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।

রাজধানীর মিরপুরের ৭৯৭ মনিপুরে অবস্থিত বিকল্প ফার্মাসিউটিক্যাল ওষুধ কারখানা বন্ধ রাখার ঘোষণা দিলেও বাজারে তাদের কিছু নিম্নমানের ওষুধ পাওয়া গেছে। কারখানা পরিদর্শনের চেষ্টা করা হলেও কর্তৃপক্ষের অসহযোগিতার কারণে তা সম্ভব হয়নি।

রাজধানীর ৮২/২ উত্তর যাত্রাবাড়ীর ডলফিন ফার্মাসিউটিক্যাল সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়, এত নিম্নমানের এবং জিএমপি সুবিধাহীন একটি কারখানা কীভাবে ওষুধ প্রশাসন থেকে নন-পেনসিলিন ও পেনিসিলিন গ্রুপের অ্যান্টিবায়োটিকসহ গুরুত্বপূর্ণ ওষুধ তৈরির অনুমতি পেল, তা বোধগম্য নয়। পাঁচ বছরের বেশি সময় পাওয়ার পরও এই কোম্পানি জিএমপি সক্ষমতা অর্জনে ব্যর্থ হওয়ায় এর প্রকাশ্য ও গোপনে উৎপাদিত ওষুধ জনস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।

নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে মিজমিজি মাদ্রাসা রোডে অবস্থিত ড্রাগল্যান্ড লিমিটেডের ঠিকানায় কোনো কারখানার অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। তবে বাজারে এদের ওষুধ পাওয়া যায়, যা অত্যন্ত নিম্নমানের। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, এই কোম্পানির মালিক শাহীন ও সানির ঢাকার মিটফোর্ড মার্কেটে ওষুধের দোকান রয়েছে। তারা অন্যত্র কারখানা বসিয়ে গোপনে ওষুধ তৈরি করছে কি-না, তা ঔষধ প্রশাসনও জানে না।

মুন্সীগঞ্জের মিরকাদিমের পাইকপাড়া এলাকায় অবস্থিত গ্গ্নোব ল্যাবরেটরিজের উৎপাদন বন্ধ ঘোষণা করা হলেও বছরের পর বছর বেআইনিভাবে ওষুধ উৎপাদন করে চলছে। লোকালয় থেকে দূরে এবং অজপাড়াগাঁয়ে এর কারখানার অবস্থান হওয়ায় র‌্যাব-পুলিশ সঙ্গে নিয়েও মোবাইল কোর্ট তাদের কাউকে আটকাতে পারেননি। এলাকাবাসী জানিয়েছেন, এখান থেকে প্রতিনিয়ত ট্রাকে করে ওষুধ মিটফোর্ডে নেওয়া হলেও জনগণকে এর ধারেকাছে ঘেঁষতে দেওয়া হয় না। এ ছাড়া এই কোম্পানির সঙ্গে যোগসাজশে অন্য কোম্পানির এখানে নিম্নমানের ও নকল ওষুধ উৎপাদনের আলামত পাওয়া গেছে।

সিলেটের গোটাতিকার এলাকায় অবস্থিত জালফা ল্যাবরেটরিজের বিরুদ্ধে কারখানা বন্ধের ঘোষণা দিয়ে গোপনে ওষুধ উৎপাদনের প্রমাণ পাওয়া গেছে। তাদের ওষুধ ব্যবহারে রোগী ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন এবং বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কা রয়েছে। তাই তাদের সব ধরনের ওষুধ উৎপাদনের অনুমতি বাতিলের সুপারিশ করা হলো।

নোয়াখালীর চৌমুহনী বিসিকে অবস্থিত কাফমা ফার্মাসিউটিক্যালস সম্পর্কে বলা হয়েছে, কারখানা বন্ধ ঘোষণা করলেও তাদের নামে বাজারে প্রচুর মানহীন ওষুধ পাওয়া যাচ্ছে।

রংপুরের সূত্রাপুরে দর্শনা মোড়ে অবস্থিত মেডিকো ফার্মাসিউটিক্যাল সম্পর্কে বলা হয়েছে, প্রথমবার পরিদর্শনে কারখানার পরিস্থিতি শোচনীয় পরিলক্ষিত হয়। পরে ধূর্ততার সঙ্গে তারা উৎপাদন বন্ধের ঘোষণা দিয়ে গোপনে ওষুধ তৈরি করে বাজারে ছাড়ছে। নকল কাঁচামাল দিয়ে নিয়মিতই তারা ওষুধ তৈরি করে যাচ্ছে। অবিলম্বে এই কারখানার লাইসেন্স বাতিলের সুপারিশ করার পাশাপাশি ঔষধ প্রশাসনের অজ্ঞাতে কীভাবে এত দিন তারা উৎপাদন চালাচ্ছে, তা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়েছে প্রতিবেদনে। এ ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে বিষয়টি তদন্তের প্রয়োজন বলেও অভিমত ব্যক্ত করা হয়।

ঢাকার ধামরাইয়ের আটিপাড়ার ন্যাশনাল ড্রাগ ফার্মা সম্পর্কে বলা হয়েছে, এই কারখানায় যেভাবে ওষুধ তৈরি হচ্ছে, তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। জনস্বাস্থ্যের জন্য তা মারাত্মক ক্ষতিকর।

এ ছাড়া প্রতিবেদনে মানসম্পন্ন ওষুধ উৎপাদনে ব্যর্থ হওয়ায় আরও যে কোম্পানির উৎপাদনের লাইসেন্স বাতিলের সুপারিশ করা হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে_ নর্থ বেঙ্গল ফার্মাসিউটিক্যাল, রিমো কেমিক্যাল, রিদ ফার্মাসিউটিক্যাল, স্কাইল্যাব ফার্মাসিউটিক্যাল, স্পার্ক ফার্মাসিউটিক্যাল, স্টার ফার্মাসিউটিক্যাল, সুনিপুণ ফার্মাসিউটিক্যাল, টুডে ফার্মাসিউটিক্যাল, ট্রপিক্যাল ফার্মাসিউটিক্যাল এবং ইউনিভার্সেল ফার্মাসিউটিক্যাল লিমিটেড।

এ ছাড়া সব ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক (নন-পেনিসিলিন, পেনিসিলিন ও সেফালোস্পোরিন গ্রুপ) ওষুধ উৎপাদনের অনুমতি বাতিল করার সুপারিশ করা ১৪টি কোম্পানি হচ্ছে_ আদ্-দ্বীন ফার্মাসিউটিক্যাল, আলকাদ ল্যাবরেটরিজ, বেলসেন ফার্মাসিউটিক্যাল, বেঙ্গল ড্রাগস, ব্রিস্টল ফার্মা, ক্রিস্টাল ফার্মাসিউটিক্যাল, ইন্দো-বাংলা ফার্মাসিউটিক্যাল, মিল্লাত ফার্মাসিউটিক্যাল, এমএসটি ফার্মা অ্যান্ড হেলথকেয়ার, অরবিট ফার্মাসিউটিক্যাল, ফার্মিক ল্যাবরেটরিজ, ফনিক্স কেমিক্যাল, রাসা ফার্মাসিউটিক্যাল ও সেভ ফার্মাসিউটিক্যাল লিমিটেড।

পেনিসিলিন ও সেফালোস্পোরিন গ্রুপের ওষুধ উৎপাদনের অনুমতি বাতিলের সুপারিশ করা ২২টি কোম্পানি হচ্ছে_ অ্যামিকো ফার্মাসিউটিক্যাল, অ্যাজটেক ফার্মাসিউটিক্যাল, বেঙ্গল টেকনো ফার্মা, বেনহাম ফার্মাসিউটিক্যাল, সেন্ট্রাল ফার্মাসিউটিক্যাল, ডিসেন্ট ফার্মা, ড. টিআইএম'স ল্যাবরেটরিজ, গ্গ্নোবেক্স ফার্মাসিউটিক্যাল, গ্রিনল্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যাল, ইনোভা ফার্মাসিউটিক্যাল, মার্কস ড্রাগস, মেডিমেট ল্যাবরেটরিজ, মডার্ন ফার্মাসিউটিক্যাল, মিস্টিক ফার্মাসিউটিক্যাল, ন্যাশনাল ল্যাবরেটরিজ, অর্গানিক হেলথ কেয়ার, ওয়েস্টার ফার্মা, প্রিমিয়ার ফার্মাসিউটিক্যাল, প্রাইম ফার্মাসিউটিক্যাল, সীমা ফার্মাসিউটিক্যাল, ইউনাইটেড কেমিক্যাল অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যাল ও হোয়াইট হর্স ফার্মাসিউটিক্যাল লিমিটেড।

আরও পড়ুন

×